আসমা খাতুন
২০১৮ সালের ২১ জুন। আমার শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয় শহীদ দেলোয়ার হোসেন (রাহি.) এর সাথে। তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের জয়পুরহাট উপজেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। একই সাথে মরহুম জয়পুরহাট জেলা জামায়াতের শূরা ও কর্মপরিষদ সদস্য ছিলেন। বিয়ের পর একজন মেয়ের জীবন নাকি সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে যায়। কিন্তু আমার জীবনে এরকম কোন ঘটনা ঘটল না। যতই দিন যেতে লাগল ততই আমি আমার জীবন সঙ্গীর জীবনাচরণ দেখে অবাক হতে লাগলাম। আমাদের বাসায় পরদিন গিয়ে মেঝেতে শুয়ে আছেন। আমার ছোট ভাই অবাক হয়ে বললো, ‘ভাইয়া! আপনি নিচে শুয়ে আছেন কেন’? তার ভাবলেশহীন জবাব, ‘আমরা দুনিয়াতে সুখ-শান্তি করার জন্য আসিনি। আল্লাহর রাসূল (সা.) কখনও নরম বিছানায় শয়ন করেননি’। তখন আমি মনে করেছিলাম এটা নিছক উপদেশ।
বাস্তবেও শয়নকক্ষে কোন খাট ছিল না। মেঝেতে শয়ন করতেন। ছিল না মশারী; ফ্যান ছিল না। আমার আম্মা একটা মশারী কিনে দিলেন। কিন্তু আমি অবাক হয়েছি তার জীবদ্দশায় কখনও মশারীর প্রয়োজন হয়নি। মশা কামড় দিতো তবুও মশার কামড়-গান সহ্য করে আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে রাতে শোয়ামাত্রই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন। রাতে মাঝে মাঝে বলতেন, ফজরের নামাযের সময় হয়েছে কি? আবার কোন কোন সময় বলতেন, ‘আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ছে। মনে হচ্ছে কিয়ামত হচ্ছে। আমি তখন বলতাম না কিয়ামত হয়নি। তখন আমার আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নত হয়ে আসত। আলহামদুলিল্লাহ ঘুমের মধ্যেও একজন ব্যক্তির কিয়ামতের জন্য আশঙ্কা!
যতই দিন যেতে লাগল ততই আমি আমার জীবন সঙ্গীর জীবনাচরণ দেখে অবাক হতাম। নরম জায়নামাযকে উপেক্ষা করে শক্ত, পাতলা একটা জায়নামাযে নামায পড়তেন। মেঝেতে শুয়ে তিনি শুধু বলতেন, ‘মশারী আমার কবর মনে হয়! আল্লাহ দুনিয়ায় সামান্য মশার কামড় সহ্য করতে পারছি না। অন্ধকার সাড়ে ৩ হাত কবরে আমরা কেমন করে থাকব? আল্লাহ!’
দাম্পত্য জীবনে আমি লক্ষ্য করেছি, তিনি আমাকে জীবনের অনেক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য ঈমানী শক্তি অর্জন করার উপায় শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলতেন, মহিলাদের মানবিক দুর্বলতা খুব বেশি। যখন রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ৩৬টি মামলার বোঝা মাথায় থাকাকালীন মুহূর্তে তাকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতাম তখন তিনি আমাকে বুঝাতেন একজন ব্যক্তির মধ্যে চার ধরনের গুণ বা বৈশিষ্ট্য থাকলে আল্লাহ তাকে ভালবাসেন আর ফেরেশতাদের ডেকে ডেকে বলেন, ‘আমি এ ব্যক্তিটাকে ভালবাসি, তুমিও তাকে ভালোবাস। গুণ বা বৈশিষ্ট্যগুলো হলোÑপ্রথমত, আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল বা ভরসা করা, দ্বিতীয়ত, সবর বা ধৈর্য ধারণ করা, তৃতীয়ত, সকল বিপদ-আপদ পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করার মানসিকতা এবং চতুর্থত, আল্লাহর জন্য মানুষকে ভালবাসা।
আমি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দীন কায়েমের চেষ্টা করে এবং শহীদী তামান্না বুকে লালন করে যাবো। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা। তারপর থেকে আমার ঈমান আরও দৃঢ় হতে শুরু করল।
কোন দিন যদি তাঁর কোনো কারণে জামায়াতে নামায না হতো তবে কোন সময় একা নামায পড়েননি। আমার কাছে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন আমি নামায পড়েছি কিনা? যদি বলতাম পড়েছি, তাহলে খুব মন খারাপ করতেন। আমি যখন বলতাম পড়লেও সমস্যা নেই আমি আবার আপনার সাথে নামায পড়ব। তখন তাঁর মনটা আনন্দে ভরে উঠত।
১ জানুয়ারি, ২০২৫। সকালে ফজরের নামাযের পর চেয়ারে বসে সুললিত কণ্ঠে আল-কুরআনের সূরা আল-ইনফিতার তেলাওয়াত করছেন। আমিও জায়নামাযে বসে কুরআন তেলাওয়াত করছিলাম। তার এমন সুন্দর সুললিত কণ্ঠ শুনে আমি আমার তেলাওয়াত থেমে তার তেলাওয়াত শুনতে লাগলাম। আল্লাহ! নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এ কণ্ঠে তেলাওয়াত কি আবার শুনতে পাবো? কুরআন তেলাওয়াত শেষ করে বললেন, তুমি আর পাঁচ মিনিট কুরআন তেলাওয়াত করো তারপর রেডি হও। এরপর ওয়াশরুমে গেলেন। আমি তাড়াতাড়ি করে উঠে প্রেসার কুকারে ২টি ডিম সেদ্ধ করতে দিলাম। ডিম দু’টি ভর্তা করে সিম ভাজা তরকারি দিয়ে ভাত আমিও খেলাম, আর আমার খাওয়ার সাথে সাথে তাকে মুখে তুলে খাওয়ালাম। এতটা তিনি দুনিয়ার প্রতি অনাশক্ত এক ব্যক্তি। আলহামদুলিল্লাহ! তিনি রেডি হওয়ার সময় যখন কোর্ট পড়ছিলেন তখন বলছিলেন শীতকালটা আমার এজন্য পছন্দ নয়। কারণ বেশি কাপড় পড়তে হয়। আর আমাকে বললেন, তোমার মাদরাসা সাড়ে ৯ টায়। তুমি আগে গিয়ে ওখানে পড়াশুনা করো। অন্যদিন বলতেন তুমি পরে গেলেও হবে। কিন্তু সেদিন এ ধরনের কোন কথা বলেননি। কিন্তু কেন যেনো আমার আগে যাওয়ার ইচ্ছা হচ্ছিল না। তবুও স্বামীর নির্দেশের জন্য আগে যেতে বাধ্য হলাম।
আমরা গাড়িতে দোয়া পাঠের মধ্যদিয়ে উঠলাম। তখন তাঁর মোবাইলে একটি কল আসল। তিনি ফোন রিসিভ করে বললেন, আমি তিন মিনিটের মধ্যে যাচ্ছি। এরপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে যাওয়া শুরু করতেই কোথা থেকে ‘আলেয়া’র মতো একটা মটরসাইকেল এসে তাঁর গাড়িতে ধাক্কা মারলো। হয়তো বা সেখানেই আল্লাহ তায়ালা আযরাইল (আ.)-কে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথমে গাড়ি, তার উপর তিনি, তার উপর আমি। আমি পড়ামাত্রই লাফ দিয়ে উঠে বুঝার চেষ্টা করছিলাম আমার কিছু হয়েছে কিনা? আর ভাবছিলাম উনিতো একাই উঠবেন। কারণ তিনি পড়ে গিয়ে কোন চিৎকার দেননি, শরীর বা মাথা রাস্তায় লুটিয়ে যায়নি। এমনকি আমি কোন আঘাতের চিহ্নও দেখতে পাইনি। এরপর আমি তার নাকে লক্ষ্য করলাম। দু’একজন ছিল তারা আমাদেরকে একটি অটোতে তুলে দিলেন। আর আমাদের সাথে একজন গেলেন। অটোতে আমি এবং সে ব্যক্তি তাকে ভাল করে ধরেও ছিলাম না। তবুও তিনি মাথা, পা অটোতে ছড়িয়ে দেননি। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহর অপার মেহেরবানী দেখে আমি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নত করে ২টি দোয়া করেই যাচ্ছিলাম। ‘আল্লাহ আপনার দরবারে প্রত্যেকটা রক্তের ফোঁটা কবুল আর মঞ্জুর করুন।’ অপরটি হলো, ‘হে আল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্য্যধারণ করার তৌফিক দান করুন।’
এভাবে যখন আমরা হাসপাতাল পর্যন্ত যাচ্ছিলাম তখন নাক দিয়ে প্রচুর রক্ত বের হচ্ছিল। হাসপাতালে ডাক্তার যখন ব্যক্তির নাম, পিতার নাম এবং আমার স্বাক্ষর নিয়ে পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করলেন, তখনও আমার বিশ্বাস হয়নি যে তিনি মারা গেছেন। কারণ মনে হচ্ছিল তিনি মুখ দিয়ে কিছু একটা বলতে চাইছেন। তখন আমার একটা কথাই মনে হচ্ছিল আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কেন শহীদদেরকে মৃত বলতে নিষেধ করেছেন। তার জ¦লন্ত প্রমাণ আমি চাক্ষুষ দেখেছি। বাসায় নিয়ে গোসল দেওয়ার পরও নাক দিয়ে তাজা রক্ত বের হচ্ছিল। কবরে নামানোর সময়ও যখন গামছাটা সরানো হলো তখনও রক্তের স্রোত লক্ষ্য করা গিয়েছিল। জানাযার নামাযের পূর্ব মুহূর্তে প্রত্যেক ব্যক্তির চোখের পানিতে সিক্ত হয়েছিল তাদের অন্তর। হে আল্লাহ এগুলোই হয়তোবা আল্লাহর জন্য ভালবাসা। হাদিস থেকে জানা যায়, যে সাত শ্রেণির মানুষ হাশরের ময়দানে আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয় লাভ করবেন তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেÑ‘যে আল্লাহর জন্যই মানুষকে ভালবাসলো আর আল্লাহর জন্যই ভালবাসা থেকে বিচ্ছিন্ন হলো।’ হাজার হাজার মানুষকে আল্লাহ তায়ালা কবুল করুন যারা আপনার জন্য তাকে ভালবেসে সাত শ্রেণির ব্যক্তির মধ্যে শামিল হয়েছেন।
পরিশেষে আমার বৃদ্ধ শ্বশুর এবং বৃদ্ধা শাশুড়ি যারা ছেলের শোকে ছিলেন মুহ্যমান। ঘুম থেকে উঠে যারা সন্তানের শোকে বলছেন, আমার মাওলানা কোথায়? হে আল্লাহ আমার মাওলানা, বাবা, সুন্দরকে কি তোমার এতই পছন্দ হয়েছে? আচ্ছা পছন্দ হয়েছে বিধায় তুমি নিয়েছ। আমার কোন দুঃখ নেই। তাকে তুমি বেহেশতের খাবার দাও। তাদের এ কথাগুলো আল্লাহর দরবারে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কবুল আর মঞ্জুর করুন। আমার কাছে বিশেষ শান্তি এটাই আমি নিজ চোখে শহীদি মৃত্যু দেখেছি। যিনি সার্বক্ষণিক পিতা-মাতার দোয়া পাচ্ছেন। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘লক্ষ্যস্থলে তীর পৌঁছার আগেই পিতা-মাতার দোয়া আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। প্রত্যেক ব্যক্তিকে মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। ইয়া আল্লাহ! তুমি আমাদেরকেও যা অর্জন করা মুমিনের টার্গেট- ১. আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের স্থায়ী চেতনা; ২. রাসূল (সা.)-এর সাথে মহব্বতের আবেগময় গভীর অনুভূতি; ৩. কুরআন অধ্যয়নের নেশা; ৪. জীবন্ত নামাযের স্বাদ গ্রহণের তৃপ্তিবোধ; ৫. দাওয়াতে দ্বীনের অব্যাহত প্রচেষ্টা; ৬. আল্লাহর ব্যাংক একাউন্টে বৃদ্ধির ধান্দা; ৭. শাহাদাতের জযবা-মৃত্যুভয় থেকে মুক্তি। অর্জন করার তৌফিক দান করুন-আমীন!
লেখিকা : শহীদ দেলোয়ার হোসেনের বিধবা স্ত্রী।