কথায় বলে, ‘গরীবের বউ সবারই ভাবি।’ দরিদ্র পরিবারে সুন্দরী বধূ থাকলে এলাকার অনেকেই সুযোগ নিতে চায়। কারণে-অকারণে সুন্দরী গৃহবধূকে হয়রানির শিকার হতে হয়। স্বল্পোন্নত এবং দরিদ্র দেশের অবস্থাও ঠিক তেমনি। উন্নয়ন সহযোগীরা যখন কোন দরিদ্র দেশকে ঋণ দান করে অথবা অন্যকোনভাবে আর্থিক সহায়তা করে তখন তারা এমন সব শর্ত চাপিয়ে দেয় যা সংশ্লিষ্ট দেশের জন্য অমর্যাদাকর। যেহেতু দরিদ্র দেশগুলোর পক্ষে উন্নয়ন সহযোগীদের নিকট থেকে ঋণ অথবা আর্থিক সহায়তা গ্রহণের কোন বিকল্প থাকে না তাই তারা বাধ্য হয়ে এসব শর্ত মেনে নিতে সম্মত হয়। উন্নয়ন সহযোগীদের এসব শর্ত মেনে নিতে গিয়ে প্রাপ্ত ঋণের অর্থ দিয়ে উদ্দেশ্য সাধন করা সম্ভব হয় না। এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, উন্নয়ন সহযোগীরা যে ঋণ প্রদান করে তা করুণা বা দয়া নয় এটা এটা তাদের অধিকার। কারণ গৃহীত ঋণের বিপরীতে নির্দিষ্ট হারে নিয়মিত কিস্তি প্রদান করতে হয়। দরিদ্র দেশগুলো যদি ঋণ গ্রহণ না করতো তাহলে উন্নয়ন সহযোগীদের ব্যবসায় বন্ধ হয়ে যেতো। কাজেই ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা এবং ঋণ গ্রহীতা দেশের মধ্যে সম্মানজনক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা খুবই জরুরি। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। উন্নয়ন সহযোগীরা আবার সবার ক্ষেত্রে একই রকম শর্তারোপ বা আচরণ করে না। যেসব দেশ আর্থিক এবং সামরিকভাবে শক্তিশালি তাদের ক্ষেত্রে ঋণের শর্ত থাকে তুলনামূলকভাবে সহজ। কিন্তু যেসব দেশের আর্থিক সামর্থ্য কম বা সামরিকভাবে দুর্বল তাদের ক্ষেত্রে ঋণের শর্ত থাকে তুলনামূলকভাবে অনেক কঠিন। এসব কঠিন শর্ত পরিপালন করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা অধিকাংশ সময়ই সম্ভব হয় না। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নাট্য ব্যক্তিত্ব হেনরিক ইবসেন বলেছেন, ঋণগ্রস্থ ব্যক্তির স্বাধীনতা থাকে না। তার আত্মমর্যাদাও পদে পদে ক্ষুণ্ন হয়।
স্বাধীনতা অর্জনের কয়েক বছর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য উপস্থাপনকালে বাংলাদেশ কেন অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত উন্নয়ন অর্জন করতে পারছে না সে ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেন। তার এ বক্তব্য শ্রবণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন তরুণ অধ্যাপক উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, তোমরা বিভিন্ন শর্ত চাপিয়ে দাও বলেই আমাদের অর্থনেতিক উন্নয়ন পদে পদে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। মার্কিন অর্থনীতিবিদ এ বক্তব্য শ্রবণ করার পর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, যে অর্থনীতির ৮০ শতাংশই আমাদের আর্থিক সহায়তায় পরিচালিত হয় সে অর্থনীতি কি তোমাদের নাকি আমাদের? আমরা আর্থিক সহায়তা করি বলেই তোমাদের অর্থনীতি নিয়ে কথা বলি, পরামর্শ দিই। তার এ বক্তব্য শুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে অধ্যাপক আর কোন কথা না বলে বসে পড়েন। এ হচ্ছে বাস্তবতা। যে কোন দেশ উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে বৈদেশিক ঋণ ও আর্থিক সহায়তা গ্রহণ করতে পারে, এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু কোন দেশ যদি ক্রমশ ঋণগ্রস্থ দেশে পরিণত হয় তাহলে অবশ্যই তা উদ্বেগজনক। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে উন্নয়নের নামে অর্থ লোপাটের মারাত্মক প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা যায়। এসব দেশের সরকার যেহেতু নিজস্ব সূত্র থেকে অর্থায়নের মাধ্যমে উন্নয়ন কর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম হয় না তাই তারা বিদেশ থেকে ঋণ এনে উন্নয়ন কাজের ব্যয় নির্বাহ করে থাকে। বৈদেশিক সূত্র থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সুবিধা হলো এতে জবাবদিহিতার সম্ভাবনা কম থাকে। যে সরকার আমলেই ঋণ গ্রহণ করা হোক না কেন তার দায় পরবর্তীতে যারা সরকার গঠন করে তাদেরই বহন করতে হয়।
সামরিক সরকার এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কিন্তু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে গণবিরোধি ও স্বৈরাচারী স্বভাবের সরকার তাদের একটি প্রবণতা হচ্ছে তারা রাস্তা-ঘাটি তৈরিসহ এমন সব অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজে আত্ম নিয়োগ করেন যা সাধরণভাবে দৃশ্যমান এবং জনতুষ্টিমূলক। এসব কাজে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করলেও সাধারণ মানুষ তাতে ক্ষুব্ধ হয় না। বিগত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের সরকার আমলে আমরা সে বিষয়টিই প্রত্যক্ষ করেছি। উন্নয়নের বিভাজন করলে দেখা যাবে, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আমলে এই অঞ্চলে তিনটি সরকারের সময় সবচেয়ে বেশি কাজ হয়েছে অবকাঠামোগত খাতে। তার মধ্যে পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকে আইউব খানের আমলে এ অঞ্চলে যে বিস্তর অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ সম্পাদিত হয়েছে তার উদাহরণ এখনো দৃশ্যমান। পরবর্তীতে এরশাদ আমলে ৯ বছর বাংলাদেশে রাস্তা-ঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। অবকাঠামোগত খাতে সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন দর্শন ছিল,‘অতি উন্নয়ন, অতি দুর্নীতি।’ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। বিগত সরকার আমলে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থায়ন সংগ্রহের হার কমেছে। আগে যেখানে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও ছিল ১০ শতাংশের উপরে এখন তা ৭ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও’র বিবেচনায় বাংলাদেশ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় সর্ব নিম্ন দেশ। বাংলাদেশ একমাত্র শ্রীলঙ্কার উপরে অবস্থান করছে। শ্রীলঙ্কার আগেকার সরকার অপ্রয়োজনে এমন সব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে যা জাতীয় স্বার্থে কোন প্রয়োজন ছিল না। বিবেচনাহীনভাবে ঋণ গ্রহণের কারণে কয়েক বছর আগে শ্রীলঙ্কা আন্তর্জাতিকভাবে ঋণ খেলাপি দেশে পরিণত হয়।
বাংলাদেশেও এমন সব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে যা জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় তেমন গুরুত্ববাহি নয়। এসব উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য সরকার উন্নয়ন সহযোগীদের নিকট থেকে ঢালাওভাবে ঋণ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ এখনো শ্রীলঙ্কার মতো আন্তর্জাতিকভাবে ঋণ খেলাপি দেশে পরিণত হয়নি ঠিকই কিন্তু আগামীতে পরিস্থিতি কোন দিকে যায় তা বলা মুস্কিল। বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি প্রথমবারের ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার অতিক্রম করে গেছে। ২০২৩ সালের শেষের দিকে বৈদেশিক ঋণের স্থিতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৬৪ কোটি মার্কিন ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় ১১ লাখ ৭হাজার ৪০ কোটি টাকা। জনগণের মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বিদেশি ঋণ গ্রহণ করে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে সেখানে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ ব্যয় দেখানো হয়েছে। ভারতে এক কিলোমিটার ফোর লেন সড়ক নির্মাণে খরচ হয় ১৪ লাখ মার্কিন ডলার, পাকিস্তানে ২৯ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার, ফিলিপাইনে ১১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার, চীনে ২৯ লাখ মার্কিন ডলার। আর বাংলাদেশে একই মাত্রার ফোর লেন রাস্তা নির্মাণ করতে ব্যয় হয় ৬৩ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার।
উচ্চ ব্যয়ে নির্মিত উন্নয়ন প্রকল্প থেকে জাতি কাক্সিক্ষত মাত্রায় সুফল পাচ্ছে না। কিন্তু ঢালাওভাবে ঋণ গ্রহণের ফলে বাংলাদেশ ক্রমশ ঋণ নির্ভর একটি দেশে পরিণত হতে চলেছে। আগে গৃহীত ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় হয়েছে। এখন বাংলাদেশকে প্রতি বছরই বর্ধিত হারে বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল বাবদ কিস্তি হিসেবে ১২৯ কোটি মার্কিন ডলার পরিশোধ করেছিল। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে এসে বিদেশি ঋণের কিস্তি বাবদ বাংলাদেশকে ৩২৮ কোটি মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে। আগামীতে যদি আর কোন বিদেশি ঋণ গ্রহণ করা না হয় তাহলেও ২০২৯-২০৩০ অর্থবছরে বাংলাদেশকে ৫১৫ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হবে কিস্তি পরিশোধ বাবদ।
বাংলাদেশ ক্রমশ বিদেশি ঋণ নির্ভর হয়ে পড়ছে। উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশকে ক্রমশ ঋণজালে আবদ্ধ করে ফেলছে। বাংলাদেশকে ঋণদানকারী সংস্থার মধ্যে বিশ্বব্যাংক এবং ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) উল্লেখযোগ্য। এ দু’টি সংস্থাই সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় নিবেদিত। বিশেষ করে আইএমএফ এমনভাবে ঋণের শর্ত নির্ধারণ করে যা অধিকাংশ সময়ই ঋণ গ্রহীতা দেশের উন্নয়নের জন্য সহায়ক হয় না। উন্নত দেশের জন্য তারা এক ধরনের শর্তারোপ করে আবার উন্নয়নশীল বা দরিদ্র দেশের জন্য সংস্থাটির শর্ত অন্য রকম হয়ে থাকে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আইএমএফ কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহারের কথা বললেও উন্নত দেশগুলোকে তারা এ ধরনের কোন শর্তারোপ করে না। কোন দেশ যদি রপ্তানি পণ্যের উপর উচ্চ হারে শুল্কারোপ করে তাহলে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো তাতে তীব্র আপত্তি করে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন বিভিন্ন দেশের রপ্তানি পণ্যের উপর বর্ধিত হারে অতিরিক্ত শুল্কারোপ করলো তখন এসব সংস্থা নিশ্চুপ হয়ে ছিল। আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক মুক্তবাজার অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমর্থক। কোন দেশ যদি মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণ না করে তাহলে এ দু’টি সংস্থা তাকে ঋণ প্রদানে আগ্রহী হয় না। তারা চায় পণ্যের অবাধ চলাচলের নিশ্চয়তা। কিন্তু উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে তারা অবাধ সুযোগ নিশ্চিত করতে কোনভাবেই রাজি নয়। মুক্তবাজার অর্থনীতি আসলে উন্নত দেশের পণ্য অবাধে দরিদ্র দেশে প্রবেশাধিকার দেয় মাত্র। আইএমএফ ঋণ গ্রহণকারী দেশের উপর কেমন শর্ত চাপিয়ে দেয় তার একটি দৃষ্টান্ত তারা স্থাপন করেছে সম্প্রতি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে।
বিগত সরকারের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০২৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) বাংলাদেশের অনুকূলে ৪শ’ ৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছিল। বাংলাদেশ মূল ঋণ আবেদনের ৪শ’ ৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ চাইলেও সংস্থাটি ২০ কোটি মার্কিন ডলার বেশি ঋণ মঞ্জুর করে। অনুমোদিত ঋণের অর্থ তিন বছরে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের অনুকূলে ছাড়করণের কথা। ঋণের আর মাত্র দু’টি কিস্তি ছাড়করণ বাকি রয়েছে। এর মধ্যে আইএমএফ শর্ত দিয়েছে, ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের নিকট থেকে সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৮শ’ ৪৪ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ গ্রহণ করতে পারবে। আইএমএফ ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণের সীমাও নির্ধারণ করে দিয়েছে। তারা বলেছে, বাংলাদেশ চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে সর্বোচ্চ ১শ’ ৯১ কোটি মার্কিন ডলার,ছয় মাস শেষে ৩শ’ ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার, নয় মাস শেষে ৪শ’৩৪ কোটি মার্কিন ডলার এবং পুরো অর্থ বছরে মোট ৮শ’৪৪ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ গ্রহণ করতে পারবে। সংস্থাটির সঙ্গে স্বাক্ষরিত মূল ঋণ চুক্তিতে এ ধরনের কোন শর্ত ছিল না। তৎকালিন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তাফা কামাল আইএমএফ’র ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর বলেছিলেন, বাংলাদেশ যেভাবে চেয়েছে সংস্থাটি ঠিক সেভাবেই ঋণ অনুমোদন দিয়েছে।
তার এ বক্তব্য মোটেও সত্যি ছিল না। কারণ আইএমএফ এমন একটি সংস্থা যারা শর্ত বিহীন কোন ঋণ প্রদান করে না। আইএমএফ যেভাবে ঋণ ছাড়করণ করেছে তা খুব একটা স্বস্তিদায়ক ছিল না। তাই প্রথম থেকেই স্থানীয় অর্থনীতিবিদদের অনেকেই এ ধরনের ঋণ গ্রহণের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু সেই সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ তলানিতে নেমে গিয়েছিল। এছাড়া সরকারের গৃহীত বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন ছিল। তাই আইএমএফ’র নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছিল। বিগত সরকার আমলে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে বাংলাদেশের গৃহীত বৈদেশিক ঋণের মোট স্থিতি ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার অতিক্রম করে গেছে। বাংলাদেশ কার্যত বৈদেশিক ঋণ নির্ভর একটি দেশে পরিণত হয়েছে। আর কয়েক বছর পর বাংলাদেশকে নতুন করে ঋণ গ্রহণপূর্বক আগের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। আইএমএফ বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের যে সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে তা অত্যন্ত অমর্যাদাকর। তাই এই শর্ত প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে। আইএমএফ এমনই এক আন্তর্জাতিক সংস্থা যারা কেন দেশকে শর্তমুক্ত ঋণদান করে না। এই শর্ত অবশ্য দেশ ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে।
যেসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল তাদের ক্ষেত্রে ঋণ চুক্তির শর্ত তুলনামূলক কঠিন হয়ে থাকে। বিদেশি ঋণ গ্রহণ করা খারাপ কিছু নয়, যদিও সে ঋণের অর্থ বিনিয়োগ করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই এবং ত্বরান্বিত করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভিন্ন চিত্র প্রত্যক্ষ করা গেছে। বিগত সরকার আমলে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ঢালাওভাবে ঋণ গ্রহণ করে তার একটি বড় অংশই লোপাট করা হয়েছে। ফলে বিদেশি ঋণ গ্রহণ করে উন্নয়ন যতটা না ত্বরান্বিত হয়েছে তার চেয়ে দেশ আরো বেশি মাত্রায় বিদেশি ঋণ নির্ভর হয়ে পড়েছে। গত সরকার আমলে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের গৃহীত বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যায়। গত ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৫শ’ ৯২ কোটি মার্কিন ডলার সমতুল্য স্থানীয় মুদ্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরে (২০২৪-২০২৫) বাংলাদেশ সুদাসল মিলিয়ে বৈদেশিক ঋণের বিপরীতে মোট ৪শ’ ৯ কোটি মার্কিন ডলার পরিশোধ করেছে। গৃহীত বৈদেশিক ঋণ ম্যাচিউরড হবার কারণে প্রতি বছরই কিস্তি পরিশোধের পরিমাণ বাড়ছে।
২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ সুদসমেত বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেছিল ১শ’ ২৯ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে তা ৩শ’ ২৮ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়। বাংলাদেশ যদি আগামীতে আর কোন বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ না করে তাহলেও ২০২৯-২০২৩০ অর্থবছরে ৫শ’ ১৫ কোটি মার্কিন ডলার কিস্তি পরিশোধ করতে হবে ইতিপূর্বে গৃহীত ঋণের সুুদ এবং আসল বাবদ। আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের যে সীমা নির্ধারণ করেছে তা আমাদের জন্য অত্যন্ত অমর্যাদাকর। ঋণ কোন অনুদান বা করুনা নয়। ঋণ একটি দেশের অধিকার। কারণ গৃহীত ঋণের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণে সুদ প্রদানসহ কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। একটি দেশ কত পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করবে এবং তা কিভাবে ব্যবহার করা হবে তার পুর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দেশটির রয়েছে। তাই আইএমএফ যে শর্ত দিয়েছে তা প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে। প্রয়োজনে সংস্থাটির সঙ্গে সম্পাদিত ঋণ চুক্তি বাতিল করা যেতে পারে। দেশের মর্যাদা বিসর্জন দিয়ে কারো নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ কাম্য হতে পারে না। এ ধরনের শর্ত একটি স্বাধীন দেশের আত্মমর্যাদার পরিপন্থী। তাই তা প্রত্যাখান করা যেতে পারে।
লেখক : সাবেক ব্যাংকার।