প্রফেসর আর. কে. শাব্বীর আহমদ

সূর্য ডুবে গেলে যেমন পৃথিবী অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়, তেমনি জীবনের সূর্য ডুবে গেলেও মানুষ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়। জীবন বেলা ফুরাবার আগেই এমন কিছু ভালো কাজ করে যেতে হবে যাতে মরণের পরেও নিজের জীবন আলোকিত থাকে এবং সমাজ জীবনও আলোকিত থাকে।

সততা, বুদ্ধিমত্তা, ন্যায়পরায়ণতা মানবিকতার গুণ যেমন ব্যক্তিকে আলোকিত করে সমাজকেও আলোকিত করে। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা:) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা:) বলেছেন, প্রকৃত মুসলিম সে যার জিহ্বা ও হাতের অনিষ্ট থেকে সকল মানুষ নিরাপদ থাকে এবং প্রকৃত মুহাজির / ত্যাগকারী সেই যে আল্লাহ তা’আলার নিষিদ্ধ কাজ ত্যাগ করে। -সহীহ বোখারী

মানবতার নবীর এ হাদিস থেকে নির্দেশিত হয় যে জিহবা ও হাতের নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি প্রকৃত মুসলিম। প্রকৃত মুসলিম কখনো নিজের কথা ও হাত দিয়ে অন্যায় আচরণ করে না অন্যকে কষ্ট দেয় না, অন্যের অধিকার কেড়ে নেয় না। প্রকৃত মুসলিমই মানব কল্যাণে নিবেদিত হয়ে নিজের মানবিকতাকে উজ্জ্বল করে, সমাজকে নিরাপদ ও বাসযোগ্য করে তোলে।

প্রতিটি জীব ও মানুষের জীবনের সূর্য একদিন ডুবে যাবে। মৃত্যুর হাত থেকে কেউ রেহাই পাবে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলার ঘোষণাসমূহ : “প্রতিটি প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে তোমাদের সবাইকে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে।” -সূরা আল আনকাবুত, আয়াত : ৫৭। “তারপর যখন সেই শেষ সময়টি এসে যায়, তখন তা থেকে এক মুহূর্তও আগে-পরে করা হবে না।” - সূরা আর নহল, আয়াত : ৬১

বলুন হে নবী, তোমরা যে মৃত্যু থেকে পালিয়ে বেড়াও সে মৃত্যু অবশ্যই তোমাদের মুখোমুখি হবে। অতঃপর তোমরা অদৃশ্য ও দৃশ্যমান সবকিছুর জ্ঞানী আল্লাহর কাছে উপনীত হবে। তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দেবেন সে সব কর্ম যা তোমরা দুনিয়ায় করতে। -সূরা আল জুমু’আ, আয়াত : ৮। “তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, মৃত্যু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই। যদি তোমরা সীসাঢালা সুদৃঢ় দুর্গের ভেতরেও অবস্থান করো, তবুও।” -সূরা আন নিসা, আয়াত : ৭৮

মৃত্যুর আগেই মানুষকে সৎকর্মশীল হয়ে পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষকে নিরাপদ রাখার জন্য কাজ করে যেতে হবে। আল্লাহর বিধান ও রাসুলের সুন্নাহ বা পথ নির্দেশিকা অনুযায়ী ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রকে পরিচালনা করতে হবে। প্রয়োজনে শয়তান বা আল্লাহদ্রোহী তাগুতের সঙ্গে জীবন ও সম্পদ দিয়ে লড়াই করে মানবতার বিধান ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ব্যক্তি জীবনকে আল্লাহর সন্তোষ অর্জনে আলোকিত করতে হবে জীবনের সূর্য ডোবার আগেই।

এ কাজের সফলতার জন্য একদল সত্যনিষ্ঠ মানুষের প্রয়োজন। যেমনিভাবে রাসূল (সা:) একদল সোনার মানুষ তৈরি করে নিঃস্বার্থভাবে মানব সমাজকে সভ্যতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের আলোকে উদ্ভাসিত করেছেন। প্রাণের শত্রুকে প্রাণের বন্ধুতে পরিণত করেছেন এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা : (আইয়ামে জাহেলিয়াতে)” তোমরা ছিলে পরস্পরে শত্রু, আমরা তোমাদের অন্তরে ঈমানের ভিত্তিতে ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছি আর তোমরা ঈমানী নেয়ামতে হয়ে গেছো পরস্পরে ভাই ভাই। -সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩। এ নেয়ামত আল্লাহ তা’আলা দান করেছেন একদল নিবেদিতপ্রাণ আল্লাহপ্রেমিক সৎ, যোগ্য মানুষের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগের বদৌলতে। তারা মৃত্যুর আগে পুরো জীবনকাল মানবতার কল্যাণমূলক কাজেই কাটিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহর ওহির জ্ঞান, রাসুলের পদাঙ্ক অনুসরণ ও সচ্চরিত্রই ছিল তাদের মূল পুঁজি।

যুগ যুগ ধরে বিশ্বব্যাপী এ ধরনের মানব দরদী চরিত্রবান নিঃস্বার্থ, ত্যাগী মানুষরাই সমাজ ও সমাজের মানুষকে আলোর পথ, মুক্তির পথ দেখিয়ে গিয়েছেন। সত্যদ্রোহী স্বেচ্ছাচারীদের সাথে লড়াই করে জীবন সম্পদ উৎসর্গ করে গিয়েছেন। বাংলাদেশেও এর জ্বলন্ত নজির আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এরা সত্য, সুন্দর, মানবতা, মানুষের মৌলিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অকাতরে কাজ করে যাচ্ছেন ব্যক্তিগতভাবে ও দলীয়ভাবে। আমরা সাধারণ ঈমানদার মুসলিমরা এ সত্যনিষ্ঠ দলের সাথে একাত্ম হয়ে স্বদেশভূমকে আল্লাহর বিধান ও রাসূলের আদর্শ অনুযায়ী গড়ে তুলে সর্বস্তরের সর্ব শ্রেণির মানুষের মৌলিক অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে একাত্ম হয়ে জীবন প্রদীপ নেভার আগেই জীবনকে সার্থক করে তুলবো। অনন্ত জীবনে মুক্তির স্বাদ আস্বাদনের জন্য নিজেদেরকে আল্লার রাহে উৎসর্গ করে দেবো। এ চেতনায় উজ্জীবিত হোক প্রতিটি শুদ্ধ মমিন ও মুত্তাকির মেধা, মনন ও বৈষয়িক জীবনের কর্মপরিকল্পনা।

জীবনের সূর্য ডোবার আগেই ভাবতে হবে আজ যদি আমার মৃত্যু ঘটে তাহলে কি আমি আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুত? মৃত্যুর আগে শেষ ওয়াক্ত সালাত কি আমি আদায় করেছি? আমার অন্তরে কি আল্লাহর স্মরণ জাগ্রত ছিল? নাকি আমি অহেতুক গল্পগুজব আনন্দ আহ্লাদে মত্ত ছিলাম! আমাদেরকে ভেবে দেখতে হবে জীবনের ভোগ সামগ্রী, সম্পদ সরঞ্জাম কতটা স্থায়ী, কতটা নির্ভরযোগ্য ও আমাদের জীবনের জন্য কতটা মুক্তির গ্যারান্টি!

আমাদের অফুরন্ত চাহিদায় অঢেল সম্পদ অর্জন আর দম্ভভরে রূপ-সৌন্দর্য প্রদর্শন নিরর্থক হয়ে ওঠে কঠিন রোগশয্যায় নিপতিত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার সময়গুলোতে। তখন মন অনুশোচনায় জর্জরিত হলেও নিজেকে শোধরাবার আর সময় থাকে না।

যার জ্বলন্ত প্রমাণ আমাদের দেশের বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের মালিক যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুল গত (’২০, ’২১, ’২২ ) সালের মহামারী করোনায় আক্রান্ত হয়ে বারবার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার সীমাহীন কষ্টের সময় ডাক্তারদের বলেছিলেন, “তোমরা আমাকে একটু শান্তি দাও, একটু নিঃশ্বাস ফেলার ব্যবস্থা করে দাও, আমি আমার সমস্ত সম্পদ তোমাদের নামে লিখে দেবো।” এ রকম হাজারো নিষ্করুণ উদাহরণ আছে।

বিশ্ববিখ্যাত সুন্দরী, ফ্যাশন ডিজাইনার, ফ্যাশন ব্লগার, সেলিব্রিটি লেখিকা কিরডেইজা রড্রিগেজ ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর আগে লিখেছেন, “আমার প্রাসাদ-অট্টালিকা, নামী দামী গাড়ি, প্ল্যান, মূল্যবান আসবাবপত্র, ব্যাংক-বীমা, সুনাম-সুখ্যাতি, গৌরব কিছুই আমার কাজে লাগলো না। সবকিছু থেকেও আমি আজ নিঃস্ব। যেন মৃত্যুর চেয়ে বড় বাস্তব কিছু নেই।”

প্রকৃত সত্য কথা হলো, দুনিয়ার সামগ্রী ক্ষণস্থায়ী। আখিরাতের সামগ্রী চিরস্থায়ী। সে চিরস্থায়ী আখিরাতের জীবনে সুখী হওয়ার জন্য আমরা কোনো প্রস্তুতি গ্রহণ করিনি। এটা বুঝতে সময় লাগে। যখন বুঝি, তখন আর শোধরাবার সময় থাকে না। সবচেয়ে নির্মম সত্য কথা হলো, আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেই না। আমরা মানুষ বড়ই স্বার্থপর ও নির্বোধ জাতি! কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া।

পৃথিবীতে কেউ কারো ব্যক্তিগত দুঃখের ভাগী হতে পারে না। জীবনসূর্য ডুবে যাওয়ার বেলায় মৃত্যুযন্ত্রণা একাই আমাকে, আপনাকে ভোগ করতে হয়। একাই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়। ধরুন, আপনার আমার পরিবারের সবাই আলহামদুলিল্লাহ শারীরিকভাবে ভালো আছে। মাঝখানে হঠাৎ আপনি আমি ক্যান্সার, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, স্ট্রোকে একাঙ্গ বিকলাঙ্গ হয়ে বিছানায় পড়ে আছি, মৃত্যুর আশংকায় ভুগছি। চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার মতো অঢেল টাকাও নেই। স্বজনরা দীর্ঘদিন আপনার আমার সেবা করতে করতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। এহেন অবস্থায় আপনার আমার যে একাকিত্ব ও হতাশাবোধের যন্ত্রণা, এটা আপনি আমি যেভাবে অনুভব করি, অন্যরা সেভাবে অনুভব করতে পারে না। আপনার আমার নিদারুন নিরুপায় যন্ত্রণা আপনাকে আমাকেই ভুগতে হয়।

তাহলে আমরা কেনো ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা চিন্তা না করে বৈধ-অবৈধভাবে সুখভোগের জন্য পৃথিবীর মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ি? সুস্থ অবস্থায় আল্লাহর বন্দেগী করার, আল্লাহর দেওয়া জীবনবিধান আলকুরআনের আলোকে কেনো নিজেকে ও নিজের সমাজকে গড়ার জন্য সময় করে উঠতে পারিনা? যদি পারতাম, অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকলেও মনে একটা সান্ত্বনা থাকতো যে, আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের মধ্য দিয়ে জীবন কাটিয়েছি। দুনিয়ায় কষ্ট পেলেও পরকালে জাহান্নামের আযাব থেকে হয়তো আল্লাহ তা’আলা রক্ষা করবেন। অনন্ত জীবনটা হয়তো সুখের হবে।

এমন একটা সান্ত্বনাবোধের কাজে যদি আমরা দুনিয়ায় আত্মনিবেদিত থাকি, তাহলে একাকি মারাত্মক ব্যাধির যন্ত্রণায়ও একটা বিরাট পুরস্কার পাওয়ার আশায় নিজের মনকে অন্তত হতাশা থেকে মুক্ত রাখা যাবে। কবরের জীবনে, কঠিন হাশরের ময়দানে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে সাথী হিসেবে পাওয়ার আশায় নিজেকে আশ্বস্ত রাখা যাবে। দুনিয়ার মায়াজালে পড়ে আখিরাতের অনন্ত জীবনের সুখকে বরবাদ না করাই আমাদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আসুন, আমাদের বুদ্ধি-বিবেককে কাজে লাগাই। দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহ তা’আলাকে বন্ধু ও সাহায্যকারী হিসেবে পাওয়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখি। ব্যক্তিগত রোগ-যন্ত্রণা ভুলে থাকার জন্য নিজের ভালো ভালো কাজকে সান্ত্বনা হিসেবে স্মরণ করি। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি!

দুনিয়ার সফলতার জন্য আমরা প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো প্রস্তুতি গ্রহণ করি। চাকরির জন্য, ক্যারিয়ার গড়ার জন্য, প্রতিদিনের পার্থিব সম্পদ অর্জনের জন্য এবং প্রতিদিনের বাজার সদাই করার জন্যও আমাদের একটা প্রস্তুতি থাকে। কিন্তু আমাদের কেবল প্রস্তুতি নেই মৃত্যুর পরের জীবনের সুখের জন্য ফরজ সালাতের বাইরে সুন্নত সালাতগুলো আমরা সময় থাকলেও আদায় করি না। কবরের জগতে এমন কত মানুষ আহাজারি করছে দুনিয়ায় ফিরে এসে নিবিড়চিত্তে আল্লাহকে একটা সিজদা করার জন্য। তারা তখন কেবল আফসোস করবে কেন তারা দুনিয়ার সময়গুলোকে আল্লাহর আনুগত্যের কাজে, আল্লাহর সন্তোষ অর্জনের কাজে লাগায়নি। আল্লাহ তা’আলার ভাষায় তখন তারা বলবে : “ হায়! যদি আমাদের পুনরায় দুনিয়ায় পাঠানো হতো, আর আমরা আমাদের রবের নিদর্শনসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন না করতাম আর আমরা হতাম ঈমানদারদের শামিল।” -সূরা আল আনা’আম : আয়াত ২৭।

আমরা কি জানি আমাদের জীবনের শেষ দিন কোনটি হবে? আজকের দিনটাও তো আমার জীবনের শেষ দিন হতে পারে। আজকের আমলটুকুই হতে পারে আমার জীবনের শেষ আমল। আজকে যদি আমার জীবনের শেষ দিন হয় তাহলে আজকের দিনটি আমার জীবনের সেরা দিন বানাতে কি আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি? আমার আজকের আমলটা যদি জীবনের শেষ আমল হয় তাহলে আমার আজকের দিনের আমলগুলো কী আল্লাহ তা’আলার নির্দেশিত বিধান মতো হয়েছে?

আমাদের জীবনের সূর্য ক্রমশ ফ্যাকাশে হয়ে আসছে, ঘনিয়ে আসছে আল্লাহর ওয়াদাকৃত সময়। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন : “মানুষের হিসেব-নিকেশের সময় অতি নিকটে। অথচ তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে রেখেছে।” -সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত : ১।

জীবন সূর্য একেবারে হারিয়ে যাওয়ার আগে আমাদের জীবন ভেলাকে নিরাপদে কূলে ভেড়াতে হবে। সে কূল পুলসিরাতের কূল। সে পুলসিরাত নির্বিঘ্নে পার হতে পারলেই আমাদের জন্য অনন্ত সুখের জীবন, অপার নেয়ামতে পরিপূর্ণ জান্নাত তৈরি হয়ে আছে। সে জান্নাতে আল্লাহর মেহমান হওয়ার জন্য আমাদেরকে এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে আল্লাহর বিধি-বিধান ব্যক্তি জীবন ও সমাজ জীবনে বাস্তবায়নের জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তবেই হবে আমাদের মানব জীবনের সার্থকতা। অস্তমিত হবে আমাদের জীবনের সূর্য জান্নাতের অমীয় নহরের কাননে।

লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও কবি।