॥ অধ্যক্ষ ডা. মিজানুর রহমান ॥

মানবতা ও মানবসভ্যতা বর্তমান বিশ্বে এক মহাক্লান্তিকাল অতিক্রম করছে। আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভূপ্রাকৃতিক ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন বিশেষভাবে লক্ষণীয়। উন্নয়নের নামে মানুষ যা ভাল মনে করে করছে আদতে সেগুলো সভ্যতা বিকাশে কতটা সহায়ক ও নিয়ামক তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণের সময় এসেছে। আমরা যদি বিবেকের মানদণ্ডে গভীরভাবে বিচার করি তাহলে ফলাফল দাড়ায়, সমস্ত মানুষগুলোই ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। ক্রমাগতভাবে মানবজাতি ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়,বিবেক বর্জিত কর্মকান্ড বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিশেষ করে আণবিক, পারমাণবিক ও রাসায়ানিক যুদ্ধ কোন সভ্যতার পক্ষের কাজ হতে পারে না। কিন্তু এ অপকর্মগুলো তো সভ্যতার দাবীদাররাই করছে। তবে ধ্বংসের হাত থেকে রেহাই না পেলেও দায়মুক্ত হতে সক্ষম শুধুূ তারা, যারা শত বাধাঁ ও কষ্টের মাঝেও একান্ত ভাবে সৃষ্টিকর্তার বিধানকে অনুস্মরণ ও অনুশীলন করার চেষ্টা করে থাকেন। এটা আল কুরআনেরই একটি বার্তা। একটি সমাজের সভ্যতা ও অসভ্যতার মাপকাঠি হলো জীবনাচরণের বাস্তবচিত্র। মানুষের চলা ফেরা, ওঠাবসা, পোশাক-আশাক, ভাষা ও বাচনভঙ্গি, লেন-দেন, শিক্ষা -দীক্ষা ,পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদি। প্রচলিত শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির রকমারীকে পরিমাপ করেও সভ্যতার মাত্রাকে সহজে অনুভব করা যায়। পৃথিবী সৃষ্টির পর আদম (আ:)কে আদব-কায়দা, ভালো মন্দ শেখানোর মাধ্যমে সভ্যতা বিকাশ শুরু হয়।

কালের বিবর্তনে দুনিয়াতে মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। চিন্তায়, পেশায়, কর্মে আসে ভিন্নতা। মানুষ ইতিহাস ভুলে গিয়ে নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো পথচলা শুরু করে। তাদেরকে বুনিয়াদী সভ্যতার পথে পরিচালিত করার জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রাসূলের আগমন ঘটেছে। তাঁরা নিজেদের উপর রবের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত অথবা পুর্বের নবী ও রাসূলের পথে পরিচালিত করার জন্য প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেছেন।

মূলত মানবসভ্যতা প্রতিষ্ঠার জন্যই ইসলামের আগমণ। সভ্যতার গতিময়তায় ইসলাম এক অভূতপূর্ব মাইলফলক। ইসলাম নাযিল হয়েছে মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। সুখী সমৃদ্ধশালী বিশ্ব নির্মাণ করতে। বোধ, বিশ্বাস, বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা, মানবতা,দায়বদ্ধতা, পরোপকারিতা ও বিবেকবোধের বিপ্লব সাধনের জন্যই ইসলাম এক অতুলনীয়।

নৈতিক শিক্ষা, সভ্যতা ও সাংস্কৃতির বীজ বপন করে অর্ধ পৃথিবীকে একাধারে পাচঁশ বছর এবং বিচ্ছিন্নভাবে নয়’শ বছর শাসন করতে পেরেছে। আজ সে রেনেসাঁর ইতিহাস মুহ্যমান। কালের বিবর্তনে ইহুদী-নাসারাদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কতিপয় ন্যায় পরায়ন মুসলিম শাসকরা নিজেদের তাহজীব-তামাদ্দুন তথা সভ্যতা ও সংস্কৃতি ভূলে গিয়ে লোভ, হিংসা, অহংকার, নারী ও সরাবের আসরে অংশগ্রহনের মাধ্যমে তাদের মিল্লাতের অবমাননা করতে শুরু করায় আজ আমাদের এ করুণ পরিণতি। মক্কা থেকে হিজরতকারী মুহাজিরদের নজীরবিহীন সার্বিক সহায়তার ভূলে গিয়ে আজ একশ্রেণির মুসলমানরা একবিংশ শতাব্দীতে মানবরচিত মতাদর্শের সাথে ইসলামের সমঝোতা করার প্রবণতা ইসলামের বুনিয়াদী সৌন্দর্যকে ম্লাণ করে দিয়েছে। যে কারণে ইসলামের চিরশত্রু ক্ষমতাধররা আজ আইয়ামে জাহেলিয়াতকে হার মানিয়েছে নব্য জাহিলিয়াত কায়েম করে ফেলেছে।

মুসললমানরা আজ নানা মানহাজে বিভক্ত হয়ে নিজেদের দুর্বল করে ফেলেছে। ইসলামের রুপ ও সৌন্দর্যকে আধুনিক সভ্যতার চাদরে ঢেকে ফেলে আনুষ্ঠানিক ইবাদতে মত্ত হয়ে সালতানাত বেদ্বীন কাফিরদের হাতে তুলে দিয়েছে মুসলমানরা। হিন্দু, বৌদ্ধ , খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ হলেও আজ মুসলিমরা এক কুরআন ও হাদীসের অনুসারী হয়েও সামান্য বিষয়াদী নিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ ও বিভাজনে লিপ্ত, যা অতীব বেদনাদায়ক। নানা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে মুসলিমরা আজ বিচ্ছিন্নভাবে দিনাতিপাত করছেন । মুসলিম রাষ্ট্র হওয়া সত্বেও অপর মুসলিম রাষ্ট্যের উপর বর্বরোচিত হামলা করে আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করে মুসলমানদেরই হত্যাযজ্ঞ চালাতে দ্বিধা করছেন না। বর্তমান পৃথিবীতে প্রচলিত গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র ও স্বৈরাতন্ত্রের অনুসারী অন্তত ৬৫টি দেশে চলছে মানবাধিকার ও মানচিত্র দখলের যুদ্ধ চলছে। প্রতিনিয়ত বিশ্ব মোড়ল রাষ্ট্রগুলো ছোট ছোট রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রতিনিয়ত হামকি-ধুমকি দিচ্ছে, আণবিক, পারমাণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্রে ব্যবহারের। যে কারণে মুসলিম সাম্রাজ্য সমূহসহ সমগ্র বিশ^বাসী এক চরম ঝুঁকিতে দিনাতিপাত করছেন।

জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প- সাহিত্য, তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক যথেষ্ট সভ্যতার কারণেই বিংশ শতাব্দী আধুনিক সভ্য হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। কালে কালে নানা জ্ঞানের ব্যবহারের ফলে মানুষ পুর্বেকার তুলনায় যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধন করতে সক্ষম হয়েছে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও সংস্কৃতিতে একাভূতপূর্ব সফলতা লাভ করেছে এ শতাব্দীর মানবজাতি।এর পিছনে মহান সৃষ্টিকর্তার অনেক লীলাখেলা লুকায়িত রয়েছে।

কোনটা দৃশ্যমান আবার কোনটা অদৃশ্যমাণ বটে। মানব সৃষ্টির পর থেকেই তাদের কিসে কল্যাণ আর কিসে অকল্যাণ সাধন সম্ভব তা মহান সৃষ্টি কর্তা ছাড়া আর কেউ বেশি বুঝবে এটা স্বীকার্য নয়। তিনি মানবজাতিকে সৃষ্টির পর মহান সৃষ্টিকর্তা যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রাসুলকে প্রেরণ করেছেন। সতাদের জীবনের একমাত্র মিশন ছিল তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত সম্পর্কীয়।

পৃৃথিবীতে যত সম্পদ আছে, তন্মধ্যে মানবজাতি যেমন শ্রেষ্ঠ, তেমনি সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রাণি হিসেবেও জুড়ি নেই। মানুষ দিনেদিনে শিক্ষিত, জ্ঞানী ও ডিগ্রি অর্জন করলেই সভ্য হয়না, সভ্য হতে হলে মানুষের মন আর বিবেক টা যদি অশিক্ষিত থেকে যায় তাহলে এ প্রজাতির সভ্যতার পরাজয় অনিবার্য্য। এজন্য শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষনা ব্যবস্থাপনার টেকসই উন্নয়ন করা অনিবার্য্য হিসেবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া মানবসম্পদের বুনিয়াদী উন্নয়ন কোনকালেও সম্ভব নয়। শিক্ষা, সংস্কৃতি সাহিত্য দর্শন ও গবেষনা হলো বিপন্ন মানবতার অমানবিক রোগারোগ্যের প্রতিষেধক। যে দেশে, যে সমাজে এসব বিষয়ে উদাসিন ও অসতর্ক, সে দেশ তত পিঁছিয়ে এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত।

বর্তমান পৃথিবীতে লোভ হিংসা অহংকার, অমিতাচার অশ্লীলতা নেশা যৌনাচার রৌকিকতা, খুন গুম অত্যাচার অনাচার পূর্বের চেয়ে শতগুণে বেড়ে গেছে। সে সাথে ক্ষমতার দাম্ভিকতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, জরবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভিঘাতকেও হার মানিয়েছে। পৃথিবী ব্যাপি এখন একটাই শ্লোগান “বিপন্ন পৃথিবী- বাঁচাও মানব সভ্যতা”। কারণ এখনও পৃথিবীর বহুদেশে মারণাস্ত্রের যুদ্ধ চলছে। আণবিক পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে সমগ্র পৃথিবীর মানুষকে। অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক নীপিড়ণ, আর সাংস্কৃতির আগ্রাসন গোট পৃথিবীকে এক মহা গোলক ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। সূদ, ঘুষ, মাদক, অশ্লীল আকাশ অপসংস্কৃতির সয়লাব ভরে গেছে সমস্ত দুনিয়া। সর্বক্ষেত্রে নৈতিক অবক্ষয় আজ দৃশ্যমান।

দূর্নীতি আর অমাণবিক কর্মযজ্ঞ পৃথিবীর সমস্ত অর্জিত সভ্যতাকে ম্লান করে দিয়েছে। সকল সেক্টরে সৎ ও যোগ্য লোকের আজ দারুণ অভাব। জননিরাপত্তা ও মানবাধিকার আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এর প্রধান কারণ হলো, অধিকাংশ মানুষ তার সৃষ্টি কর্তাকে আদতে অস্বীকার করা শুরু করছে, তাঁর প্রদত্ত বিধানের পরিবর্তে মানবরচিত মতাদর্শকে প্রাধান্য দিতে শুরু করেছে। মুলত আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন যে, কী নিয়মে, কোন বিধানের আলোকে মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা করলে তাদের কল্যাণ হতে পারে।

অপরদিকে কী করলে মানুষের বিপদ আপদ ও অকল্যাণ নেমে আসতে পারে। এ বিষয়গুলো বিবেচনা করেই মহান স্রষ্টা যুগে যুগে অগণিত পথ প্রদর্শক বা বার্তাবাহককে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। সবশেষে এমন একজন পথপ্রদর্শক ও বার্তাবাহক পাঠিয়েছিলেন, যিনি মাত্র ২৩ বছরের ব্যবধানে একটি অসভ্য আরব্য ভূখণ্ডকে সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

মাত্র সাড়ে ২৩বছরে ওহীর মাধ্যমে নাযিলকৃত এ গ্রন্থের মূল আলোচ্য বিষয়গুলোকে মাত্র কয়েকটি শব্দে প্রকাশ করা যেতে পারে, তাহলো, তাওহীদ, রিসালাত, তাকওয়া, তামান্না, জান্নাত ও জাহান্নাম। অর্থাৎ একক, বার্তাবাহক,আত্মগঠন, প্রত্যশা ও আরাম-ব্যারাম। এ শব্দগুলোর বিষয়বস্তু বনি আদমকে বোঝাবার জন্যই মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কিতাব ‘কুরআন’ নাযিলের এর শুভ সূচনা করেন রমযান মাসের কদরের রাতে হেরা গুহায় ধ্যান মগ্নবস্থায় হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর উপর। এরপর থেকে মহান আল্লাহ তায়ালা সময় ও পরিস্থির আলোকে সর্বজনীন ও বিশ্বজনীন এই কুরআনের অংশবিশেষ নাযিল করতে থাকেন। সময়ের ব্যবধানে তা পুর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে বিদায় হজে¦র ভাষনের মাধ্যমে বার্তা বাহক ঘোষনা করেন। এরপর অল্প দিনের ব্যবধানে তিনি দুনিয়া থেকে চির বিদায় গ্রহণ করেন।

যাঁরা উপরোল্লিখিত শব্দের ব্যাখ্যা নিজেরা বুঝবেন এবং অপরকে বুঝাবার চেষ্টা করবেন এবং সে আলোকে নিজেদের জীবনকে পরিচালনার সংগ্রামে নিয়োজিত থেকে জীবনাতিবাহিত করবে, তাঁরাই মূলত বার্তাবাহক হযরত মুহাম্মাদের ওয়ারিশ বা অংশীদার। তাঁদের এবং তাদের অনুসারী হয়ে যারা দুনিয়ার জীবন যাপন করতে সচেষ্ট হবেন, তাদের জন্য রয়েছে মহান রবের নিকট মহাপুরস্কার চিরস্থায়ী জান্নাত বা আরামদায়ক ভূবন। আর যারা এর আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে বিপরীত জীবন যাপন করবে তাদের জন্য রয়েছে অস্থায়ী শাস্তি অথবা চিরস্থায়ী জাহান্নাম বা পীড়াদায়ক জগত। যা বার্তাবাহক মুহাম্মদ (সা:) ছাড়া পৃথিবীর আর কোন প্রাণি দেখা বা অনুভব করার ক্ষমতা রাখেন না। এখানেই সৃষ্টিকর্তার একক বাহাদুরী, যার সমকক্ষ আর কেউ নেই।

যারা এ ঐশি বিধানের অনুসারীদের উগ্রবাদী, মৌলবাদী ও ধর্মান্ধতার তকমাদিয়ে এক শ্রেণির ভোগবাদী, বস্তুবাদী, নাস্তিক্ববাদীরা নিজেদের খেয়াল খুশি মতো সংবিধান রচনা করে সে আলোকে জীবন যাপন করতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন, আদতে তারা মরিচিকায় পানি খুঁজে তা দিয়ে নিজেদের তৃষ্ণা নিবারণের বৃথা চেষ্টা করে চলেছেন শত শত বছর যাবত। মুলত আজ পর্যন্ত তারা কোন পানির সন্ধানও পায়নি, তৃষ্ণা মিটাবে পারেনি। পরিণতিতে ইহজগতে ও পরজনমে মহা সর্বনাশ ছাড়া আর কিছুই তাদের ভাগ্যে জুটেনি,জুটবেও না কোনদিন, না ইহজগতে না পরজগতে।

ইসলাম মূলত মানবজাতিকে সফলতার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে, ব্যর্থ হবার জন্য নয়। এ ব্যাপারে কী করণীয় কী বর্জনীয়, কীসে সফলতা কীসে বিফলতা, কীসে পুরস্কার, কীসে তিরস্কার, তা পরিস্কার করে তুলে ধরা হয়েছে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে। সেখানে তুলে ধরা হয়েছে সমগ্র মানবজাতির মানবাধিকারের সমস্ত বিষয়াদী। ইসলামে বৈরাগ্যপনা যেমন অনুমোদন করে না তেমনি লাগামহীন, নীতিহীন জীবন বা মানব রচিত মতবাদের অনুস্বরণ অনুকরণ করাকেও অনুমোদন করে না। মূলত মানুষের জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকার নিয়ামকের ওপর যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই ইসলাম। অসভ্যতা দূর করে ইনসাফ ও সভ্যতা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বা জিহাদই হলো ইসলামের মূল সুন্দর্য্য। প্রচলিত গণতন্ত্রের, সমাজতন্ত্রের তর্জন-গর্জন নয় বরং সত্যিকারের ইসলামী গণতন্ত্র ও সুশাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই ইসলামের আগমন ও অগ্রযাত্রা পৃথিবী সৃষ্টি থেকেই চলমান।

এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, মুসলিম উম্ম্াহর একমাত্র ঐক্যসূত্র হলো তাওহীদ। আর তাওহীদের মৌলিক ভাবার্থই হলো একমাত্র উপাস্য হিসেবে মহান আল্লাহতায়ালা ওপর পূর্ণ বিশ্বাস ও তার আদেশ, নিষেধ ও উপদেশের বিধি-বিধানকে মেনে চলার অভ্যাস করা।সর্বপরি মানবতাকে স্বমহিমায় বিকশিত করার জন্য ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের মূলোৎপাটন করা। এ মিশন প্রথমধাপে সফল হয়েছিল হযরত ওমর (রা:) এর শাসনের আমলে। এখন থেকে একটানা ৫শ বছর এবং তার পর থেকে মুসলিম মিল্লাত এ বিশ্বকে শাসন করেছে ৯শ বছর ।পরবর্তীতে সে সোনালী সালতানাত হাতছাড়া হয়েছে নামধারী একশ্রেণির বিকৃত মুসলমান শাসকদেরই কর্তৃক। যার কারণে মুসলমানরা এক অনিবার্য ধ্বংসের কিনারব্দি পৌঁছে গেছে। এর প্রধান কারণ হলো মুসলমানদের অনৈক্য।

ইসলামের মূল বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে তেমন কোন বিরোধ না থাকলেও খুঁটি-নাটি আকিদা ও মান্হায গত বিরোধের কারণে নানা দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। মুসলিম শাসকরা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য ইহুদী -নাসারাদের সাথে আঁতাত করতে গিয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছে। ফলে ইসলামী সালতানাতের মহা বিপর্যয় হয়ে পরজীবির মতো বেঁচে আছে ইসলাম। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, মুসলিম জাতির প্রথম কিবলা ইসলামী সভ্যতার নিদর্শন এবং ইসলামের বহু ইতিহাসের স্বাক্ষর, জেরুজালেমের মসজিদুল আকসা বা ‘বায়তুল মুকাদ্দাস’ ইহুদী চক্রের ষড়যন্ত্রের কারণে মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।

এ পরাজয় থেকে উত্তোরণের উপায় বের করতে না পারলে মুসলমানদের অনাগত ভবিষ্যত আরও ভয়াবহ রুপ ধারন করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। সুতরাং অভ্যন্তরীণ ভেদাভেদ ভূলে গিয়ে ইসলামের স্বার্থে, মুসলমানদের অস্তিত্বেও স্বার্থে এবং সর্বপরি মানবজাতির স্বার্থে মুসলমানদের এক প্লাটফরমে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আধুনিক ও প্রযুক্তিগত পদ্ধতি গণতন্তের ভোট জিহাদে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে অবতীর্ণ হতে হবে। শোষণ, বৈষম্য অনৈতিকতা ও দু:শাসন ও স্বৈরশাসন ব্যবস্থা দূর করতে হলে আপাদত এর কোন বিকল্প নেই। অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ, চরিত্রহীন মানুষের নেতৃত্বের পরিবর্তে আধুনিক গণতন্ত্রের ব্যালট জিহাদ একটি রক্তপাতহীন জিহাদ। এ জিহাদে বা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা প্রতিটি মুসলমানদের জন্য সাধারণ জিহাদই নয় বরং অত্যাধুনিক যুগোপযুগি অত্যাবশ্যক জিহাদ।

কারণ একটি কল্যাণ রাষ্ট্র কায়েম ও পরিচালনার জন্য মানুষের মতামত ও রায় প্রকাশের উত্তম মাধ্যম হলো গণতন্ত্র বা গণরায়। এ রায় অর্জনের জন্যই রাসূল (সা:) সুদীর্ঘ তেইশ বছর মেহনত করেছেন। এর বাইরে যারা বিকল্প ধারা বা পদ্ধতি নিয়ে চিন্তা করেন, তারা ইসলামের কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। এবিষটি যতদিন খেদমতে দ্বীনের অনুসারীরা উপলব্দি করতে সক্ষম না হবেন, ততদিন ইসলামের বিজয় অনেকাংশে বিলম্বিত হতে পারে।আবার এটাও মনে রাখতে হবে, উগ্রবাদ বা জঙ্গিবাদ বা অস্ত্রের ভয় ভীতি দেখিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা ইসলাম অনুমোদন করে না।

হযরত আদম (আ:) থেকে শুরু করে পৃথিবীতে যত মহাসম্মানিত নবী ও রাসূল এবং পরবর্তীতে মুজদ্দিদে ইমাম গাজ্জালী, ইমাম আলফিসানী, শাহ অলিউল্লাহ, সাইয়েদ আহমদ বেরিলভী, শাহ ইসমাইল শহীদ, হাসানুল বান্না, সাইয়েদ কুতুব, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী রাহিমাহুল্লাহ্ এর জীবনের মিশনই ছিল মানুষের মনের জমিনে বা অন্তরে অন্তরে সভ্যতার ফসল ফলিয়ে কামিলে ইনসানিয়াতের নৈতিক গুণসম্পন্ন একদল খাঁটি সোনার মানুষ তৈরী করা, যাদের মাধ্যমে দুনিয়াতে রবের শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা সহজতর হয়।

কারণ নৈতিক ব্যবস্থার ওপর একটি জাতির ভিত্তি নির্মাণ হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে প্রথমেই বিশ্ব শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলাম আধুনিকভাবে ঢেলে সাঁজাতে হবে। তবেই সভ্যতা সাংস্কৃরি ভীত মজবুত ও সমৃদ্ধ হবে এবং চিন্তা রাজ্যে সক্রিয় সংস্কার বিপ্লব সাধিত হবে। একাজটি সম্পাদনের জন্যই ধারাবাহিকভাবে নবী ও রাসূলগণকে দুনিয়াতে প্রেরণ করা হয়েছে। যাদের প্রধানতম মিশন ছিল হুকুমতে ইলাহিয়াত বা ইসলামী সালতানাত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি কল্যাণকর বিশ্ব বিনির্মাণ করা। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঠিক পথে পরিচালানা করুন এবং ইসলামের বিজয় দান করুন। আ-মীন।

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।