‘আধ্যাত্মিকতা’ আর ‘প্রকৃতিবাদ’ এক ও অভিন্ন নয় বরং উভয়ের মধ্যে বিশ্বাস ও চেতনাগত বিস্তর তফাৎ রয়েছে। আধ্যাত্মবাদ যাকে ‘স্রষ্টার সৃষ্টি’ মনে করে, প্রকৃতিবাদীদের ভাষায় তা-ই ‘প্রকৃতি’। প্রকৃতিবাদে ‘প্রকৃতি’ (Nature) বলতে সমগ্র সৃষ্টিজগতকে নির্দেশ করা হয়। এ বিশ্বচরাচরে ‘মানব সৃষ্ট নয়’ এমন দৃশ্য-অদৃশ্য বিষয় এবং জীবন ও প্রাণ নিয়েই প্রকৃতির রূপায়ন বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। সংবেদনশীল নয় বা সাধারণভাবে অনুভূতি প্রকাশ করে না বলেই প্রকৃতিকে প্রাণহীন ভাবা হয়। যদিও প্রকৃতিপ্রেমীরা এতে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পান। তাদের ভাষায়, এ বিশাল প্রকৃতিরাজ্যে মানুষ শুধুই একটি উপাদান; গাছ-পালা , নদী-নালা, পশু-পাখি, পাহাড়-পর্বত সকলবস্তুর মতই মানুষও প্রকৃতির অনুষঙ্গ মাত্র । এ সৃষ্টিনিচয়ের সমষ্টিকে ‘প্রকৃতি’ বলা হলেও আধ্যাত্মবাদীরা এটিকে ‘মাখলুক’ বলে মনে করেন। এ মাখলুকের একক স্বত্ত্বা ‘খালিক’ই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক, পালনকর্তা, নির্দেশদাতা, বিধানদাতা ও রাজাধিরাজ হিসেবে বিশ্বাস করা হয়। সকল কল্যাণ-অকল্যাণ তার হাতেই নিহীত বলে দৃঢ় বিশ্বাসই আধাত্মবাদের মূল ভিত্তি। তাই ‘প্রকৃতি’ ও ‘মাখলুক’ প্রায় এক ও অভিন্ন মনে করাই অধিক যুক্তিযুক্ত। তবে আধ্যত্মবাদে মনে করা হয় মাখলুক এক মহান স্বত্ত্বার মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। মানুষের কর্মফলও নির্ধারিত করেন তিনিই। তা ইহজাগতিক ও পারলৌকিক উভয়ভাবেই হতে পারে।
প্রকৃতিবাদে প্রাণহীন এ সৃষ্টিনিচয়কে সর্বংসহা মনে করা হয়। কারণ, প্রকৃতিকে সাধারণভাবে কোন বিষয়ে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখাতে দেখা যায় না। মনে করা হয়, সৃষ্টির সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী জীবই হচ্ছে মানুষ। প্রকৃতিরাজ্যে মানুষ যা-ই করুক না কেন এ বিষয়ে প্রকৃতির কোন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখানোর সুযোগ নেই বলে ধরে নেয়া হয়। যদিও প্রকৃতি বা মাখলুক নিজ গতিতে খুবই সংবিধিবদ্ধ, ক্রিয়াশীল ও সুশৃঙ্খল। কারণ, বিশ্বাসীরা মনে করেন এ মাখলুকের একজন ‘খালিক’ রয়েছেন। তাই সে মহান স্বত্ত্বা কর্তৃক এটি সুনিয়ন্ত্রিত। প্রকৃতিবাদী যাকে প্রকৃতির চিরায়ত নিয়ম বলতেই অধিক স্বাচ্ছন্ধবোধ করেন। সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে, আবার পশ্চিম দিকে অস্ত যায়-এ নিয়মের কোন হেরফের নেই। অতিপ্রাকৃত সকল বিষয়েই এ একই কথাই প্রযোজ্য। বিষয়টি সন্দেহ-সংশয়েরও ঊর্ধ্বে।
প্রকৃতিবাদে প্রকৃতির অধিকতর সুবিধাভোগী জীব মানুষ হলেও তা মানুষের জন্য শর্তহীন ও অবারিত নয় বরং প্রকৃতিগতভাবেই তা বিধিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। মানুষের পক্ষে কোনভাবেই স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ নেই। মানুষ যখন সৃষ্টির প্রথাগত নিয়মে নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে তখন এ বিশ্বচরাচর গতিশীল, শান্তিময় ও আনন্দঘন হয়ে ওঠে। কিন্তু যখন এর অন্যথা ঘটে তখনই তা ছন্দ হারিয়ে ফেলে, হারায় গতিশীলতা; ভারসাম্যও নষ্ট হয় এ সৃষ্টিনিচয়ের। আর এ নিয়মভঙ্গকে সভ্যতাত্তোরকালে অপরাধ বলে গণ্য করা হয়।
আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রকৃতি ও বিবেকবিরুদ্ধ কাজগুলোকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। যদিও প্রাক-সভ্যতায় বা প্রাগৈতিহাসিককালে এমনটা ছিল না। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অপরাধের সংজ্ঞায়ন এবং তা প্রতিবিধানের জন্য আইন, সংবিধান, দণ্ডবিধি, আদালত, বিচারকসহ যাবতীয় অবকাঠামোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। কিন্তু গঠনগত ত্রুটি, প্রায়োগিক জটিলতা ও নানাবিধ দুর্বলতার কারণে সভ্যতা এক্ষেত্রে পুরোপুরি সফল ও সার্থক হতে পারেনি। কারণ, মানুষের কোন কাজই নির্ভুল হওয়ার সুযোগ নেই। মানুষের পক্ষে ষড়রিপুর প্রভাবমুক্ত হওয়াও সম্ভব নয়। বস্তুত যা অতিপ্রাকৃত তা-ই নির্ভুল। তাই মানবসৃষ্ট প্রক্রিয়ায় অপরাধের প্রতিবিধান করা অনেক ক্ষেত্রেই সফল হয় না বা অপরাধের ধরন-মাত্রা অনুসারে ইহজাগতিক নিয়মে যথাযথ শাস্তিবিধানও সম্ভব নয়। কারণ, অপরাধীর অপরাধ যদি বহুমাত্রিক হয়, তাহলে তার জন্য যথাযথ শাস্তি প্রদান করাও প্রচলিত দণ্ডবিধিতে সম্ভব হয় না। আর এ প্রশ্নেই আধ্যাত্মবাদে পারলৌলিক ধারণাটা জোরালো ভিত্তি ও অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
অপরাধকে সভ্যতার অবদান বলা হলেও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এর প্রতিবিধান করতে পুরোপুরি সফল হয়নি বরং একটা ব্যর্থতা বৃত্তেই আটকা পড়ে আছে। বস্তুত অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার একটা অনাকাক্সিক্ষত ও অশুভ প্রবণতা মানবসভ্যতায় দুষ্টক্ষত সৃষ্টি করেছে। অপরাধ দমন ও প্রতিবিধানের জন্য আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেসব অনুষঙ্গ রয়েছে, নানাবিধ কারণেই তা স্বাভাবিকভাবে কার্য সম্পাদন করতে পারে না। তাই ব্যর্থতা পিছু ছাড়ছে না। সঙ্গত কারণেই প্রাণহীন ও স্থবির প্রকৃতিকে সর্বংসহা বৈশিষ্ট্যের বলে মনে করা হয়। ফলে এ বসুধাবক্ষ এখন অপরাধ ও অপরাধীদের অভয়ারণ্য হলেও প্রকৃতি কি নিরব দর্শক বা সর্বংসহা; না প্রতিশোধ গ্রহণকারী?
এ প্রশ্নই এখন মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। যদিও মানুষের চিন্তা ও বিশ্বাসগত পার্থক্যের কারণে বিষয়টি নিয়ে একক ও অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। কারণ, যারা এ প্রকৃতিকে ‘মাখলুক’ বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন তাদের বোধ-বিশ্বাসে তার একজন ‘খালিক’ বা ‘স্রষ্টা’ রয়েছে। তারা এও মনে করেন যে, সে মহান স্বত্ত্বা, পরম কারুনিক স্রষ্টা, বিশ্ববিধাতা ‘আদিল’ তথা ‘ন্যায়বিচারক’। তিনি প্রতিটি অনুপরিমাণ সৎকর্মের পুরস্কার প্রদান করেন এবং অসৎকর্মের জন্য প্রতিশোধ পরায়ণতাও তার গুণগত বৈশিষ্ট্য। তাই কর্মের পুরস্কার বা তিরস্কার প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অপরিহার্য।
বিষয়টি নিয়ে নিজ বিচার-বুদ্ধি ও বোধ-বিশ্বাস থেকে অতিপ্রাণবন্ত আলোচনা করেছেন আমার নিজ জেলার জয়পুরহাটের এক সময়ের দায়রা জজ বাবু নরেন্দ্র কুমার দাস। এক ধর্ষণ মামলার শুনানির সময় কথা প্রসঙ্গে তিনি যা বলেছিলেন, তা খুবই মর্মস্পর্শী, হৃদয়গ্রাহী ও অন্তরদৃষ্টিসম্পন্ন। হয়তো বিশ্বাসগত পার্থক্যের কারণে তার কথার সাথে সকলের পক্ষে একমত হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু বিষয়টিকে নিয়ে যদি বৃহত পরিসরে ভাবা হয় আর নিজের চিন্তার পরিধিকে বাড়ানো যায়, তাহলেই তার প্রায় কথারই যৌক্তিকতা ও প্রাসঙ্গিতা পাওয়া যাবে বলে মনে হয়। দৃশ্যত তাকে প্রকৃতিবাদী মনে হলেও তার কথা পুরোপুরি উপেক্ষা করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। সেদিনের বক্তব্যে তিনি যা বলেছেন তার সারমর্ম হচ্ছে, প্রকৃতি নির্জীব, চলৎশক্তিহীন ও সর্বংসহা মনে হলেও আসলে তা ঠিক নয় বরং প্রকৃতি নির্মম প্রতিশোধ গ্রহণকারী। প্রকৃতি কারো অনুপরিমান অপরাধও সহ্য করে না বরং সময়ের প্রয়োজনে ঠিকই বিক্ষুব্ধ ও সংক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। অপরাধ ও অপরাধীর প্রতিবিধান হয় প্রকৃতির আদালতে। তবে অন্তরদৃষ্টিসম্পন্নরাই শুধু তা উপলদ্ধি করতে পারেন। কারণ, ‘আকলমান্দ কী লিয়ে ইশারা কাফি’। আর বিষয়টি খুবই বাস্তবসম্মত।
তার ভাষায়, আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র নানাবিধ প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতার কারণেই অপরাধের প্রতিবিধান করা যায় না। পরিবারগুলো এক্ষেত্রে খুবই অসহায়। অপরাধ দমন বা নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাফল্যও আহামরি নয়। কারণ, তাদের নানাবিধ সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতা রয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে মামলা হলেও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত ও সাক্ষীর অভাবে আদালতও অপরাধীদের শাস্তি দিতে পারে না। কেউ অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে চায় না। অনেক ক্ষেত্রে সমাজের ক্ষমতাশালী, বিত্তশালী ও প্রভাবশালীদের কারণে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। অপরাধীরা অপরাধ করে পার পেয়ে নতুন উদ্যোমে অপরাধ প্রবণতা চালিয়ে যায়। ভাবে তাদেরকে ধরার মত শক্তি আর কারো নেই; তারাই এ বিশ্বজগতের নিয়ন্ত্রক ও প্রতিপালক। ক্ষেত্র বিশেষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও হীন স্বার্থে নিরপেক্ষভাবে কাজ করে না। কিন্তু অপরাধী কখনো প্রকৃতির রূঢ়তা ও নির্মম প্রতিশোধ থেকে বাঁচতে পারে না। অত্যাচারিত ও অধিকার বঞ্চিত মানুষের আহাজারী-আর্তনাদের বহ্নিশিখায় ভস্মীভূত হয় অপরাধীর তখতে তাউস। এক অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতায় প্রকৃতিগতভাবেই অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত হয়। অপঘাত-অপমৃত্যু, দীর্ঘ যন্ত্রণাদায়ক ও দুরারোগ্য রোগভোগ, দুর্ঘটনা, পারিবারিক ও সামাজিক কলহবিবাদ, গণমানুষের রুদ্ররোষ, রাষ্ট্রাচারের বিচ্যুতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী এবং জীবনে চলার পথে নানাবিধ প্রতিকূলতায় অপরাধীরা শাস্তি পায়। আর এ শাস্তি হয় মানুষের কল্পনারও অতীত।
তিনি মনে করেন, দোর্দণ্ড প্রতাপশালী নৃপতি যারা নিজেদেরকে স্রষ্টাতূল্য মনে করতেন এবং সাধারণ মানুষ সহ প্রতিপক্ষদের চালাতেন নির্মম ও নিষ্ঠুর নির্যাতন, তাদেরকেও প্রকৃতির অমোঘ বিধানে করুণ পরিণতিই বরণ করতে হয়েছে। তাদের ইহজাগতিক জীবনও স্বস্তিদায়ক হয়নি বা হওয়ার কোন সুযোগও নেই। পৃথিবীতে যারাই দম্ভভরে চলেছে, ক্ষমতার অহংকারে ধরাকে সরা জ্ঞান করে নানাবিধ অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে, সমাজে খুনখারাবী, মানুষের অধিকারহরণ, বিশ্বাসভঙ্গ, সীমালঙ্ঘন, নিপীড়ন, লাগামহীন অপরাধ করেছে এবং মানুষের জানমাল, ইজ্জত সম্ভ্রম নিয়ে বাল্যখিল্যতায় লিপ্ত হয়েছে; তাদের পরিণতি মোটেই সুখকর হয়নি; প্রকৃতি তাদেরকে ছেড়ে কথা বলেনি। ইতিহাসও তাদেরকে আস্তকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত করেছে। অন্তরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ তা ঠিকই উপলব্ধি করতে পারে।
নরেন্দ্র বাবু যত গভীরভাবে মানুষের জীবন, সমাজ, রাষ্ট্রাচার, অপরাধ ও অপরাধ প্রবণতা এবং প্রকৃতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে ভেবেছেন তা হয়তো কম লোকই ভেবে থাকবেন। তিনি সবকিছুই প্রত্যক্ষ করেছেন অন্তরদৃষ্টি দিয়ে। কিন্তু তার এ বক্তব্য চক্ষুষ্মান মানুষের অন্তরদৃষ্টি খুলে দিতে সহায়ক হয়েছে বলে মনে করার যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যায় না। আমাদের চারপাশে অনেক অপরাধীর সন্ধান পাওয়া যায়। যারা অপরাধ, বিশ্বাসঘাতকতা, সীমালঙ্ঘন ও মানুষের অধিকারহরণকেই জীবনের অনুষঙ্গ বানিয়ে নিয়েছে। এরা কখনো জাগতিক বিচারের মুখোমুখি হয়নি বা হলেও প্রচলিত আইন, বিচার ও রাষ্ট্রাচার তাদের কেশাগ্র পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারেনি। কিন্তু এসব অপরাধীদের কেউই প্রকৃতির নির্মম ও নিষ্ঠুর প্রতিশোধ থেকে পরিত্রাণ পায়নি বরং এক লজ্জাজনক পরিণতিই ভোগ করতে হয়েছে তাদেরকে। আমরা চারপাশে তাকালে দেখতে পাই, যারাই মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ও মানুষের অধিকার হরণ করেছে জাগতিকভাবে তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি না করা গেলেও প্রকৃতির নির্মমতা তারা প্রায় ক্ষেত্রেই উপেক্ষা করতে পারে নি। আমার নিজ এলাকায় ‘কোব্বাদ মুন্সী’ নামে এক কুখ্যাত খুনীকে আমরা দেখেছি। মানুষ খুনই তার পেশা ও নেশা ছিল। কত মানুষ যে খুন করেছে তার হিসেব সে নিজেই দিতে পারতো না। কেউ কোন দিন ভাবতেই পারতো না যে এই খুনীর কখনো পতন হবে। কিন্তু তার শেষ পরিণাম হয়েছিল খুবই ভয়াবহ। যা কেউ কোনদিন কল্পনাও করেনি। বিক্ষুদ্ধ জনতার রুদ্ররোষ ও গণপিটুনীতে মৃত্যুর পর তার লাশেরই কোন অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায়নি। শুধু কোব্বাদ মুন্সী নয় বরং ডাকাত রুস্তম ও ইসা সহ তাদের অপর সহযোগিদের অবস্থা হয়েছিল আরও ভয়াবহ। তাদের এ দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির জন্য মানুষকে স্রষ্টা বা আল্লাহর বিচার বলতে শোনা গেছে। নরেন্দ্র বাবু বোধহয় তার উপলব্ধিমত এটিকেই প্রকৃতির বিচার বলতে চেয়েছেন। যা খুবই যৌক্তিক।
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব শহীদ সিরাজদ্দৌলা একান্ত ঘনিষ্ঠ লোকদের দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছিলেন। নবাবের সাথে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তাদের প্রত্যেককেই নির্মম পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে বলে জানা যায়। মীর জাফর নবাব হওয়ার উচ্চাভিলাষে সিরাজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও তাকে ক্লাইভের গর্দভ হিসেবে অসম্মানজনকভাবে জীবন যাপন করতে হয়েছে। মৃত্যুর আগে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় মীর জাফর। তার শরীরে অসংখ্য ঘা ও ফোঁড়া হয়ে দূষিত রক্ত ও পুঁজ পড়ে দুর্গন্ধ হতো বলে জানা যায়। এভাবেই যন্ত্রণাদায়ক রোগভোগের মাধ্যমে করুণ মৃত্যু হয়েছিল বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের।
মীর জাফর পুত্র মীরনের বজ্রাঘাতে মৃত্যু হয়েছে জানা গেলেও জনৈক ইংরেজ সেনাপতি তাকে গুলী করে হত্যা করে করেছে বলে জনশ্রুতি বেশ জোরালো। ঘসেটি বেগমকে মীরন বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকা ডুবিয়ে হত্যা করে বলে জানা যায়। যদিও বিষয়টি নিয়ে নবাব পরিবার ভিন্নমত পোষণ করে। নবাব সিরাজের হত্যাকারী মোহাম্মদী বেগ পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে পানিতে ডুবে মারা যায়।
রায়দুর্লভ ও জগৎ শেঠকে গঙ্গায় নিক্ষেপ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। রাজা রাজবল্লভকে গলায় বালুর বস্তা বেঁধে গঙ্গা নদীতে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়। ইয়ার লতিফ নিরুদ্দেশ হয়। উমিচাঁদ প্রতিশ্রুত ২০ লাখ টাকা না পেয়ে শোকে পাগল হয়ে যায়। পরে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ক্লাইভ বাংলা লুণ্ঠনের দায়ে বিলেতে দুর্নীতি মামলায় সাত বছর জেল খেটে কপর্দকহীন হয়ে পড়ে। পরে এ অবস্থায় টেমস নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। হলওয়েলের স্ত্রী তাকে রেখে অন্য যুবকের সাথে চলে গেলে সে আত্মহত্যা করে। এ ছিল পলাশীর ষড়যন্ত্রকারীদের নির্মম পরিণতি। দুনিয়ার কোন আদালতে তাদেরকে মুখোমুখী না হতে হলেও প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ থেকে রেহাই পায়নি।
একথা শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ এমন নয় বরং কোন জাতিরাষ্ট্রে যখন অবক্ষয়, মূল্যবোধের বিচ্যুতি ও অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে তখন স্বাভাবিক নিয়মেই সে জাতির পতনও অনিবার্য হয়ে ওঠে। আর এসব ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠী দায়ি হলেও শাসিতরা এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে না। কথায় আছে ‘রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট প্রজা কষ্ট পায়’। একথা অনস্বীকার্য যে, রোম সাম্রাজ্য ছিল পৃথিবীর এক মহাবিস্ময় ! ইউরোপ, আফ্রিকা ছাপিয়ে এর বিস্তৃতি ছিল এশিয়া পর্যন্ত। বিশাল এ সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল ৪৭৬ সালে। দুর্নীতিবাজ, অপরাধপ্রবণ, মূল্যবোধহীন ও অদক্ষ শাসকরাই রোমের পতন ডেকে এনেছিল।
যাদের স্বেচ্ছাচারীতা ও অনাচার সাধারণ মানুষকে বেশ ভুগিয়েছে। ফলে গণঅসন্তষ্টি থেকে সৃষ্ট গৃহযুদ্ধের কারণেই রোম সম্রাজ্যের পতন হয়েছিল। যুদ্ধের ২০ বছরে ৭৫ জন সম্রাটের ক্ষমতার দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন। এ থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় রোম সাম্রাজ্যে শেষ সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা কত চরমে গিয়ে ঠেকেছিল। অন্যদিকে শাসকদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘প্যারাটোরিয়ান গার্ড’ নামে সম্রাটের ব্যক্তিগত দেহরক্ষীরা। তারা ইচ্ছামত সম্রাটকে খুন করতো এবং যাকে ইচ্ছা তাকে ক্ষমতায় বসাতো। অথচ এদের দায়িত্ব ছিল সম্রাটদের নিরাপত্তা বিধান করা। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত অবক্ষয় এসব শাসকদেরকে নির্মম বাস্তবতা থেকে রক্ষা করতে পারেনি।
১৭৮৯ সালে ফরাসি স্বৈরশাসক রাজা ষোড়শ লুই-এর নির্যাতন কেন্দ্র বাস্তিল দুর্গের পতন হয়েছিল। এর মধ্য দিয়েই ঐতিহাসিক ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল। এ বিপ্লবের আগে রাজত্বের ৯৫ শতাংশ সম্পত্তির মালিক ছিল মাত্র ৫ ভাগ মানুষ। অথচ এরা কখনো আয়কর দিতো না। যারা আয়কর দিতো তাদের কোনো সুযোগ-সুবিধাও দেয়া হতো না। এ অসম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে বাস্তিল দুর্গে বন্দি করে নির্যাতন করা হতো। এখানে কেউ একবার বন্দী হলে তার জীবন নিয়ে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকতো না। নিপীড়ন সইতে সইতে একসময় মানুষ স্বাভাবিকভাবেই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সংক্ষুব্ধ জনতা রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়ার দাবি করলেও স্বৈরশাসকরা তা মানেনি। তখনই জনতার উত্তাল তরঙ্গ বাস্তিল দুর্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এসময় শাসকগোষ্ঠী সামরিক শক্তি কামানসহ অস্ত্র-গোলাবারুদ ব্যবহার করে জনতার বিরুদ্ধে। কিন্তু এতে কোন লাভ হয়নি। শেষ রক্ষাও হয়নি স্বৈরাচারি ও ফ্যাসীবাদী শাসকগোষ্ঠীর। এক অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতার অংশ হিসেবেই বাস্তিল দুর্গের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠেছিল। কথায় আছে, ‘লেখার কিল ভূতেই কিলায়’। আর বাস্তিল দুর্গের পতন সে মহাসত্যের দিকেই অঙ্গলী নির্দেশ করে।
ক্ষমতার দম্ভে যেসব নৃপতিরা সাধারণ মানুষের উপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হয়েছে, তাদেরকে অনেক ক্ষেত্রেই বিচারের আওতায় আনা না গেলেও প্রকৃতির বিচার থেকে তারা কেউই রক্ষা পায়নি। পৃথিবীর তাবৎ স্বৈরশাসকদের দিকে তাকালে আমাদের সামনে সে চিত্রই ভেসে ওঠে। এ্যাডলফ হিটলার, নিকোলাই চসেস্কু, বেনিতো মুসোলিনি, নেপোলিয়ন, হোসনী মোবারক, সাদ্দাস হোসেন, মুয়াম্মার গাদ্দাফী ও রবার্ট মুগাবে সহ ইতিহাসের স্বৈরাচাররা এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। প্রকৃতিবাদীরা এসব ঘটনাকে প্রকৃতির নির্মম বিচার বা প্রতিশোধ বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। যদিও এক্ষেত্রে আধ্যাত্মবাদের ব্যাখ্যা ভিন্ন মাত্রার।
একথা কারো অজানা নয় যে, বিগত প্রায় ১৬ বছরের আওয়ামী ফ্যাসীবাদী শাসনামলে আমাদের দেশে অপরাধ ও অপরাধপ্রবণতা প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলো। মাফিয়াতন্ত্রীরা রাষ্ট্রীয় সকল অবকাঠামোকে ধ্বংস করে দিয়ে দেশে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলো। পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছিলো দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। একই সাথে দলীয়করণ করা হয়েছিলো দেশের জনপ্রশাসন, বিচারবিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও শিক্ষা প্রশাসন সহ রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানকে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন ব্যুরোকে পরিণত করা হয়েছিলো দলদাস আজ্ঞাবাহী প্রতিষ্ঠানে। সঙ্গত কারণেই আওয়ামী শাসনামলে যতগুলো নির্বাচন হয়েছিলো সবই ছিলো কথিত নির্বাচনের নামে ইতিহাসের নির্মম প্রহসন। ফলে দেশ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভয়ারণ্যে পরিণত করা হয়েছিলো। মাফিয়াতন্ত্রীরা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে মোকাবেলা না করে চরম জুলুম ও নিগ্রহের পথ বেছে নিয়েছিলো। কথিত বিচারের নামে প্রহসন করে জাতীয় নেতা নির্মমভাবে হত্যা করে দেশকে রীতিমত বধ্যভূমিতে পরিণত করা হয়েছিলো। ভিন্নমত দমনে হামলা, মামলা, গণগ্রেফতার, কথিত রিমান্ডের নামে নির্মম নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুপ্তহত্যা ও গুম ছিলো নিত্য দিনের সঙ্গী। মূলত, আওয়ামী নৈরাজ্যবাদীরা পুরো দেশকে আতঙ্কের জনপদে পরিণত করে নিজেদের অবৈধ ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার অপচেষ্টা চালিয়েছিলো।
আওয়ামী লীগের এসব রাষ্ট্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে জনগণ রাজপথে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলো। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহার ও দলীয় পশুশক্তিকে জনগণের ওপর লেলিয়ে দেওয়ার কারণেই সেসব আন্দোলন সফল হয়নি বরং সবগুলোই নির্মমভাবে দমন করা হয়েছে। ক্ষমতা তাদেরকে এমন অহংবোধী ও বলদর্পী করে তুলেছিলো যে, তাদেরকে কখনো ক্ষমতা হারাতে হবে তা তারা কখনোই ভাবতে পারেনি। কিন্তু প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ থেকে তারা কোন ভাবেই রেহাই পায়নি বরং তাদেরকে ইতিহাসের আস্তাকূঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে হয়েছে।
এক অনিবার্য বাস্তবতায় গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী-বাকশালী রেজিমের লজ্জাজনক পতন হয়েছে। দলের শীর্ষনেতা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার-চেয়ারম্যান সহ মহল্লার ইচকে নেতা, ফিসকে নেতা এবং পাতি নেতারাও পালিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন বা দেশেই আত্মগোপনে রয়েছেন। এমনকি জাতীয় মসজিদ বাইতুল মোকাররমের খতিবের নাকি কোন খোঁজ-খবর নেই। তাই বিষয়টি প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ ও কর্মফল হিসাবেই বিবেচনা করা হচ্ছে। আধাত্মবাদীরা বিষয়টিকে ‘স্রষ্টার রুদ্ররোষ’ বা ‘আল্লাহর গজব’ হিসাবে চিহ্নিত করছেন। যা নরেন্দ্র বাবুর কথার প্রতিধ্বনী বলা যায়!