সম্প্রতি থাইল্যান্ডে শেষ হয়েছে বে অফ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল টেকনিকাল এন্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন (‘বঙ্গোপসাগরীয় বহুখাতীয় কারিগরি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা উদ্যোগ’)-বিম্সটেক-এর বার্ষিক সম্মেলন। এ সম্মেলনে বাংলাদেশ মোটাদাগে বেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছে। প্রথমত সেখানে এ বছর বাংলাদেশ এ সংস্থার সভাপতির দায়িত্ব লাভ করেছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস হয়ে ওঠেন সম্মেলনের মধ্যমনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে প্রধান উপদেষ্টার অনেক দিনের প্রত্যাশিত সাক্ষাৎটি ঘটে এ সম্মেলনের সাইড লাইনে। সেখানে কথাবার্তা যাই হোক না কেন দু’দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রথম উদ্যোগ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
বিমসটেক হলো বঙ্গোপসাগরের উপর নির্ভরশীল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশকে নিয়ে গঠিত একটি আঞ্চলিক জোট। ১৯৯৭ সালে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সদরদপ্তর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত। ২০২৫-এর ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলন ব্যাংকক, থাইল্যান্ড এ হয়ে গেল। সেখান থেকে দু’বছরের জন্য সংস্থাটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছে বাংলাদেশ। সম্মেলনে অংশ নেন বঙ্গোপসাগরের চারপাশের দেশগুলোর সরকার প্রধানগণ।
একটু পেছন ফিরে দেখা যাক। ১৯৯৭ সালের ৬ জুন, ব্যাংককে- বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের একটি বৈঠকে একটি নতুন আন্তঃআঞ্চলিক জোট সৃষ্টি করা হয় এবং সভায় অংশগ্রহণকারী মূল আলোচকদের দেশের নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী এই জোটের নাম দেয়া হয়- BIST-EC (Bangladesh, India, Sri Lanka & Thailand Economic Co-.operation)|। প্রসঙ্গত, মিয়ানমার এ প্রারম্ভিক সভায় পর্যবেক্ষক হিসেবে অংশ নেয়। পরবর্তীতে, ২২ ডিসেম্বর, ১৯৯৭ সালের প্রথম মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে মিয়ানমারকে পূর্ণ সদস্য হিসেব গ্রহণ করা হয়। মিয়ানমারের সদস্য হিসেবে যোগদানের পর সংগঠনের নামটি কিছুটা পরিবর্তন করে BIMST-EC করা হয়। ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মন্ত্রী পর্যায়ের ২য় বৈঠকে নেপালকে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দেয়া হয়। পরবর্তীতে, ২০০৩ সালে নেপাল ও ভুটানকে সংগঠনটির পূর্ণ সদস্যের পদ প্রদান করা হয়।
কী হলো এবারের সম্মেলনে? ৫ এপ্রিল বিমসটেকের প্রধান অফিস এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বিমসটেকের সদস্য রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের অংশগ্রহণে ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলন ৪ এপ্রিল থাইল্যান্ডের ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে, ২ এপ্রিল ২৫তম বিমসটেক ঊর্ধ্বতন সভা এবং ৩ এপ্রিল ২০তম বিমসটেক মন্ত্রিপর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়। ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের মূল ফলাফলগুলোর মধ্যে রয়েছে, ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণাপত্র গ্রহণ, যা নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভবিষ্যতের সহযোগিতার জন্য তাদের সিদ্ধান্ত এবং নির্দেশনা প্রতিফলিত করে। বিমসটেকের প্রথম ভিশন ডকুমেন্ট, ব্যাংকক ভিশন ২০৩০ গৃহীত হয়েছে, যা সমৃদ্ধ, সহিঞ্চুতা এবং উন্মুক্ত বিমসটেকের দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ভবিষ্যৎ সহযোগিতার জন্য একটি বিস্তৃত এবং বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ প্রদান করে। সামুদ্রিক পরিবহন সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। সামুদ্রিক সংযোগ বৃদ্ধির জন্য আঞ্চলিক অংশীদারিত্ব জোরদার করার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা সদস্য দেশগুলোর মধ্যে আরও বাণিজ্য এবং ভ্রমণ সক্ষম করবে। বিমসটেক এবং ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনের (আইওআরএ) মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর, যা আইওআরএ এবং বিমসটেকের মধ্যে ভবিষ্যৎ অংশীদারিত্বকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়।
বিমসটেক এবং জাতিসংঘের মাদক অপরাধ নিয়ন্ত্রক অফিসের (ইউএনওডিসি) মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর, যা ইউএনওডিসি এবং বিমসটেকের মধ্যে অংশীদারিত্বকে ভাগাভাগি করবে। বিমসটেক মেকানিজমের জন্য কার্যপ্রণালী গৃহীত। বিমসটেক সনদের সঙ্গে কার্যপ্রণালীর নিয়মাবলী, বিমসটেকের অধীনে আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করে, যা বৃহত্তর দক্ষতা এবং ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে। বিমসটেকের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা সম্পর্কিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের গোষ্ঠীর প্রতিবেদন গ্রহণ, যাতে বিমসটেককে সংস্কার ও পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বেশ কয়েকটি সুপারিশ রয়েছে।
দেখা যাচ্ছে সম্মেলনের সাফল্যের ভাগ কম নয়। এ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং টোবগে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী জেনারেল মিন অং হ্লাইং, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ড. হারিনী আমারাসুরিয়া এবং থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেটাংটার্ন সিনাওয়াত্রা। বিমসটেক নেতারা শীর্ষ সম্মেলনে তাদের বিবৃতিতে বিমসটেকের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আঞ্চলিক সহযোগিতার অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত এবং সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব এবং উদ্যোগ উপস্থাপন করেছেন। তারা আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, সংযোগ, পর্যটন, সংস্কৃতি বিনিময়, জলবায়ু কর্মকাণ্ড, সবুজ ও নবায়নযোগ্য শক্তি, টেকসই কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তা বাড়াতে অগ্রগতি অর্জনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিমসটেক সহযোগিতাকে এগিয়ে নিতে অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করার জন্য বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
এ বৈঠকের সূত্র ধরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার এক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বলা বাহুল্য, বিমসটেক সম্মেলনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল ইউনূস-মোদির বৈঠক। বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়েছেন। সেইসাথে সীমান্ত হত্যা কমিয়ে আনা, গঙ্গা-তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় ন্যায্যতা নিশ্চিত করাসহ অনেকগুলো অমীমাংসিত ইস্যু আলোচনা হয়েছে বৈঠকে। ১০ বছর আগের পুরনো ছবি উপহার দিয়ে পুরনো বন্ধুত্ব মনে করিয়ে দিয়েছেন নোবেল বিজয়ী ইউনূস। মোদি বৈঠকে বসবেন কি বসবেন না এটা নিয়ে দোলাচল ছিল। কিন্তু শেষে তা কেটে গিয়ে এটা বাস্তব রূপ লাভ করে।
বাসস জানাচ্ছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিমসটেকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করায় অধ্যাপক ইউনূসকে অভিনন্দন জানান এবং ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা জানান। নরেন্দ্র মোদী বলেন, ভারত সবসময় বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। তিনি উল্লেখ করেন, দু প্রতিবেশী দেশের ইতিহাস বাংলাদেশ সৃষ্টির সময় থেকেই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। প্রধানমন্ত্রী মোদী অধ্যাপক ইউনূসের আন্তর্জাতিক মর্যাদার কথা স্মরণ করে বলেন, ভারত সর্বদা একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের পক্ষে থাকবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ভারত বাংলাদেশে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না। প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, ‘আমাদের সম্পর্ক জনগণের সঙ্গে। দেখা যাচ্ছে সম্পর্কের পারদ গলতে শুরু করেছে। এটা সফল পরিণতি পেলে দু’দেশের জন্যই মঙ্গল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, বিমসটেক থেকে মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে প্রায় দু লাখ রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেয়ার ঘোষণা একটি মাইলফলক অর্জন ড. ইউনূসের। এর আগে রাজনৈতিক সরকারগুলোর পক্ষ থেকে বহু চেষ্টা করেও যে কাজটি করতে পারেনি; ড. ইউনূসের কূটনৈতিক দক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক ইমেজ এই সাফল্য এনে দিয়েছে বাংলাদেশকে। তদুপরি, বাকী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার তৎপরতাও অব্যাহত থাকছে বলে জানানো হয়েছে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে।
মিয়ানমার স্বল্প সংখ্যক রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতে চেয়েছে। বিশ্লেষকরা এটাকে ভাল এবং খারাপ দুটোই মনে করেন। তারা বলছেন, মাত্র দু’লাখের মতো ফিরিয়ে নিলে বাকি ৯ থেকে ১০ লাখ কোথায় যাবে? আর ভাল দিক হলো প্রথম তারা বড় একটি সংখ্যার মানুষকে ফিরিয়ে নিতে চাইছে। এটাকে ধরে অগ্রসর হওয়ার একটি পথ সৃষ্টি হয়েছে।
বিমসটেক মহাসচিব ইন্দ্র মণি পান্ডে তার প্রতিবেদনে, ২০২২ সালের মার্চে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত ৫ম বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের পর থেকে প্রাপ্ত অগ্রগতি তুলে ধরেন। তিনি এ অঞ্চলের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য বিমসটেক এজেন্ডাকে আরও এগিয়ে নেওয়ার জন্য তাদের নির্দেশনা চেয়েছেন। বিমসটেকের অধীনে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করার জন্য সদস্য দেশগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্য সচিবালয়ের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। শীর্ষ সম্মেলন শেষে বিমসটেকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বাংলাদেশ বিমসটেকের সভাপতিত্ব গ্রহণ করে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিমসটেক সহযোগিতাকে এগিয়ে নিতে অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করার জন্য বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আর এভাবেই শেষ হয়েছে এ সম্মেলন।
কথা হচ্ছে, এর পর কী হবে? নেতারা যে কথার ফুলঝুরি ফুটিয়েছেন তা কি তারা মনে রাখবেন বা মেনে চলবেন? বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ ধরনের সম্মেলনে যে ধারণা দেয়া হয় যা বলা হয়, অনেক সময় পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট আলোচনায় সেগুলো হারিয়ে যায়। তখন লাভালাভের প্রশ্ন সব কিছু গুলিয়ে দেয়। এর পরও আশাবাদ নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে। নেতাদের কথাকে সূত্র ধরে সংশ্লিষ্ট দেশের কূটনীতিকরা এর মাঝ থেকেই সম্পর্কের সূত্রটি দৃঢ় করার চেষ্টা করতে পারেন। তাতে সমস্যাগুলো লাঘব হতে পারে।