শতদল বড়ুয়া
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সর্বোচ্চ রেকর্ড চলমান। কাঁচা তরকারি প্রতিকেজি নিম্নে ৭০-৮০ টাকা। একমাত্র আলু প্রতিকেজি ২৫ টাকা। মাছ-মাংসের দাম নতুন করে আর কী বলবো। ইলিশ মাছের স্বাদ কি তা সাধারণ জনগণ বহু আগে ভুলে গেছে। মোট কথা নিত্যপণ্যের দাম বানের পানির মতো বাড়ছে। দাম বাড়ার সুযোগ নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ী বলতে বড় বড় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কথা বলছি। তাদের উৎপাদিত পণ্যের দাম প্রতিমাসে বৃদ্ধি করছে নানা অজুহাত দেখিয়ে। এ ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কেনো জানি নীরব রয়েছে। ক্রেতারা পড়েছে নানা সমস্যায়। কারণ আয়ের সাথে ব্যয়ের কোনো মিল নেই। দিশেহারা সাধারণ জনগণ সংশ্লিষ্ট বিভাগের জরুরিভাবে হস্তক্ষেপ কামনা করেছে।
জনগণ নানাবিধ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। ধরা যেতে পারে-বিত্তশালী, মধ্যবিত্ত, নিন্মবিত্ত এবং শ্রমিক শ্রেণি। এক পরিসংখ্যান জানা যায়, বিত্তশালীরা খুব ভালো অবস্থানে আছেন মধ্যবিত্তরা ভালো না থেকেও ভালো, নিম্নবিত্ত কোনোভাবে দিন গুজরান করছে। শ্রমিক শ্রেণিরা চিন্তামুক্ত। এতে বুঝা যায় মধ্যবিত্তরা মহাসংকটে রয়েছে। তারা উপরেও উঠতে পারে না, নিচেও নামতে পারে না। তারা নানা সংকটে থেকেও তাদের অবস্থানের কথা খুলে বলতে পারে না। শ্রমিক শ্রেণির লোকেরা “লা পরওয়া”। যেখানে রাত, সেখানে কাত। না আছে তাদের বড় লোক হওয়ার স্বপ্ন, না আছে গাড়ি-বাড়ির মালিক হওয়ার ইচ্ছে।
বিত্তশালীরা অহোরাত্র চিন্তায় থাকে কিভাবে আরেকটা বাড়ি বানানো যায়, অভিজাত এলাকায় জমি বা ফ্ল্যাট কেনা, ব্যাংক ব্যালান্স বাড়ানো যায়। এ শ্রেণির লোকেরা বেশি আনন্দ পায় গরীব ঠকানো গেলে। কিছু নব্য টাকাওয়ালা আছে। তাদের সাধ আবার ভিন্ন। তারা টাকার বিনিময়ে অন্যের সম্পদ নিজের নামে করে নিতে রক্তের সর্ম্পকের কথা তাদের কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। এ ধরনের লোকদের টাকার অহংকার বা দেমাগী বললেও হয়তোবা ভুল হবে না। বিত্তশালীদের মধ্যে দেমাগী বা অহংকারী তেমন থাকতে পারে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে—তারা শিকড়ের কথা ভুলেনি। মানুষকে অপমানিত করে না, কথায় কথায় শারীরিক নির্যাতনের জন্যে তেড়ে আসে না। সমস্যা শুধু ঐ শ্রেণির লোকদের নিয়ে। হঠাৎ প্রচুর টাকার মালিক হয়ে গেলো, নিজেকে অনেক বড় ভাবতে শুরু করলো। আমরা আশা করবো ঐ শ্রেণির লোকদের মধ্যে সচেতনতার উদ্রেক ঘটবে। কারণ আমরা সকলে জানি “টান সূতার আয়ু অতি সংকীর্ণ”।
মধ্যবিত্তের জীবনযন্ত্রণা বিষয়ে যদি ইতিহাসের দিকে ফিরে থাকাই তাহলে দেখতে পাই—মধ্যবিত্ত সমাজ ব্রিটিশ শাসনযন্ত্রের সৃষ্টি। লর্ড মেকলের পরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্রিটিশ বাণিজ্য এবং শনিচক্রকে মেনে নিয়েছিলো ক্ষমতাবান একদল যুবক সৃষ্টির মাধ্যমে এ সমাজের সূচনা। অন্যদিকে ব্রিটিশ বাণিজ্য ও অর্থনীতির আক্রমণে এ দেশের কৃষি ও কুটিরশিল্পের ধ্বংসস্তূপের উপর লর্ড কর্নওয়ালিসের কৃতিত্বে প্রবর্তিত হলো কলংকজনক জমিদারিতন্ত্র। স্বদেশ ও সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং ইংরেজের আনুগত্য ছিলো সমাজের মজ্জাগত চরিত্র। এ সমস্ত নানাবিধ চিন্তাধারায় স্বদেশ ও সমাজের সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক তৈরি হলো। এতে আবার ঘৃণা ও অবিশ্বাস বাধা হয়ে রইলো।
আমরা সকলে জানি, ইংরেজকে এ দেশ থেকে বিদায় নিতে হলো। তখন জাতি আশা করে ছিলো মধ্যবিত্ত সমাজ সামজিকভাবে ঘুরে দাড়াবে। আশায় গুড়েবালি, এ সমাজের কোনো পরিবর্তন হলো না। কথায় বলে না-যে লাউ, সে কধুই এখনো। এ দেশে সমাজের বিন্যাস ঘটলো প্রথম মহাযুদ্ধের শুরু থেকেই। এ যুদ্ধের কারণে শিল্প-বাণিজ্যের নবো নবো দ্বার খুলে গেলো। এতে কেউ হয়েছে বিত্তশালী, কেউ হয়েছে গরীব। মধ্যবিত্ত সমাজ যেমনটি ছিলো তেমনটি রয়ে গেলো। এ শ্রেণির লোকদের ভাগ্যচাকা খুললো না।
আমাদের এ বাংলাদেশে একশ্রেণির কালোবাজারি, মজুমদার, মুনাফাখোর ও সমাজ বিরোধী লোক দেশের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সুযোগবুঝে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সকল নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ সকল ক্ষেত্রে কৃত্রিম সংকট করে দেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারায় লিপ্ত রয়েছে। তবে জাতির জন্যে সুখবর হলো, বর্তমান সরকার অধিক মুনাফালোভীদের কঠোরহস্তে দমনের জন্যে কাজ অব্যাহত রেখেছেন। সমাজবিরোধী অপশক্তিকে নির্মূলে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
বিদেশি জিনিসের উপর নির্ভরশীল না হয়ে স্বদেশী জিনিসের উপর আস্থাশীল হওয়া গেলে জাতি হবে লাভবান। কিন্তু আমরা ভালোমন্দ বিবেচনা করি না বলে সমস্যাও আমাদের ছাড়তে চায় না। দেশের উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এতে বড়লোক, গরীব লোক পার্থক্য সৃষ্টি না করে যার যার প্রাপ্য সম্মান তাকে দিয়ে কাজে অংশগ্রহণ করালে উন্নয়নের চাকারগতি শক্তিশালী হবে। যেমন-আমাদের হাতের সবকয়টি আঙ্গুল সমান নয়। কাজ করতে গেলে পাঁচ আঙ্গুলের সমন্বয়ে করতে হবে। আমরা যদি একটু চিন্তা করি তা সমাজের নানা বৈষম্য দূর করা সম্ভব হবে।
হাজারো রকম সমস্যায় জর্জরিত সমাজ। ছোট-বড় বৈষম্যের কারণে সমাজ তথা দেশ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে যথেষ্ট বিলম্ব ঘটছে। এ দেশে সর্বশ্রেণীর লোকের সমান নাগরিক রয়েছে। সদাশয় সরকারও বৈষম্যের বিরোধী। তারপরও শোষণচক্র তৎপর রয়েছে। সমাজের যে রূপান্তর সম্ভবত প্রথম মহাযুদ্ধের কাল থেকে সক্রিয়। জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পর তা আরো ঘনীভূত হতে থাকলো। এ নবতর সমাজ বিন্যাস মধ্যবিত্ত সমাজকে চরম জিজ্ঞাসার মুখে দাড় করিয়েছে।
সাংবাদিক, আইনজীবী, ডাক্তার, মাস্টার, প্রকৌশলী, সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে দোকানদার আজ নানাভাবে অবহেলিত। একদিন এদের হাতেই ছিলো সমাজ-রথের রশি-কাছি। আজ সবই পরিবর্তন হয়ে গেছে। বাজারদরসহ সবকিছু লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এতে মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস। তারা না পারে সইতে, না পারে মুখ খুলতে। মাসিক বেতন, সরকারি বৃত্তি বা মাসিক আয়-রোজগার রইলো সীমাবদ্ধ।
তাই বলছিলাম, অন্যেরা ভালোভাবে দিনযাপন করলেও মহাক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে মধ্যবিত্তরা। স্থানীয় এক সাধারণ বাজারে গেছি বাজার করতে স্বল্প মূল্যে সওদাপাতি করবো ভেবে। বাজারে দেখা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘গিন্নি পাঠিয়েছে বাজারে আমাকে ইলিশ মাছের জন্যে। আজ শুক্রবার, মেহমানও নাকি বাসায় আসবেন। আমার পকেটের অবস্থা তেমন একটা ভালো নেই। কিনতে হবে ইলিশ মাছ। তাই এ বাজারে আসলাম দামে একটু কম পাবে ভেবে’। আমার অবস্থার সাথে লোকটার অবস্থার পুরোপুরি মিল থাকায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দেখে লোকটা বললো, ‘আপনার কী হলো’? আমি ঘুরিয়ে তার সাথে মাছ বাজারে ঢুকলাম। এক প্রকার আত্মসম্মান বাঁচানো জন্যে আমিও কেজি সাতশ’ টাকা দরে মাঝারি সাইজের একটা ইলিশ মাছ নিয়ে বাসায় ফিরলাম পকেটে টাকা আর অবশিষ্ট না থাকায়।
এদিকে গিন্নি বাজারের ব্যাগে ইলিশ মাছ ও আলু দেখে আমার উপর রেগে আগুন। অবস্থা বেগতিক দেখে বোবার শত্রু নাইয়ের মতো আমিও নিরবে গিন্নীর সামনে থেকে সরে গেলাম। এ হলো বাস্তবতা।
বাংলাদেশের জনসংখ্যাও বানের পানির মতো বাড়ছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীতে জনসংখ্যা বানের পানিকেও ছাড়িয়ে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে দেশব্যাপী। এ দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্যে দেশের সমাজ ও জনশক্তিকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজে লাগাতে হবে। সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, ব্যাপক জনশক্তির উপযুক্ত ব্যবহার, কৃষি ও শিল্প ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধি ও অপচয় রোধ করা, দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে আমাদের অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে মজবুত করতে পারলে এর সুফল দেশের সর্বশ্রেণীর লোকেরা পাবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিজ্ঞজনরা।
লেখক : সাংবাদিক এবং প্রাবন্ধিক।