শেখ জিল্লুর রহমান
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, অনেক দেশেই বড় রাজনৈতিক দলের পতন বা দুর্বল হওয়ার পর নতুন বা অপেক্ষাকৃত ছোট দলগুলোর উত্থান হয়েছে। এটি সাধারণত রাজনৈতিক অস্থিরতা, জনপ্রিয়তা হ্রাস বা দলের অভ্যন্তরীণ বিভেদের কারণে ঘটে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ইতালিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাসিবাদী দলের পতন হলে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর আবির্ভাব ঘটে। একইভাবে, ভারতে বিজেপির উত্থান কংগ্রেসের মতো পুরোনো দলের দুর্বলতার সুযোগে হয়েছে। অনেক দেশে পুরাতন, প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্বলতা দেখা দিলে নতুন, ছোট দলগুলোর উত্থান ঘটে। পুরাতন দলের প্রতি জনগণের অনাস্থা, নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক চাহিদা অথবা রাজনৈতিক আদর্শের পরিবর্তনের কারণে প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর পতন নিশ্চিত হয়ে থাকে। তবে, এ প্রক্রিয়া সবসময় একই রকম হয় না এবং বিভিন্ন দেশে এর ভিন্নতা দেখা যায়।
একটি পুরাতন ও বড় রাজনৈতিক দলের পতন হলে, নতুন ছোট দলগুলোর উত্থান সাধারণত কয়েকটি উপায়ে হয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে, পুরাতন দলের দুর্বলতা থেকে সুযোগ গ্রহণ, নতুন ইস্যু বা আদর্শের ভিত্তিতে সমর্থন তৈরি করা এবং জোটবদ্ধ হয়ে বা সমর্থন আদায় করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করা। কিছু দেশে দেখা যায়, বাম বা ডান ধারার পুরাতন দলগুলোর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মধ্যপন্থী বা নতুন আদর্শের দলগুলো ক্ষমতায় আসছে। আধুনিক বিশ্বেও আবার কিছু দেশে দেখা যায় যে, ধর্মভিত্তিক দলগুলো পুরাতন দলগুলোর জায়গা দখল করছে।
সাধারণত পুরাতন ও বড় দল দুর্বল হয়ে পড়লে তাদের সমর্থক ও কর্মীরা হতাশ হয়ে নতুন দলের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এ সুযোগে নতুন ছোট দলগুলো নিজেদের আদর্শ ও কর্মসূচি তুলে ধরে নতুন ভোটারদের আকৃষ্ট করে। এছাড়াও, পুরাতন দলের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব বা নেতৃত্বের দুর্বলতা নতুন দলের জন্য সুযোগ তৈরি করে। নতুন ছোট দলগুলো পুরাতন দলের চেয়ে ভিন্ন বা নতুন কোনো ইস্যুতে জনমত তৈরি করতে চায়। যেমন, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন, পরিবেশ সুরক্ষার মতো বিষয়গুলো নতুন দলের জনপ্রিয়তার কারণ হতে পারে। তাছাড়াও, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েও নতুন দলগুলো সমর্থন আদায় করতে পারে।
কখনও কখনও, নতুন ছোট দলগুলো পুরাতন দলের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয় বা তাদের সমর্থন আদায় করে। এমন পরিস্থিতিতে, পুরাতন দলের দুর্বলতা নতুন দলের জন্য নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সুযোগ তৈরি করে। এছাড়া, কিছু ছোট দল স্থানীয় বা আঞ্চলিক পর্যায়ে নিজেদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে এবং ধীরে ধীরে জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। সুতরাং, পুরাতন দলের পতন নতুন দলের উত্থানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হতে পারে। নতুন দলগুলো যদি নিজেদের আদর্শ ও কর্মসূচি সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারে, জনসাধারণের সমর্থন আদায় করতে পারে এবং পুরাতন দলের দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে পারে, তাহলে তারা পুরাতন দলের স্থান দখল করে নিতে পারে।
একটি পুরাতন, বড় দলের পতনের পেছনের কারণগুলো সাধারণত বহুবিধ এবং জটিল হয়ে থাকে। এর মধ্যে কিছু সাধারণ কারণ হলো নেতৃত্বের দুর্বলতা, দুর্নীতি, জনগণের সমর্থন হারানো, সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে না পারা এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দল। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে অনেক পুরাতন দল দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, এবং জনগণের চাহিদা পূরণে ব্যর্থতার দায়ে অভিযুক্ত হতে পারে। এর ফলে তাদের জনপ্রিয়তা কমে যায় এবং ভোটাররা নতুন বিকল্পের দিকে ঝুঁকে পরে। উদাহরণস্বরূপ, অনেক দেশে দেখা যায় যে, ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলগুলো ধীরে ধীরে তাদের সমর্থন হারাচ্ছে। বর্তমানে মাঠে থাকা দলগুলোর মধ্যে একই ধরনের স্বভাব যদি বিদ্যমান থাকে তাহলে তাদেরও পতন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। যদি না তারা উন্নত যোগাযোগের আধুনিক যুগে দলের ভেতরে সংস্কার না করেন। বড় দল হওয়ার আকাঙ্খায় থাকা দলগুলো যদি পতন হওয়া দলের অপকর্ম ও বর্তমানে বিদ্যমান বড় কোনো দলের অপকর্মের প্রতিবাদ জারি না রাখে তাহলে তাদের বড় হওয়ার স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থাকবে। তাদের দলের আদর্শের সঙ্গে অন্যদলের আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণসহ সমাজের সকল অন্যায়ের প্রতিবাদের মাধ্যমে জনগণের দলে পরিণত হওয়া সম্ভব।
নেতৃত্বের দুর্বলতা: দলের শীর্ষ নেতৃত্বের দুর্বলতা, ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বা নেতৃত্বের অযোগ্যতা দলের পতন ডেকে আনতে পারে।
দুর্নীতি: দলের মধ্যে দুর্নীতি ব্যাপক আকার ধারণ করলে, তা জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে এবং দলের প্রতি সমর্থন হ্রাস করে।
জনগণের সমর্থন হারানো: সময়ের সাথে সাথে, দল তার মূল আদর্শ থেকে সরে গেলে বা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হলে, জনগণের সমর্থন হ্রাস পেতে পারে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে না পারা: পুরাতন দলগুলো নতুন পরিস্থিতি, যেমন- নতুন প্রজন্মের চাহিদা বা প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে ব্যর্থ হলে, প্রাসঙ্গিকতা হারাতে পারে।
অভ্যন্তরীণ কোন্দল: দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিভেদ ও ক্ষমতা দখলের চেষ্টা দলের ঐক্য নষ্ট করে এবং এর পতনকে ত্বরান্বিত করে।
রাজনৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুতি: দল যদি তার মূল আদর্শ থেকে সরে যায়, তবে সমর্থকেরা অন্য দলের দিকে ঝুঁকতে পারে।
নতুন প্রজন্মের চাহিদা: নতুন প্রজন্ম তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশা নিয়ে আসে। তারা পুরাতন দলগুলোর আদর্শ বা কার্যক্রমে সন্তুষ্ট না হয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন বা পুরাতন দলের প্রতি সমর্থন ত্যাগ করতে পারে।
রাজনৈতিক আদর্শের পরিবর্তন: সময়ের সাথে সাথে রাজনৈতিক আদর্শ এবং মানুষের পছন্দ পরিবর্তন হতে থাকে। পুরাতন দলগুলো যদি এ পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে না পারে, তাহলে তারা তাদের সমর্থন হারাতে পারে এবং নতুন দলগুলো তাদের আদর্শের ভিত্তিতে জনগণের সমর্থন লাভ করতে পারে।
ছোট দলের উত্থান: ছোট দলগুলো প্রায়ই নতুন ধারণা, প্রতিশ্রুতি বা বিকল্প রাজনৈতিক পথের প্রস্তাব দিয়ে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যদি তারা কার্যকরভাবে জনগণের চাহিদা পূরণ করতে পারে, তাহলে তারা পুরাতন দলগুলোর স্থান দখল করতে পারে।
বিভিন্ন দেশের ভিন্নতা: রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং সমাজের গঠন বিভিন্ন হওয়ায়, এ পরিবর্তনের প্রক্রিয়া সব দেশে একইরকম হয় না। কোথাও পুরাতন দলগুলো দ্রুত দুর্বল হয়ে যায়, আবার কোথাও তারা নিজেদের সংস্কার করে টিকে থাকে।
সুতরাং, নতুন বা ছোট রাজনৈতিক দলের উত্থানের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল এবং বিভিন্ন কারণের উপর নির্ভরশীল। তবে এটা স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক জগতে পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং পুরাতন দলের পতন এবং নতুন দলের উত্থান প্রায়শই দেখা যায়। উপরের কারণগুলো ছাড়াও, আরও অনেক বিষয় রয়েছে যা একটি পুরাতন দলের পতনে ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতিটি দলের পতনের কারণ বিশ্লেষণ করাটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদশে আওয়ামী লীগের পতনের কারণে নতুন বা পুরাতন অপেক্ষাকৃত ছোট দলগুলোর জন্য সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যদি দলটির পতনের সঠিক কারণ বিশ্লেষণ করে বড়দল হয়ে উঠা বেশকিছু দল রাজনীতির মাঠ দখল করতে পারে তাহলেই জনআকাঙ্খার দলে পরিণিত হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক