এ কে এম আবদুর রহীম
বিশ্ব ডাক দিবস। বিশ্ব ডাক দিবস (World Post day) ১৮৭৪ সালে সুইজারল্যান্ডের বের্ন শহরে বিশ্ব ডাক সংস্থার (ইউপিইউ) প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীকে স্মরণ করে প্রতি বছর ৯ অক্টোবর বিশ্বজুড়ে পালন করা হয়। বিশ্ব ডাক সংস্থা চিঠি লিখে তথ্য আদান-প্রদান এবং যোগাযোগের মাধ্যমে ডাক বিভাগে বৈশ্বিক বিপ্লবের সূচনা করে। ডাক সেবার প্রচার এবং প্রসার এ সংস্থার মূল উদ্দেশ্য।
একটা সময় বিদেশে থাকা সন্তানের চিঠির জন্য মা, বাবা ও স্বামীর চিঠির জন্য স্ত্রী ডাক বিভাগের কখন রানার আসবে সে অপেক্ষায় থাকতো। বর্তমানে সে অপেক্ষা করতে হয় না। প্রযুক্তি অনেক সহজ করে দিয়েছে। সেকেন্ডের মধ্যে পৃথিবীর এক প্রান্তের থেকে অন্য প্রান্তের খবর মুহূর্তে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে জানা যাচ্ছে। তবে এখনও ডাক বিভাগের মাধ্যমে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সীমিত পর্যায়ে ব্যবহার হচ্ছে।
’৮০-এর দশকে আমি যখন সাংবাদিকতা শুরু করি তখন নিউজ পাঠানোর দুটি ওয়ে ছিল। এক হচ্ছে, বুকপোষ্ট যা ডাক বিভাগের মাধ্যমে যেত, অপরটা হচ্ছে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে গিয়ে সরাসরি মুখে নিউজ বলতাম, পত্রিকা অফিসের দায়িত্বরত রিপোর্টার সেটা লিখে নিতেন। উপজেলায় কর্মরত থাকা কালে ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ নিউজ বুকপোষ্টের মাধ্যমে যেত। এর সিস্টেম হচ্ছে, আমরা হলুদ লম্বা খাম গুলো কিনে রাখতাম। দু’টি সিল তৈরী করা থাকতো। একটাতে লেখা বুকপোষ্ট বা খোলাডাক। অন্যটাতে আমার নাম ঠিকানা লেখা। খাম কিনে এনে এ দু’টি সিল সবগুলোতে মেরে দিতাম। নিউজ হাতে লিখে ভাঁজ করে খামে ঢুকিয়ে দিয়ে খামের মুখ খোলা রেখেই ডাকবাক্সে ফেলে দিতাম। খুব সম্ভবত দশ পয়সার টিকিট দিয়ে শুরু করেছিলাম। পোষ্ট অফিস থেকে একসাথে একশত খাম কিনে নিয়ে আসতাম। প্রতি খামে দশ পয়সার একটা টিকিট লাগিয়ে ছেড়ে দিতাম। এ খাম পরদিন বা তার পরদিন পত্রিকা অফিসে পৌঁছত। ১৫/২০ বছর বুকপোষ্টের মাধ্যমে নিউজ, ছবি পাঠিয়েছি কখনো পত্রিকা অফিসে পৌঁছেনি এমন মনে পড়ছেনা। দুপুরের আগে হলে রাস্তার যে কোন বক্সে ফেললে হত, দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত প্রধান ডাক ঘরে ফেলতে হত। ছয়টার পর হলে রাত আটটায় সর্বশেষ আরএমএস (রেলওয়ে মেইল সার্ভিস) শাটল ট্রেন ধরাতে হত। যাতে নিশ্চিত পরদিন সকালে নিউজ পৌঁছে যায়। অপর পন্থাটি ছিল সরাসরি ফোনের মাধ্যমে বলা। তাতে অনেক ঝক্কি ছিল। ফেনীতে আমরা ৭/৮ জন সাংবাদিককে নিয়মিত এ ঝক্কি পোহাতে হত। প্রথমত রাত দশটার পর আমরা টেলিফোন ভবনে পৌঁছতাম। এটা শুধু পরদিন ধরানোর উপযোগী নিউজ হলে। ১২টা সর্বশেষ টাইম। এরপর পাঠালে সে নিউজ পরদিনের পত্রিকায় আসতোনা।
ঝক্কিটা হচ্ছে, প্রথমত একজন একজন করে নিউজ পাঠাতে হত। স্বভাবতই সিনিয়ররা আগে চান্স পেতেন। সিরিয়ালের সমস্যা ছাড়াও খুব চিৎকার করে কথা বলতে হত। ফলে একদিন নিউজ পাঠালে কয়েকদিন লাগতো গলা ঠিক হতে। এরপর হচ্ছে অধিকাংশ সময় শব্দ বানান করে দিতে হত।
যাক সেটা। ছবি প্রিন্ট করা যে কি পরিমাণ ঝামেলাপূর্ণ ছিল সেসব লিখলে কলেবর অনেক বেড়ে যাবে। তাই সেই প্রসঙ্গও বাদ। ডাকপিয়ন সুখ দুঃখ আশা আকাক্সক্ষা, ভালোবাসার কত কথার চিঠি পত্র নিয়ে মানুষের দুয়ারে হাজির হত। তাই প্রতিদিন পিয়ন আসার সময় হলে সবাই অপেক্ষা করত যে সে তার ঝোলা থেকে এ বুঝি কোন বারতা নিয়ে হাজির হচ্ছে। ডাক হরকরা বা পিয়ন ছিল সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
সে বিভাগ আজো আছে, সে বিভাগের লোকজনও এখনও আছে কিন্তু আজ যেন তারা অপাংতেও। খাঁ খাঁ করছে পোষ্ট অফিস গুলো। অন্তত গত প্রায় বিশ বছর তারা আছে, বেতন ভাতা আছে, প্রমোশন ডিমোশন আছে, সবই আছে নেই শুধু কাজ। সরকারের শত কোটি টাকা ফি মাসে গচ্ছা যাচ্ছে তাতেও কারো মাথা ব্যথা নেই। সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ বলেই এটা সম্ভব হচ্ছে।
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সরকার ডাক বিভাগকে যুগোপযোগী করে তুললে সাধারণ জনগণ যেমন ভালো সেবা পেয়ে উপকৃত হতো তেমনি সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পেতে পারত। কুরিয়ার সার্ভিস গুলো ব্যবসা করছে না? অথচ ডাক বিভাগ ফি বছর কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনছে। কেন লোকসান হচ্ছে, কিভাবে লোকসানকে লাভে পরিনত করা যায় তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা কি কেউ করছে?
‘কুরিয়ার’ সার্ভিসের মত সার্ভিস চালু করতে পারে, ‘নগদ’ এর সেবাকে ব্যাপকভাবে প্রচারণার মাধ্যমে এর সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা যায়, টেলিটককে আরো উন্নত করে ভালো সার্ভিস দিতে পারলে রবিসহ অন্য অপারেটর গুলো দাড়াতেই পারার কথা নয়। সেটি ডাক বিভাগের হাতে পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া যায়।
বিগত ফ্যাসিস্ট আমলে সরকারের মন্ত্রী এমপিরা এসব হতে দেয়নি নিজেদের পকেট ভারী করতে। জুলাই বিপ্লবের পর অনেক আগেই ডাক বিভাগ, রেলওয়ে বিভাগ, টি এন্ড টি বিভাগ এসব বিভাগের ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। রেলওয়ে এবং টি এন্ড টি নিয়ে অন্য আরেক দিন লেখার ইচ্ছে আছে।
দেশের প্রতিটি জেলা উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে রয়েছে ডাক বিভাগের নিজস্ব জমিতে নিজস্ব ভবন। সেসব ভবনের পলেস্তারা খসে পড়ছে। কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। অবিলম্বে এ ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।