॥ মনসুর আহমদ ॥
ইসলাম মানুষের জন্য অনন্য জীবনব্যবস্থা, আল্লাহ্র মনোনীত একমাত্র জীবন ব্যবস্থা। আল্লাহ বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই ইসলাম একমাত্র আল্লাহ্র মনোনীত ধর্ম।’ এ এমন এক জীবন ব্যবস্থা যা মানবজীবনে কোন অর্থনৈতিক জটিলতা, সাংস্কৃৃতিক সংঘর্ষ, সমাজ- রাষ্ট্রে রাজনৈতিক স্বার্থ সংঘাত না ঘটে তার পথ নির্দেশনা প্রদান করে। মানুষের সত্ত্বাকে সার্বিকভাবে আল্লাহ্তে সোপর্দ করে তাঁর মনোনীত পথ অনুসরণ করে চলার একমাত্র নাম ইসলাম। ইসলামের পরিচয় দিতে আল্লাহর রাসূল ফরমান, ‘তুমি তোমার পরিপূর্ণ সত্ত্বা আল্লাহ্র সমীপে সোপর্দ করে দাও, অন্যান্য উপাস্যকে পরিত্যাগ করো এবং সালাত প্রতিষ্ঠা করো ও যাকাত আদায় করো’- এর নাম ইসলাম।
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ মঙ্গলময় ও শাশ^ত জীবন ব্যবস্থার নাম। কাল পরিক্রমায় এ দীনে কোন ব্যাপারেই সংযোজন বা বিয়েজনের কোনও প্রয়োজন হবে না। আল্লাহর ঘোষণা, “আজ আমি তোমাদের দীন (জীবন ব্যবস্থা) পরিপূর্ণ করে দিলাম। এবং তোমাদের উপর আমার অনুগ্রহ পূর্ণত্বে পৌঁছে দিলাম। আর ইসলামকেই তোমাদের জন্য একমাত্র ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম।’ (সূরা আল-মায়েদা-৩)। তবে জীবন প্রবাহে সঙ্গতি স্থাপনে জীবন পদ্ধতি (দীন) অবলম্বনের ধারায় দীনের উৎস মূল থেকে নিঃসৃত যুগোপযোগী কানুন ইজতেহাদ ও ইজমার পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন নতুন পদ্ধতি অবলম্বনে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। হজরত যায়েদকে সিরিয়ানী ভাষা শিক্ষাগ্রহণের জন্য রাসূল (সা.)-এর উৎসাহ প্রদান তার একটি দৃষ্টান্ত। মানুষের প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করেই ইসলাম তার বিধান দিয়েছে। মানুষ জগতে আসে মুখ পা হাত প্রভৃতি নিয়ে। তাকে এ জগতে বেঁচে থাকতে তার খাদ্য অর্থ ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। তাই ইসলাম মানবজীবনের অর্থনৈতিক দিকটাকে কখনই ছোট করে দেখে না বরং কিছু মানুষই অর্থনৈতিক ব্যাপারে চিন্তার প্রান্তিক সীমায় অবস্থান করছে।
কুরআনের বিধান প্রতিষ্ঠার ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সমাজে নাজিল হয় বরকত ও অর্থনৈতিক প্রাচুর্য। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর তারা যদি তাওরাত ইঞ্জিল এবং যা প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে তা পুরাপুরি পালন করতো, তবে তারা উপর থেকে এবং পায়ের নিচ থেকে আহার্য লাভ করতো। (সূরা আল -মায়েদা- ৬৬) মানবজীবনে অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের ধারা অলৌকিতার চেয়ে দীন প্রতিষ্ঠার বাস্তব ফল রূপে আসবে এটাই আল্লাহর নীতি। এ আয়াতগুলি দীন প্রতিষ্ঠার বাস্তব প্রতিফল হিসেবে জীবনকে প্রাচুর্যময় করার যেমন ইঙ্গিত প্রদান করে, তেমনি জীবনকে যথার্থ উপায়ে উপভোগের অনুপ্রেরণা প্রদান করে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহ তোমাকে যা (সম্পদ) দান করেছেন তদ্বারা পরকালের আবাস অনুসন্ধান কর এবং ইহকাল থেকে তোমার অংশ ভুলে যেও না।’ (কাসাস-৭৭)
কুরআনের এসব আয়াত এবং রাসূলের হুকুম ‘যাকাত দাও’ এ সবের মধ্যে প্রচ্ছন্ন রয়েছে মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জনের একটি সদাজাগ্রত ইঙ্গিত। মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি কীভাবে আসবে এ ব্যাপারে (সা.) অনেক কথা বলেছেন। জীবিকার উদ্দেশ্যে প্রশস্ত জমিনে ছড়িয়ে পড়ার জন্য উপদেশ দিয়েছেন আল্লাহ্র রাসূল; তিনি ফরমান, ‘এবং সফর কর তা হলে অন্যের কছে হাত পাততে হবে না।’ এত স্পষ্ট নির্দেশ থাকার পরেও যারা জীবনে কর্মবিমুখ, সংসার বিমুখ হয়ে তথাকথিত জীবন পদ্ধতিকে মানব সমাজের জন্য মঙ্গলময় মনে করেন তারা জাহেলিয়াতের ভ্রান্ত ঘূর্ণিপাকে পড়ে মানব সভ্যতাকে ধ্বংসের আতল গহ্বরে ফেলতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ভ্রান্ত ‘তাকদীর বাদ’ নির্ভর চিন্তাধারা মুসলিম সমাজকে কর্মবিমুখতায় উৎসাহিত এবং দারিদ্র্যকে গৌরবের বিষয় মনে করতে শিখিয়েছে, যা সুস্পষ্টভাবে ইসলামী বিধানের পরিপন্থি। এ ভ্রান্তির মূলে রয়েছে মুসলিম জাতীয় জীবনে কুরআন বর্জন করে বিভিন্ন জাহেলী দর্শন গ্রহণ এবং রাজনৈতিক জীবনে ভিন্ জাতির গোলামী ও আদর্শ গ্রহণ।
শুধুমাত্র তকদীরে নির্ভরতা নয় বরং জীবনে সচ্ছলতা অর্জনের জন্য পরিশ্রমকে উৎসাহিত করেছেন আল্লাহ্র রাসূল (সা.)। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ্ সেই মুসলমানকে ভালবাসেন যে পরিশ্রম দ্বারা জীবিকা অর্জন করেন। (তারগীব)
রাসূলের এ কথার সাথে দেখতে পাওয়া যায় তাঁর কাজের হুবহু মিল। রেসালত প্রাপ্তির পূর্ব জীবনে তাঁকে দেখা যায় ব্যবসায়ে নিয়োজিত এক সার্থক যুবক রূপে। তেজারত মানুষের অর্থনৈতিক জীবনে অধিকতর সচ্ছলতা ও সুস্থতা আনতে পারে বিধায় রাসূল ব্যবসাকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন। সাহাবাগণও ব্যবসা পেশাকে তাঁদের জীবনের অন্যতম উত্তম অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। রাসূল (সা.)-কে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, সবচেয়ে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ উপার্জন কোনটি? রাসুল সাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম উত্তর দিলেন, ‘ব্যবসার, যদি তার মধ্যে আল্লাহ্র নাফরমানির তরীকা অবলম্বন না করা হয় এবং হয় নিজ কায়িক পরিশ্রমের উপার্জন।’ এ ছাড়াও সৎ ও নির্ভরযোগ্য ব্যবসায়ীদের মর্যাদাকে সিদ্দিক, শহীদদের মর্যদার সমান করে বর্ণনা করেছেন রাসূল (সা.)।
মুসলিম জাতীয় জীবনের বাস্তবরূপ ফুটিয়ে তুলে আমাদের করণীয় কী এ ব্যাপারে আমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছে উপর্যুক্ত হাদিস। আজ অর্থের অভাবে অসংখ্য মানুষ মিশনারীদের তৎপরতার ফলে ভিন্নধর্ম গ্রহণ করছে, সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে বিত্তশালীরা সম্পদের অপব্যবহারের মাধ্যমে সৎ যোগ্য খোদাভীরুদেরকে পদানত করে রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রধান্য বিস্তার করে মানব সমাজকে রব বিমুখী জীবন ব্যবস্থার দিকে পরিচালিত করে চলছে। রাসুল ও তাঁর পরবর্তী সাহাবাদের যামানায় মানুষের ঈমান মজবুত ছিল। সব ধরনের অভাব অনটনের মধ্যে তঁদের ঈমান সব রকমের বিপত্তি থেকে নিরাপদ ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ের মুসলিম জিন্দেগিতে ঈমানী দুর্বলতা বিরাজ করছে বিধায় দারিদ্র্য তাদেরকে অতি সহজেই বেপথে পরিচালিত করতে পারছে।
রাসূল (সা.)-এর হৃদয় ছিল অহীর আলোকে প্রজ্জ¦লিত। মুসলমানদের সমাজজীবনে এ দুরবস্থা ঘটবে অনুমান করেই তাদের জীবনে সচ্ছলতা অর্জনে উৎসাহিত করে তিনি তাঁর শাশ^ত বাণী প্রকাশ করলেন, যেন মানুষ সভ্যতার শেষ সময় পর্যন্ত দারিদ্র্য ও দারিদ্র্য সঞ্জাত ক্ষতি থেকে মুক্তি পেতে পরে। এ ব্যাপারের একটি হাদিস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কাব বিন উজ্রা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ দিয়ে এক ব্যক্তি গেল। সহাবারা তাঁকে জীবিকা অর্জনে খুবই তৎপর ও আকৃষ্ট দেখে রাসূল (সা.)কে বললেন, ‘যদি ঐ ব্যক্তির দৌড়ঝাঁপ ও অনুরাগ আল্লাহ্র রাস্তায় হতো, তবে কতই না ভালো হতো! তাঁদের কথা শুনে রাসূল (সা.) ফরমান, ‘যদি এ ব্যক্তি নিজের ছোট ছোট সন্তানদের জন্য দৌড়ঝাঁপ করে তবে এ কাজ আল্লাহ্র রাস্তায় বলে গণ্য হবে। যদি সে বৃদ্ধ মাতা-পিতার পালনের জন্য সচেষ্ট থাকে তবে তাও আল্লাহ্র পথে বলে গণ্য হবে। আর যদি সে নিজের জন্য এ চেষ্টা করে এবং তাতে তার উদ্দেশ থাকে অন্য কারও কাছে হাত প্রসারিত না করা, তবে তার এ প্রচেষ্টা-তৎপরতাও আল্লাহ্র পথে বলে গণ্য হবে। অবশ্য যদি তার এ পরিশ্রম অধিক ধন সম্পদ অর্জন করে মানুষের উপর নিজের বড়াই দেখানোর উদ্দেশ্যে হয়, তবে এ সমস্ত পরিশ্রম শয়তানের রাস্তায় বলে গণ্য হবে।’ (তারগীব)
ইসলাম নৈতিক শক্তিকে মানবজীবনে প্রাথমিক গুরুত্ব প্রদান করে। এই নৈতিক শক্তির প্রতি যথাযথ দৃষ্টি প্রদান করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সচেষ্ট হলেই সমাজে শান্তি আসতে পরে। ইতিহাস প্রমাণ করে যে, হজরত ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ইসলামের মৌলিক নীতির ভিত্তিতে সমাজকে পুনর্গঠিত করেছিলেন। যে কারণে তাঁর রাষ্ট্রে ইতিহাসের নজিরবিহীন প্রগতি সাধিত হয়েছিল। সমগ্র মুসলিম সমাজে সে সময় কেউ গরিব ছিল না। এছাড়াও খোলাফায়ে রাশেদার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস কীভাবে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি পার্থিব সফলতা ও অর্থনৈতিক উন্নতির পথ খুলে দেয় তার নজির পেশ করেছিল। তাই খোদাভীরুতার নামে দরিদ্রতাকে যারা উত্তম মনে করে তারা আসলে সুন্নাতের পরিপন্থি চিন্তায় নিমগ্ন। রাসূল ইরশাদ করেন, ‘খোদাভীরু লোকদের জন্য সম্পদশালী হওয়ায় কোন দোষ নেই।’
রাসূল (সা.) যেমন আমাদেরকে শিখায়েছেন কুফরী থেকে বেঁচে থাকার, তেমনি শিখিয়েছেন দারিদ্র্য থেকে মুক্তিলাভের উপায়। তিনি যেমন মোনাজাত করেছেন সম্পত্তির নিরাপত্তার জন্য, তেমনি মোনাজাত করেছেন ঋণের গুরুভার থেকে মুক্তি লাভের জন্য। রাসূলের (সা.) এ প্রার্থনা তাঁর উম্মতের জন্য পথ চলার পাথেয়। বিশেষ করে আজ যখন বাতিল শক্তির আর্থিক প্রাচুর্যও জাগতিক উন্নতি মুসলমানদের জন্য হুমকি ও ঈমানের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে; তখন মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব রাসূলের (সা.) কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করা-‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে কম দিও না, অধিক মাত্রায় দাও। আমাদেরকে সম্মানিত করো অপমানিত করো না। আমাদেরকে দান করো আমাদেরকে বঞ্চিত করো না। আমাদেরকে অগ্রাধিকার দাও, আমাদের বিপক্ষে কাউকে অগ্রাধিকার দিও না।
রাসূল (সা.)-এর দোয়া তাঁর কণ্ঠসীমায় আবদ্ধ ছিল না, তাঁর দোয়া ও প্রচেষ্টা এক সত্তায় লীন হয়েছিল। আজ তাই আমাদেরকেও এ দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহ্র সামনে পেশ করার সাথে সাথে কর্মপ্রচেষ্টায় নিয়োজিত করা একান্ত প্রয়োজন।
সুখী ও সৎজনের ন্যায় জীবন (আইশাস্ সুয়াদা (য়) আমাদের কামনা হওয়া উচিত। কামনা মহৎ হলে, প্রচেষ্টা আন্তরিক হলে, বুদ্ধিতে জাগ্রত হলে এবং সাধনা নিরবচ্ছিন্ন হলে আল্লাহ্র করুণা আমাদের জন্য শীঘ্রই আসবে। আল্লাহ্র কাছে জওয়াবদিহির সদা জাগ্রত চিন্তার সাথে দুনিয়া চালানের জন্য দক্ষ ও ধনী লোকদের প্রয়োজন। হে আল্লাহ্! তুমি আমাদের সর্বপ্রকার অপরাধ মার্জনা করো, সর্বপ্রকার দোষত্রুটি গোপন করো, সর্বপ্রকার দুশ্চিন্তা অপসারণ করো, সর্বপ্রকার ঋণ পরিশোধ করে দাও। দুনিয়া ও আখেরাতের এমন সব প্রয়োজন যাতে তুমি সন্তুষ্ট থাকো এবং যার মধ্যে আমাদের কল্যাণ নিহিত রয়েছে, তা তুমি পূর্ণ করো। ( হে পরম দয়ালু)’