মাহমিয়া আলম শান্তা

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা এখন আর কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি রূপ নিয়েছে নিত্যদিনের দুঃস্বপ্নে। প্রতিদিন সকালে পত্রিকার পাতা খুললে কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ রাখলেই চোখে পড়ে প্রাণ হারানো মানুষের মর্মান্তিক সংবাদ। সম্প্রতি সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে এবং এর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এ বছরের এপ্রিলে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শুধু ঈদুল ফিতরের সময়, ৪ এপ্রিল থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত, দেশের সড়ক-মহাসড়কে ৩৯৯টি দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন নিহত এবং ১,৩৯৮ জন আহত হয়েছেন। একই সময়ে রেল ও নৌপথে আরও ৩১টি দুর্ঘটনায় ৩১ জন নিহত হয়েছেন। সব মিলিয়ে ১৫ দিনে ৪১৯টি দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত এবং ১,৪২৪ জন আহত হয়েছেন। আগের বছরের তুলনায় সড়ক দুর্ঘটনা ৩১.২৫ শতাংশ, প্রাণহানি ২৪.০৮ শতাংশ এবং আহতের সংখ্যা ১৪৭.৪৩ শতাংশ বেড়েছে।

গত ০৪ জানুয়ারিতে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে ৬ হাজার ৩৫৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫৪৩ জন নিহত ও ১২ হাজার ৬০৮ জন আহত হয়েছেন।

আগের বছরের তুলনায় সড়ক দুর্ঘটনা ১.৫৪ শতাংশ, প্রাণহানি ৭.৫০ শতাংশ এবং আহতের সংখ্যা ১৭.৭৩ শতাংশ বেড়েছে। দুর্ঘটনাগুলোর পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ: অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো, বেপরোয়া ও অনভিজ্ঞ চালক, লাইসেন্সবিহীন যানবাহন, অনিয়ন্ত্রিত ও অনিরাপদ সড়কব্যবস্থা এবং সর্বোপরি, পথচারীদের অসচেতনতা।

যেখানে প্রত্যাশিত ছিল একটি শৃঙ্খলিত সড়ক ব্যবস্থা ও কার্যকর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, সেখানে দেখা যাচ্ছে প্রশাসনের উদাসীনতা ও দুর্বল আইন প্রয়োগের চিত্র। দেশের এক একটি মহাসড়ক যেন পরিণত হয়েছে মৃত্যুফাঁদে। শহরাঞ্চলে যেমন গ্যাং কালচারের মতো বাইক রেসিং বেড়েছে, তেমনি গ্রামাঞ্চলেও অবাধে চলছে ওভারলোড ট্রাক ও ট্রলির দাপট।

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই, ঢাকায় একটি বাসের চাপায় দু’শিক্ষার্থীর মৃত্যু সারাদেশে ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। এ ঘটনার পর, হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে আসে, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে অংশ নেয়, চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা করে এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে ৯ দফা দাবি উত্থাপন করে। আন্দোলনের চাপে সরকার নতুন সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়ন করে, যেখানে ইচ্ছাকৃত হত্যার জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড এবং দুর্ঘটনাজনিত হত্যার জন্য সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু সাত বছর পেরিয়ে গেলেও সে আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ, লাইসেন্স প্রদান, যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়নি। ফলে, সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমার পরিবর্তে বরং বেড়েই চলেছে।

সড়ক দুর্ঘটনা শুধু একটি সংখ্যাগত বিষয় নয়, বরং তা একটি পরিবার, একটি ভবিষ্যৎ, একটি স্বপ্নের করুণ ভাঙন। একেকটি মৃত্যু যেন ছিন্ন করে দিচ্ছে অগণিত সম্ভাবনার সুতোর টান। একজন স্কুল পড়ুয়া, একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, একজন গার্মেন্টস কর্মী কিংবা একজন গৃহিণী- কারো জীবনই আজ নিরাপদ নয় সড়কে। এমন পরিস্থিতিতে আর অবহেলা করা চলবে না। নিরাপদ সড়ক চাই মানে শুধু দুর্ঘটনাহীন সড়ক নয়, বরং একটি মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থারও প্রতিফলন চাই। চাই সমন্বিত উদ্যোগ-সরকারি নীতিনির্ধারকদের কার্যকর পদক্ষেপ, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন, চালকদের প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স প্রদান ব্যবস্থায় কঠোরতা এবং সর্বোপরি, জনগণের সচেতনতা।

২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন আমাদের দেখিয়েছিল তরুণ সমাজের জেগে ওঠা কেমন হতে পারে। আজ সময় এসেছে সে চেতনাকে দীর্ঘমেয়াদে বাস্তবায়নের। একটি মৃত্যুহীন সকাল, নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা এবং প্রাণে বেঁচে ফেরার অভয়-এই প্রত্যাশা কি বেশি কিছু?

নিরাপদ সড়ক চাই-এটা এখন আর শুধু স্লোগান নয়, এটা আমাদের প্রাণের দাবি, আমাদের ভবিষ্যতের শর্ত।

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।