হিজাব মুসলিম নারীদের জন্য একটি অত্যাবশ্যকীয় তথা ফরজ বিধান। হিজাবের মাধ্যমে মাথা সহ নারীদেহ আবৃত করা হয়। যা বয়ঃসন্ধিকাল থেকে মুসলিম নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক। মূলত, স্বাভাবিকভাবে শালীনতাবোধ, গোপনীয়তা এবং নৈতিকতার প্রতীক হিসেবে রক্ষণশীল মুসলিম নারীরা হিজাব ব্যবহার করেন। বিশ্বকোষ অনুযায়ী, পবিত্র কুরআনে পুরুষ এবং নারী উভয়ের চোখে পড়া, চালচলন, পোশাক এবং শালীনতাবোধে গুরত্ব দেয়া হয়েছে। আল কুরআন মুসলিম নারীদের শালীনতাবোধের সাথে পোশাক পরিধান করতে এবং তাদের দেহের মাথাসহ দেশের উপরিভাগ ও সুরক্ষিত রাখতে নির্দেশনা দিয়েছে। আর ‘জিলবাব’ হলো এমন বোরকা বা প্রশস্ত চাদর, যা গোটা দেহকে আচ্ছাদিত করে। সুতরাং আল্লাহ তা’আলা তাঁর নবীকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তিনি তার স্ত্রী, কন্যা ও মুমিন নারীগণকে বলে দেন, তারা যেন তাদের চাদরের কিছু অংশ নিজেদের উপর টেনে দেন, যাতে তাদের চেহারা ও দেহের উপরিভাগ ভালোভাবে আবৃত থাকে।
হিজাব নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র নতুন কিছু নয়। তথাকথিত প্রগতিবাদীরা ‘দেহ আমার সিদ্ধান্তও আমার’ এমন চটকদার স্লোগান দিলেও তা বোধহয় শুধু বিবস্ত্র থাকা বা গণিকাবৃত্তির পক্ষে সাফাইয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। নিজেদের পছন্দমত শালীন পোশাক পরার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে মনে করা হয় না। বস্তুত, এটিই হচ্ছে তথাকথিত প্রগতিবাদীদের দ্বিচারিতা। অশ্লীল পোশাক বা একেবারে নগ্ন থাকাকে ব্যক্তির স্বাধীনতা বলে দাবি করা হলেও ব্যক্তির পছন্দের শালীন পোশাককে অধিকার বলে স্বীকার করা হয় না বরং এটিকে তথাকথিত প্রগতি ও সভ্যতা বিরোধী মনে করা হয়। প্রকৃত পক্ষে তাদের এমন নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীই মানবসভ্যতা ও প্রগতির অন্তরায়।
হিজাব বা নিজের পছন্দমত শালীন পোশাক ব্যবহার করা নারীদের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার হলেও বিষয়টি নিয়ে একশ্রেণির তথাকথিত প্রগতিবাদীরা সব সময় নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী প্রদর্শন করে আসছে। তারা বিষয়টি নিয়ে সারাবছরই আলোচনায় থাকার চেষ্টা করেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নারীদের বিবস্ত্র বা অর্ধনগ্ন না করতে পারলে তাদের কোন শান্তি নেই। সম্প্রতি তেমনি একটি বিতর্কিত ঘটনার অবতারণা করেছে কানাডিয়ান বিমান সংস্থা। প্রাপ্ততথ্য মতে, কানাডার টরন্টো পিয়ারসন বিমানবন্দরে মুসলিম নারীকে হিজাব খুলতে বাধ্য করায় সমালোচনার মুখে পড়েছে কানাডিয়ান বিমান সংস্থা। উইনিপেগগামী ফ্লাইট ঋ-৮৬৪১-এ ওঠার আগে একজন মুসলিম নারীকে তাঁর হিজাব খুলতে বাধ্য করা হয়, যা তাঁকে অপমানিত করেছে এবং তাঁর ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই নারীর মেয়ে আফসারা রাইদাহ সোশ্যাল মিডিয়ায় এ ঘটনা শেয়ার করে লিখেছেন, ‘ফ্লেয়ার এয়ারলাইনস, তোমরা আজ আমার মায়ের অধিকার লঙ্ঘন করেছ এবং তাঁকে অপমান করেছ। আমরা চুপ করে থাকবো না।’
এটিকে তিনি ইসলামোফোবিয়া এবং তাঁর মায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন, যা কানাডার মতো একটি দেশে ঘটেছে, যেখানে বৈচিত্র্য, ধর্মীয় সম্প্রীতি, অন্তর্ভুক্তি ও মানবতাবোধ আছে বলে দাবি করা হয়। রাইদাহ জানিয়েছেন, ফ্লেয়ার এয়ারলাইনসের একজন কর্মচারী তাঁর মাকে হিজাব খুলতে জোর করেছিলেন, কারণ তাঁর পাসপোর্টের ছবি হিজাব পরা শুরু করার আগে তোলা হয়েছিল, যদিও তাঁর মুখ পুরোপুরি দৃশ্যমান ছিল। ওই নারীর স্বামী আপত্তি জানালে কর্মচারী বলেন, ‘আচ্ছা, তোমার পাসপোর্টের ছবি আপডেট করা উচিত ছিল।’ অবশ্য এ দাবি ট্রান্সপোর্ট কানাডার নিয়মের পরিপন্থী। নিয়ম অনুযায়ী মুখ দৃশ্যমান থাকলে মাথার আচ্ছাদন খোলার প্রয়োজন নেই।
অবশ্য ফ্লেয়ার এয়ারলাইনস গত ২৫ জুন, ২০২৫-এ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, জড়িত কর্মচারী তাদের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং পার্টনার অএও-এর, সরাসরি ফ্লেয়ারের নয়। ফ্লেয়ারের সিইও ম্যাকিয়েজ উইল্ক বলেছেন, ‘আমরা আশা করি, সব পরিসেবা অংশীদাররা আমাদের নিজস্ব দলের মতো সম্মান, পেশাদারী ও বৈষম্যহীনতার মান বজায় রাখবে।’ অএও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়েছে এবং ওই কর্মচারীকে ছুটিতে পাঠিয়েছে বলে জানা গেছে। ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিমস (ঘঈঈগ) ঘোষণা করেছে, তাদের আইনি দল এ বিষয়ে জড়িত। তারা বলেছে, ‘কানাডার বিমানবন্দর বা বিমান সংস্থাগুলোতে ইসলামোফোবিয়ার কোনো স্থান নেই। আমরা উদ্বিগ্ন যে, এমন একটি ঘটনা এমন একটি বিমানবন্দরে ঘটেছে, যেখানে আমরা কর্মীদের পেশাদারীর ওপর নির্ভর করি।’
আমাদের দেশ মুসলিম প্রধান দেশ হওয়ার পরও তথাকথিত গ্রগতিবাদীরা মাঝে মধ্যেই বিষয়টি নিয়ে নানাবিধ উঠকো ঝামেলার সৃষ্টি করে থাকেন। হিজাব আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিরোধী বলে প্রচার করতেই তারা পুলকবোধ করেন। এ বিষয়ে একটি চমকপ্রদ ঘটনা পাঠকদের জ্ঞাতার্থে এখন উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। উল্লেখ্য, বেশ কয়েক বছর আগে আমার নিজ জেলা জয়পুরহাটের জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সাথে সাক্ষতের জন্য গিয়েছিলাম। ভিজিটিং কার্ড পাঠিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিলো আমাকে। আরো দু’জন মহিলা এনজিও কর্মকর্তা সাক্ষাৎ প্রার্থী ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত ৩ জনকে একই সাথে সাক্ষাতের জন্য ডাকা হয়েছিলো। জেলা প্রশাসক বাবু নিতাই পদ দাস সকলের সাথে প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে’। তিনি সহাস্যে মহিলা এনজিও কর্মকর্তাদের দিকে ইঙ্গিত বললেন, ‘লেডিস ফার্স্ট’।
জেলা প্রশাসক মহোদয় এবার মহিলা এনজিও কর্মকর্তাদের আগমনের কারণ জানতে চাইলেন। জানা গেলো, তারা নারী অধিকার বিষয়ক একটি সেমিনারের আয়োজন করতে যাচ্ছেন। জেলা প্রশাসক মহোদয়কে তারা সে সেমিনারে প্রধান অতিথি করতে চান। জেলা প্রশাসক মহোদয় তাদের এ প্রস্তাব বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিলেন এবং তাদেরকে পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, ‘কোন বিশিষ্ট মহিলাকে এজন্য খোঁজ করুন’। কিন্তু এনজিও কর্মকর্তারা জেলা প্রশাসক মহোদয়কে অতিথি হওয়ার জন্য বারবার অনুরোধও পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। কিন্তু তিনি কোন ভাবেই রাজি হচ্ছিলেন না।
জেলা প্রশাসক মহোদয় এবার বলা শুরু করলেন, ‘আমাদের দেশের তথাকথিত নারীবাদীরা পুরুষকে নারীদের রীতিমত প্রতিপক্ষ বানিয়েছেন। অথচ নারী-পুরুষের মধ্যে যে সখ্যতা আর ঐশ্বরিক বন্ধন তা নারীতে-নারীতে বা পুরুষে-পুরুষে নেই। নারী-পুরুষের মধ্যে প্রীতির বন্ধন অটুট আছে বলেই, সৃষ্টির ধারাবাহিকতা রক্ষিত হচ্ছে এবং সভ্যতাও বিকাশমান। কিন্তু এক শ্রেণির মানুষ সে নারী-পুরুষকেই পরষ্পর প্রতিপক্ষ বানিয়েছে। কথিত অধিকারের নামে তারা কাছের মানুষটাকে দূরে ঠেলে দিতে কসুর করছেন না। এতে পরিবার ও সমাজজীবনে নানাবিধ অস্থিরতার সৃষ্টি হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে মূল্যবোধের সঙ্কট। যা কোনভাবেই কাম্য নয়’।
তারপরও এনজিও কর্মকর্তা জেলা প্রশাসক মহোদয়কে সে সেমিনারে প্রধান অতিথির করার প্রস্তাবের জবাবে তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘আমি তো পুরুষ মানুষ। আমাকে প্রধান অতিথি বানিয়ে সে সেমিনারে পুরুষদের দেদারছে গালাগাল ও বিষোদগার করবেন, তা আমার কাছে ভালো মনে হবে না। তার চেয়ে বরং আপনারা আমার দু’জন মহিলা এডিসির মধ্যে যেকোন একজনকে রাখতে পারেন। এতে গালাগাল দিতে সুবিধা হবে’।
এরপর জেলা প্রশাসক মহোদয় হিজাব প্রসঙ্গ তুলে বললেন, ‘আপনারা হিজাবের বিরোধীতা করেন কেন? এর মধ্যে তো আমি খারাপ কিছু দেখিনা বরং আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি হিজাব নারীদের সম্ভ্রম রক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে’। তিনি কিছুটা ক্ষোভের সাথেই বললেন, ‘জেলা প্রশাসক হিসাবে আমি প্রতি মাসেই জেলা কারাগার পরিদর্শনে যাই। কিন্তু কোন দিনই কোন হিজাবীকে ‘রেপ ভিকটিম’ হিসাবে পাইনি’। তারপর তিনি বললেন, ইরানে তো অমুসলিম নারীরাও হিজাব ব্যবহার করেন। এতে তো কোন সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। নারী অধিকারের নামে আপনারা কেন হিজাব বা শালীন পোশাকের বিরোধীতা করেন তা আমার কাছে মোটেই বোধগম্য নয়’। এসব প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেন নি মহিলা এনজিও কর্মকর্তারা।
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী হওয়ায় আমাদের সংবিধানের ২(ক) অনুচ্ছেদে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত হলেও দেশে ইসলাম ও ইষলামী মূল্যবোধ চর্চা নির্বিঘ্ন হয়নি বরং মহল বিশেষ ইসলামী সমাজ-সংস্কৃতি, তাহজিব-তামুদ্দন নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তারা ইসলামী আদর্শ চর্চাকে বিভিন্ন অপবিশেষণে বিশেষিত করে বরাবরই সংকীর্ণ স্বার্থ হাসিলে তৎপর। সে ধারাবাহিকতায় ইসলামের অপরিহার্য বিধান হিজাব বা পর্দা নিয়ে নানাবিধ ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে বেশ আগে থেকেই। বিশেষ করে বিগত আওয়ামী ফ্যাসিবাদী আমলে এমন অপতৎপরতা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গিয়েছিলো। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ বিভিন্ন স্থানে হিজাবীরা নাজেহাল ও অপদস্ত হচ্ছিলেন ব্যাপকভাবে। এমনকি হিজাব পড়ার কারণে শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থী নিগ্রহের ঘটনাও লক্ষ্য করা গেছে। আওয়ামী সরকারের পতনের পর এ প্রবণতা খানিকটা কমে আসলে ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র বন্ধ হয়নি।
আমাদের সংবিধানে প্রত্যেক নাগরিককে নিজ নিজ ধর্ম পালনে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। মূলত, ‘হিজাব’ ইসলামের অপরিহার্য তথা ফরজ বিধান। আল্লাহ তায়ালা কালামে পাকের অনেক স্থানে পর্দা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(হে নারীগণ!) তোমরা ঘরের মধ্যে অবস্থান করবে, অজ্ঞতার যুগের নারীদের মত নিজেদের প্রদর্শন করবে না। আর নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে, জাকাত আদায় করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করবে।’ (সূরা আহযাব : আয়াত ৩৩) অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূল (সা.) কে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদের, কন্যাদের এবং মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়।’ এতে স্পষ্টতই প্রমাণ হয় হিজাব বা পর্দা করা ইসলামের অপরিহার্য বিধান।
হিজাব বা পর্দা মানুষকে অশুভশক্তির প্ররোচনা ও কুপ্রবৃত্তি থেকে নিরাপদ রাখে। হিজাবীরা মানুষের কুদৃষ্টি ও ফেৎনা থেকে নিরাপত্তা লাভ করেন। নারীদের নিরাপত্তা ও পুরুষের চারিত্রিক পরিশুদ্ধতার জন্যই নারীদের ওপর হিজাব তথা পর্দার বিধান দেয়া হয়েছে। আর তা যথাযথভাবে পালন করা শুধু ধর্মীয় স্বাধীনতা নয় বরং প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। যদিও তথাকথিত নারীবাদীরা ইসলামের এ মৌলিক বিধানের সরাসরি বিরোধীতা করে আসছে। মূলত, কথিত নারী প্রগতি, নারী মুক্তি, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে হিজাববিহীন খোলামেলা চলাফেরার সমাজে অবক্ষয়কে পরিকল্পিতভাবে উস্কে দেয়া হচ্ছে। আর হিজাব তথা পর্দা আল্লাহ তায়ালা নির্ধারিত অত্যাবশ্যকীয় বিধান। সর্বোপরি একজন নারী যখন বেপর্দায় চলাফেরা করে; তা শুধু নারীর জন্যই ক্ষতিকর নয় বরং তা পুরুষের জন্যও ক্ষতিকর। বেপর্দা হয়ে চলাফেরায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে নারীর ওপর। আর তা থেকে যুবসমাজ চারিত্রিক অবক্ষয়ে জড়িয়ে পড়ে।
পর্দা শুধু মুসলিম নারীদের মধ্যে নয় বরং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ ও সংস্কৃতির অংশ। এটি সাধারণত দু’টি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। যেমন, মহিলাদের শারীরিক বিচ্ছিন্নতা এবং শরীরকে আবৃত করার প্রয়োজনীয়তা যাতে মহিলারা তাদের ত্বকের লাবণ্য রক্ষা এবং রূপ-সৌন্দর্যকে গোপন করতে পারেন। ভারতীয় উপমহাদেশে মহিলাদের চলাফেরা এবং আচরণকে সীমাবদ্ধ করতে পর্দার অভ্যাস প্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যমান ছিল এবং ইসলামের আগমনের সাথে সাথে এটি আরো ভালোভাবে সমাজে প্রচলিত হয়েছিল। ১৯ শতকে পর্দা হিন্দু অভিজাতদের মধ্যে প্রথাগত হয়ে ওঠেছিল। এখনো উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের মধ্যে পর্দা বা শালীন পোশাক ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। যা তাদের আভিজাত্যের স্মারক হিসাবে গণ্য।
আমাদের দেশ মুসলিম প্রধান হলেও সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ইসলামের অপরিহার্য বিধান পর্দা বা হিজাব নিয়ে অহেতুক বিতর্ক শুরু হয়েছে। তথাকথিত নারীবাদীরা পর্দা আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সমাজ-সংস্কৃতির অংশ নয় বলে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করে চলেছে। সে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবেই বিভিন্ন লোকালয়ে বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্দানশীন মেয়েরা নানাভাবে নাজেহাল ও লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এমতাবস্থায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত বিষয়টি আমলে নিয়ে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন।
হিজাব নিয়ে নানাবিধ বিতর্কের প্রেক্ষাপটে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে হিজাব ও বোরকা পরা নারীর সাংবিধানিক অধিকার বলে মন্তব্য করেছেন দেশের উচ্চ আদালত। এ প্রসঙ্গে আদালত বলেছেন, ‘এখানে সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকার। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা এবং রাষ্ট্র কর্তৃক সে অধিকার সমুন্নত রাখা একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব’। পতিত আওয়ামী লীগ আমলে অন্তত ১৫ জেলায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব ও বোরকা পরার কারণে হেনস্থার শিকারের ঘটনাকে উদ্ধৃত করে দেশের উচ্চ আদালতে একটি রিট মোকদ্দমা দায়ের করা হয়েছে। রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে আদালত ঘটনাসমূহ তদন্তে নির্দেশ দেন এবং ২ মাসের মধ্যে শিক্ষা সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, ধর্ম সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে তদন্ত বিষয়ক প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
রিটের প্রাথমিক শুনানিতে আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, সকল ধর্মমতের ওপর শ্রদ্ধাশীল বাংলাদেশে হিজাব-বোরকা পরা নারীর সাংবিধানিক অধিকার। পরে আদালত দেশের বিভিন্ন জেলার বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বোরকা পরায় হেনস্থার শিকার হওয়ার অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেন। বোরকা বা হিজাব পরিধান করা শিক্ষার্থীদের আদৌ হেনস্থা করা হয়েছে কি-না এবং হেনস্থা করা হয়ে থাকলে এর পেছনে কারা দায়ী এবং তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তাও তদন্তে উল্লেখ করতে বলা হয়েছে।
এর আগে বোরকা পরায় হেনস্থার শিকারের ঘটনায় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে একটি রিট মোকদ্দমা দাখিল করা হয়। রিটে দেশের কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের হিজাব পরতে বাধা দেয়া হয়-মর্মে উল্লেখ করা হয়ে। রিট পিটিশনে দেশের বিভিন্ন জেলায় অন্তত ১৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব ও বোরকা পরার কারণে শিক্ষার্থীদের হেনস্থা হওয়ার ঘটনায় প্রকাশিত সংবাদ যুক্ত করা হয়। যেসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা হেনস্থার শিকার হয়েছেন সেগুলো হচ্ছে : (১) নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার বারবারপুর উচ্চ বিদ্যালয়, (২) সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ব্রজেন্দ্রগঞ্জ আর সি উচ্চ বিদ্যালয়, (৩) সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর নাছির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, (৪) কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগ, (৫) নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার শেরে বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়, (৬) চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার জোয়ারগঞ্জ বৌদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়, (৭) চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার সাতবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়, (৮) গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, (৯) মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কালকিনি মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, (১০) নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ কাজী ফজলুল হক উইমেন্স বিশ্ববিদ্যালয়, (১১) সিরাজগঞ্জের তারাশ উপজেলার বিষম ডাঙ্গা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, (১২) ফেনীর জিয়া মহিলা কলেজ, (১৩) বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার আগৈলঝাড়া পয়সা মাধ্যমিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, (১৪) সিলেটের কিশোরী মোহন উচ্চ বিদ্যালয় এবং (১৫) চট্টগ্রামের পতেঙ্গা মাইজপাড়া মাহমুদুন্নবী উচ্চ বিদ্যালয়।
এদিকে দেশের উচ্চ আদালত হিজাব ও বোরকা পরাকে ‘নারীর সাংবিধানিক অধিকার’-মর্মে মন্তব্য করলেও দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বহু শিক্ষার্থীকে হিজাব পরার ‘অপরাধে’ হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে বা এখনো হচ্ছে। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য মতে, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ বৌদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়ে (জেবি) হিজাব নিষিদ্ধ করেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক। জানা যায় হিজাব পরিধান করে এক ছাত্রী স্কুলের শ্রেণিকক্ষে এলে ওই প্রধান শিক্ষক ছাত্রীকে হেনস্থা করেন। তাকে বেত্রাঘাতও করেন-মর্মে অভিযোগ ওঠে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী ছাত্রী ওই সময় উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবরে লিখিত অভিযোগ দেন।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, প্রতি দিনকার মতো সেদিন হিজাব পরে বিদ্যালয়ে আসে অষ্টম শ্রেণির ঐ শিক্ষার্থীসহ ৩ জন। সকাল ১১টার দিকে অ্যাসেম্বলি শেষে ক্লাস শুরুর আগে প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি বড়ুয়া তাদের ডেকে হিজাব খুলে ফেলতে বাধ্য করার চেষ্টা করেন। এ সময় অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী হিজাব খুলতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে তাকে বেত্রাঘাত করেন প্রধান শিক্ষক। এ ঘটনা মুহূর্তেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী ও শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করেন। এতে কোনো প্রতিকার না পেয়ে ওই ছাত্রীর পরিবার উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দেন।
নিকট অতীতেই আমাদের দেশে হিজাব বা পর্দা নিয়ে কোন বিতর্ক ছিল না বরং সকল শিক্ষার্থীই নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবেই পালন করেছেন। এখনো আমরা লক্ষ্য করি হিন্দু পুরুষ শিক্ষার্থীরা ইচ্ছা হলে পৈতা বা গলায় কাঠের মালা পড়তে পারে। বিবাহিত হিন্দু মেয়েদের শাখা-সিঁদুর পড়তেও কোন বাধা নেই। খ্রীষ্টান শিক্ষার্থীরা তাদের ধর্মীয় আদর্শ মতে গলায় ক্রুস ঝোলাতেও কোন ভাবেই বাধা দেয়া হয় না। আর বৌদ্ধ ধর্মপ্রাণ শিক্ষার্থীদের গেরুয়া পোশাক পড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে দেখা যায়। তারা কোন ভাবেই বাধাপ্রাপ্ত হন না। ব্যতিক্রম শুরু ইসলামী আদর্শের স্মারক ‘হিজাব’।
মূলত, একটি চিহ্নিত মহল এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আবেগ-অনুভূতি, বোধ-বিশ্বাস, তাহজীব-তমুদ্দনকে বিশেষভাবে টার্গেট করেছে। এরাই হিজাবসহ ইসলামী আদর্শের স্মারকগুলোকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। ফলে হিজাব, দাড়ি-টুপি ও ইসলামী আখলাক-সুরতকে নানাভাবে নাজেহাল করা হচ্ছে। এ অপকর্মের মাধ্যমে এ অশুভ শক্তি একদিকে ধর্ম অবমাননা করছে; অপর দিকে করছে রাষ্ট্রীয় সংবিধানের অমর্যাদা। এবিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত নিকট অতীতে ঐতিহাসিক নির্দেশনা প্রদান করলেও ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। আমরা আশা করবো বর্তমান অন্তর্ববর্তী সরকার আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক দেশের ধর্মীয় সংস্কৃতির অনুসরণ, সাংবিধানকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। অন্যথায় ইসলাম বিরোধী শক্তির অপতৎপরতা কখনোই বন্ধ হবে না।