জালাল উদ্দিন ওমর
বাংলাদেশ এবং ভারত পাশাপাশি রাষ্ট্র, পর¯পরের প্রতিবেশি। দেশ দু’টির মধ্যে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। সীমান্তে ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) প্রায়ই বাংলাদেশীদেরকে হত্যা করে। বছরের পর বছর ধরে বিএসএফ এ হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। বাংলাদেশ এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধের দাবি জানালেও, তা বন্ধ হয়নি। এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধে ভারত বিভিন্ন সময়ে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করলেও, তা কার্যকর করেনি। ফলে নিয়মিত ভাবেই সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা চলছে। সীমান্তে নিরাপত্তায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) দায়িত্ব পালন করলেও, এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধে তারা বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে এভাবে ভারত কর্তৃক সীমান্তে নিরাপরাধ বাংলাদেশী হত্যা চলতে পারে না। আমরা এসব হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাই। এসব হত্যাকাণ্ড চিরতরে বন্ধ করতে হবে।
ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত রেডক্লিফ লাইন নামেই পরিচিত। ১৯৪৭ সালে ভারত এবং পাকিস্তান স্বাধীন হবার সময় এ বর্ডার লাইন নির্ধারিত হয়। ভারত-পাকিস্তান বর্ডার কমিশনের চেয়ারম্যান বৃটিশ আইনবিদ স্যার সিরিল রেডক্লিফ ১৯৪৭ সালের ১৭ আগষ্ট এটি নির্ধারণ করেন। বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশ ভুখণ্ডের সাথে ভারতের নির্ধারিত সীমানাই আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের সীমান্ত। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ৪০৯৬ কিলোমিটার সীমানা রয়েছে, যা পৃথিবীর পঞ্চম দীর্ঘ সীমান্ত লাইন। ভারতের পাঁচটি অঙ্গরাজ্যের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে। আসামের সাথে ২৬২ কিলোমিটার, ত্রিপুরার সাথে ৮৫৬ কিলোমিটার, মিজোরামের সাথে ৩১৮ কিলোমিটার, মেঘালয়ের সাথে ৪৪৩ কিলোমিটার এবং পশ্চিমবঙ্গের সাথে ২২১৭ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, রংপুর এবং ময়মনসিংহ-এ ৬টি বিভাগের সাথে ভারতের সীমান্ত সংযুক্ত। সীমান্তে ভারত দীর্ঘদিন থেকে কাটাতারের বেড়া নির্মাণ করছে। ইতিমধ্যেই প্রায় ৩১৮০ কিলোমিটার বেড়া নির্মাণ স¤পন্ন করেছে। বাকি ৯১৬ কিলোমিটার সীমান্তে ঘন বনভুমি, উঁচু পর্বতমালা, নদীপথ এবং জলাভুমি থাকায় বেড়া নির্মাণ করতে পারেনি। সীমান্তে হত্যা এবং বেড়া নির্মাণ বন্ধুত্বের কোন নিদর্শন নয়।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) রিপোর্ট অনুসারে ২০১৫-২০২৪ পর্যন্ত ১০ বছরে বিএসএফ ৩০৫ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। ২০১৫ সালে ৪৩ জন, ২০১৬ সালে ২৮ জন, ২০১৭ সালে ৩০ জন, ২০১৮ সালে ১৫ জন, ২০১৯ সালে ৪২ জন, ২০২০ সালে ৫১ জন, ২০২১ সালে ১৭ জন, ২০২২ সালে ২৩ জন, ২০২৩ সালে ৩০ জন এবং ২০২৪ সালে ২৬ জনকে হত্যা করেছে। তারা ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত আরো ১১ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের কোন বিচার হয়নি। বিএসএফ জওয়ানদের গুলীতেই এসব নিরিহ বাংলাদেশী প্রাণ হারিয়েছে। এছাড়া তাদের হামলায় বিভিন্ন সময়ে বহু বাংলাদেশী আহত হয়েছে এবং এদের কেউ কেউ পংগু হয়েছে। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারী ফেলানী খাতুন নামের ১৫ বছর বয়সী বাংলাদেশী মেয়েকে বিএসএফ গুলী করে হত্যা করে। পরদিনই তার বিয়ের কথা ছিল। তার লাশ দীর্ঘ সময় সীমান্তের কাটা তারের বেড়ায় ঝুলেছিল, যার ছবি সারা দুনিয়ার মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু ফেলানী হত্যায় জড়িত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষসহ অন্যদের ভারতের আদালত খালাস দেয়। ভারতের সুপ্রিম কোর্টে এর বিরুদ্ধে আপিল করা হলেও এখনো সে বিচার স¤পন্ন হয়নি। বিএসএফ ২০২৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী স্বর্ণা দাস এবং ৯ই সেপ্টেম্বর ১৫ বছরের জয়ন্ত কুমার সিংহকে হত্যা করে। স্বর্ণা দাস তার মায়ের সাথে ভারতের ত্রিপুরায় বসবাসরত ভাইয়ের কাছে বেড়াতে যাচ্ছিল। এভাবে ভারত সীমান্তে নিরাপত্তার নামে নিরাপরাধ বাংলাদেশীদের হত্যা করে চলেছে।
সীমান্ত ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক নীতিমালা রয়েছে। তাছাড়া দ্বিপক্ষীয় চুক্তিও রয়েছে। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে স¤পাদিত দুটি চুক্তি হচ্ছে-জয়েন্ট ইণ্ডিয়া-বাংলাদেশ গাইডলাইন্স ফর বর্ডার অথরিটিজ অব দ্যা টু কান্ট্রিজ, ১৯৭৫ এবং দ্য ইণ্ডিয়া-বাংলাদেশ কো-অর্ডিনেটেড বর্ডার ম্যানেজমেন্ট পল্যান, ২০১১। জয়েন্ট ইণ্ডিয়া-বাংলাদেশ গাইডলাইন্স ফর বর্ডার অথরিটিজ অব দ্যা টু কান্ট্রিজ, ১৯৭৫ অনুসারে এক দেশের নাগরিক যদি বেআইনী ভাবে অন্য দেশে প্রবেশের চেষ্টা করে বা কোন অপরাধে জড়ায়, তাহলে সংশিলষ্ট দেশের সীমান্ত রক্ষিবাহিনী আত্মরক্ষায় যে কোন পদক্ষেপ নিতে পারবে। তবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করাটাই বাঞ্চনীয়। কিন্তু ভারত এসব চুক্তি মানছে না। সীমান্তে কোন বাংলাদেশী আইন ভংগ করে অপরাধ করলে তাকে আটক করে আইনের আওতায় আনা এবং বিচার করে শাস্তি দেয়া যায়। কিন্তু বিএসএফ তা অনুসরণ করে না। তারা কিছু হলেই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার এবং বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা করছে। সীমান্ত সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিএসএফ এবং বিজিবির মধ্যে অনেক বৈঠক হয়েছে এবং সীমান্ত হত্যার বিষয়টি আলোচনা হয়েছে। প্রতিটি বৈঠকেই বিএসএফ, সীমান্তে হত্যা শুন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু বিএসএফ কখনোই তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। ফলে বিএসএফ কর্তৃক সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা আগের মতই অব্যাহত আছে এবং নিয়মিভাবেই বাংলাদেশীরা মারা যাচ্ছে। আমরা এসব হত্যাকাণ্ডের চির অবসান চাই। সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা চিরতরে বন্ধ করতে ভারতের নিকট দাবী জানাচ্ছি। প্রয়োজনে এ ইস্যু আন্তর্জাতিক ফোরাম এমনকি জাতিসংঘে উত্থাপনের জন্য সরকারের নিকট দাবি জানাই।
বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। এ বাস্তবতা ভারতকে মানতে হবে। বাংলাদেশ সব সময় প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে সুস¤পর্ক চায়। প্রতি বছর বিরাট সংখ্যক বাংলাদেশী চিকিৎসা, ব্যবসা এবং পর্যটন সহ বিভিন্ন কাজে ভারতে যায়। প্রচুর ভারতীয়ও বাংলাদেশে আসে। বাংলাদেশ এবং ভারতের সীমান্ত এলাকার বহু মানুষ নিজেদের মধ্যে বিয়ে-সাদির মাধ্যমে আত্বীয়তার বন্ধন গড়ে তুলেছে। দেশ দুটির মধ্যে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা রয়েছে। সীমান্তে ব্যবসা-বাণিজ্য স¤পাদনে একাধিক নদী বন্দর, স্থল বন্দর এবং কাস্টম হাউস রয়েছে। অনেকগুলো সীমান্ত হাট রয়েছে। দেশ দুটির মধ্যে বাস এবং ট্রেন চলাচল বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে অভিন্ন সীমান্ত এবং নদী রয়েছে। কিন্তু ভারত সব সময় সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা এবং বাংলাদেশকে অভীন্ন নদীর ন্যায্য পানি হতে বঞ্চিত করে চলেছে। কিছু হলেই ভারত বাংলাদেশী নাগরিকদের ভিসা প্রদান এবং বাংলাদেশে আলু, পিয়াজসহ অন্যান্য পন্য রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশের চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং অপরাধীদের ভারত নিরাপদ আশ্রয় দেয়। ফলে বাংলাদেশ সবদিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা এসবের অবসান চাই। তার জন্য ভারতকে সীমান্ত হত্যা চিরতরে বন্ধ করতে হবে, অভিন্ন নদীর ন্যায্য পানি বাংলাদেশকে দিতে হবে এবং পার¯পরিক স্বার্থে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতে হবে। বৃহৎ দেশ হিসাবে ভারতকেই এসব বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক।