ড. বি এম শহীদুল ইসলাম
জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দ্বীনের ঝাণ্ডাকে সমুন্নত করার জন্য কাজ করে গেছেন, তাদেরই একজন হচ্ছেন-দ্বীনের একনিষ্ঠ খাদেম দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের বিখ্যাত সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ এক সময়ে জামায়াতের বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের প্রবীণ রাহবার একাধিকবার নির্বাচিত এমপি মরহুম মাওলানা মোজাম্মেল হক-এর একান্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোদ্ধা প্রয়াত মুন্সী আব্দুল মজিদ। তার পুরো নাম হচ্ছে- মো: আব্দুল মজিদ বিশ্বাস। দ্বীনের রাহবার হিসেবে অতন্দ্র প্রহরির ন্যায় ভূমিকা পালন, সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও বিশ্বস্ততার কারণে এলাকার মানুষের নিকট তিনি ‘মুন্সী’ উপাধিতে ভূষিত হন। তারপর থেকে তিনি মুন্সী আব্দুল মজিদ নামে পরিচিত হয়ে যান। ইসলামী আন্দোলনের এ অকুতোভয় সৈনিক ইসলামী বিপ্লবী চেতনার ধারক ও বাহক জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দ্বীনের খেদমতে কাজ করে গেছেন। তারই জীবনের আলেখ্য ও ইসলামী আন্দোলনে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান সম্পর্কে আমার আজকের এ অবতারণা।
এক পর্যায়ে তিনি উপলব্ধি করতে পারলেন যে, একজন সত্যিকার মুমিন হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে হলে আল্লাহ এবং তার রাসুল (স) এর বিধানের অনুসরণ ও বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। তারপর তিনি গান-বাজনা পরিত্যাগ করে কুরআন শিক্ষা শুরু করেন। উদ্দেশ্য ছিল কুরআন ও সুন্নাহর আদর্শ মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়া এবং বাস্তবায়নের কাজে মনোনিবেশ করা। ফজরের নামাজের পর তিনি প্রতিদিন নিজ বৈঠকখানায় কুরআন তেলাওয়াত করতেন। এতো চমৎকার ও সুললিত কণ্ঠে কুরআন তেলাওত করতেন যে, অনেকেই গ্রামের মাঠ থেকে তেলাওয়াত শুনে মুগ্ধ হতেন। তিনি দীর্ঘদিন মসজিদ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। মুন্সী সাহেব তার জীবদ্দশায় আযান একামাত ঈমামতি এমনকি জুম্মার খুতবাসহ সব ধরণের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান চর্চা করেছেন। একসময় তিনি যুব সমাজ ও সাধারণ মানুষের মাঝে ধর্মীয় জ্ঞান দানের লক্ষ্যে সিনিয়র ব্যক্তিদের অনুরোধে পবিত্র কুরআন শিক্ষার আসর বসালেন। তার নিজ বৈঠকখানায় বিনা পারিশ্রমিকে তিনি মানুষের কুরআন পড়াতেন। বর্ষা মৌসুমে গ্রামের অপর প্রান্তে মুসল্লীরা মসজিদে যেতে না পারায় মুন্সী সাহেবের নিজ বৈঠকখানায় তার নেতৃত্বে নামাজের জামায়াত অনুষ্ঠিত হতো এবং রোজার মাসে তারাবিহর নামাজেও ইমামতি করতেন। মুন্সী আব্দুল মজিদ বিভিন্ন সময় এলাকার বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমের সাথে জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে মসজিদ ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, হাই স্কুল কমিটি, প্রাইমারি স্কুল কমিটির সভাপতি ও সদস্য পদে সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৬ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি তার বাড়ি সংলগ্ন “বায়তুন নুর জামে মসজিদের” একাধারে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর দেশ শান্ত হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ১৯৭২ সালে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং জামায়াতের তৎকালীন আমির ভাষা সৈনিক অধ্যাপক গোলাম আযমের নাগরিকত্ব অন্যায়ভাবে বাতিল করা হয়। তার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়ার জন্য তৎকালীন সরকারের নিকট আবেদন করা হলে কোনো কাজ হয়নি। তারপর অধ্যাপক গোলাম আযমের পক্ষে দেশব্যাপী গণস্বাক্ষর কর্মসুচি পালন করা হয়। মুন্সী আব্দুল মজিদ অত্যন্ত সাহসিকতা ও বলিষ্ঠতার সাথে গণস্বাক্ষর কর্মসুচির নেতৃত্ব দান করেন। এলাকার প্রতিটি গ্রামে, বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তিনি মানুষকে বুঝান এবং অধ্যাপক গোলাম আযমের পক্ষে জনমত গঠন ও তাদের স্বাক্ষর গ্রহণ করেন। ১৯৭৯ সালে আব্বাস আলী খানের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী পুনরায় কাজ শুরু করলে যাদবপুর ইউনিয়ন জামায়াতের নতুন কমিটি গঠনের সময় মুন্সী আব্দুল মজিদকে নাযেম ও শিক্ষক সাইদুর রহমানকে সেক্রেটারি করে কমিটি ঘোষণা করেন মাওলানা এ এস এম মোজাম্মেল হক। তারপর থেকে আরো বলিষ্ঠভাবে ইসলামের খেদমতে মুন্সী আব্দুল মজিদ অতন্দ্র প্রহরির ন্যায় কাজ করেন। তিনি সক্রিয়ভাবে জামায়াতের সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে তার বাড়িতে তাফহীমুল কুরআনসহ অসংখ্য কুরআনের তাফসীর ও ইসলামী সাহিত্যের সমাহার আমরা দেখেছি। যা কালের সাক্ষী হয়ে চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৯৭৯ সালে আইডিএল-এর নামে জাতীয় সংসদ ঝিনাইদহ-৩ আসনে (মহেশপুর-কোটচাঁদপুর) নির্বাচনে এ এস এম মোজাম্মেল হকের পক্ষে তিনি ব্যাপকভাবে প্রচারণার কাজে অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মুন্সী আব্দুল মজিদ জামায়াতে ইসলামীর একজন একনিষ্ঠ খাদেম হিসেবে দ্বীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক গোলাম আযম শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী শহীদ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে তিনি অসাধারণ ভালো বাসতেন।
২০০৬ সালের ৩০ আগষ্ট ইসলামের নিবেদিতপ্রাণ বীর সেনানী মুন্সী আব্দুল মজিদ তার মেয়ের বাড়িতে রাতের খাবার শেষ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়ার সময় ওযু করে দুই রাকাত নামাজ আদায়ের পর হঠাৎ অসুস্থতা বোধ করেন এবং সাথে সাথেই মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে দুনিয়ার সফর শেষ করে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে পাড়ি জমান। কিন্তু সাথে সাথে আমাকে সংবাদ না দিয়ে পরদিন সকালে জানানো হয়। আমি সংবাদ পেয়ে সপরিবারে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে জানাযা নামাজের ইমামতি করার সুযোগ পাই। তারপর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন করা হয়। ঝিনাইদহ-৩ আসনের জামায়াত মনোনীত এমপি প্রার্থী অধ্যাপক মতিয়ার রহমানসহ বিপুল সংখ্যক মানুষ জানাযায় উপস্থিত ছিলেন। যার স্মৃতিকে অমর করে রাখার মানসে আমার আজকের এ অবতারণা-তিনি আর কেউ নন, তিনি হচ্ছেন- আমার শ্রদ্ধাভাজন গর্বিত পিতা মুন্সী আব্দুল মজিদ। তার স্বপ্ন ছিল বাংলার জমিনে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা সচক্ষে দেখে যাওয়া। তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার দায়িত্ব তাদেরকেই নিতে হবে, যারা শত জুলুম নির্যাতন অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছেন লক্ষ্য পানে। আজ আমাদেরকে ডা. শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে শপথ নিতে হবে, সকল মানব রচিত মতবাদ ও ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ইসলামকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। একই সাথে ইসলামী আন্দোলনের সত্যিকার দুর্গ হিসেবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে এবং মহেশপুর-কোটচাঁদপুর এলাকাকে গড়ে তুলতে হবে- এটিই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক।