বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিডা) উদ্যোগে আয়োজিত চারদিনব্যাপী ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট, ২০২৫’ গত ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয়েছে। সম্মেলন ৭ এপ্রিল শুরু হয়েছিল। বিনিয়োগ সম্মেলন আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূস। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যাবার পর মুক্ত পরিবেশে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নানা কারণেই বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিদেশি বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের হার আশাপ্রদ নয়। প্রায় দু’দশক যাবৎ ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২২/২৩ শতাংশে উঠানামা করছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও তা অর্জিত হয়নি। চলতি অর্থবছরে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির হার ২৭ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে। এটা নিশ্চিতভাবেই ব্যর্থ হবে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ব্যক্তি খাতে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের মাত্রা যেমন কমেছে তেমনি বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগের হারও নিম্নমুখী রয়েছে। স্থানীয় উদ্যোক্তাগণ ক্রমশ বিনিয়োগের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। বিগত সরকার আমলে একশ্রেণির দুর্বৃত্ত সরকারি ছত্রছায়ায় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে তা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতেন। অনেকেই তা বিদেশে পাচার করেতেন। সরকার সমর্থক গোষ্ঠীকে ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অর্থ হাতিয়ে নেবার সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য ব্যাংক ঋণের সুদের হার অনেক দিন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে নির্ধারণ করে রাখা হয়েছিল। অথচ করোনা উত্তর অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেলেও ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজারভিত্তিক করা হয়নি। এ সুযোগে সরকার সমর্থক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বের করে নিয়ে যায়।

আগের এক মুদ্রানীতিতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। অথচ সে সময় প্রকৃত অর্জনের হার দাঁড়িয়েছিল ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দশমিক ৬ শতাংশ বেশি অর্জিত হয়েছিল। অথচ একই সময়ে শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছিল ১৪ শতাংশ করে। আর ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি কমেছিল ৭৬ শতাংশ। তাহলে এ বিপুল পরিমাণ ব্যাংক ঋণের অর্থ কোথায় গেলো? এ ব্যাংক ঋণের অর্থ আসলে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়েছিল। সর্বশেষ ব্যক্তিখাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ, যা সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে কম।

ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের অবস্থা বর্তমানে খুবই খারাপ পর্যায়ে রয়েছে। এমনি এক অবস্থায় ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট, ২০২৫’ আয়োজন নানা কারণেই ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিদেশি বিনিয়োগ সাধারণত দু’ভাবে আহরিত হতে পারে। প্রথমত, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আহরণ অর্থাৎ বিদেশি উদ্যোক্তাগণ সরকারের অনুমতি গ্রহণসাপেক্ষে বিভিন্ন প্রকল্প স্থাপন করতে পারেন। আবার স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যৌথভাবে বিনিয়োগের মাধ্যমে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে পারেন। যে ভাবেই হোক বিদেশি বিনিয়োগ আহরিত হলে তা নানাভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগে। রিজার্ভ তৈরিতেও বিদেশি বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বাংলাদেশ নানা কারণেই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় গন্তেব্যে পরিণত হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে বিদ্যমান বিনিয়োগ পরিবেশ মোটেও সন্তোষজনক নয়। নানা ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এদেশে বিনিয়োগ করা খুবই কষ্টদায়ক একটি কাজ। বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি স্টার্ট বিজনেস সূচক প্রকাশ করেছে। ৫০টি দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ পর্যালোচনা করে প্রণীত এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান দেখানো হয়েছে চতুর্থ গ্রেডে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোনো দেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে এসব প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে থাকে। তাই বাস্তব বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নই এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। শুধু বিনিয়োগ সম্মেলন করে কোনো লাভ হবে না। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের কোনো বিকল্প নেই।

এবার বিনিয়োগ সম্মেলনে যেসব বিদেশি বিনিয়োগকারী অংশ গ্রহণ করেছিলেন তাদের বক্তব্য ছিল খুবই ইতিবাচক। তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী, তবে তারা নীতির ধারাবাহিকতা দেখতে চান। সরকার পরিবর্তিত হলেই যাতে বিনিয়োগ নীতিমালার পরিবর্তন না ঘটে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট, ২০২৫’ সফলভাবে সম্পন্ন করার পর বিডার উদ্যোগে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে জানানো হয় বিনিয়োগ সম্মেলন অত্যন্ত সফল হয়েছে। বেশ কিছু নতুন বিনিয়োগের প্রস্তাব পাওয়া গেছে। বিশেষ করে চীনের বিনিয়োগকারীগণ বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিডার উদ্যোগে বিনিয়োগ আহরণের জন্য রোডম্যাপ তৈরি করা হবে। যারা বিনিয়োগের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা হবে। চীনা বিনিয়োগকারীগণ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে আগ্রহ প্রকাশ করার নানা কারণ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি প্রায় ৬০টি দেশের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বর্ধিত শুল্কারোপ করেছে। ব্যাপক সমালোচনার মুখে মার্কিন প্রশাসন তিন মাসের জন্য বর্ধিত শুল্ক হার প্রয়োগ স্থগিত করেছে। কিন্তু চীনের ক্ষেত্রে এই স্থগিতাদেশ কার্যকর হবে না। চীনকে এখন থেকেই বর্ধিত হারে শুল্ক প্রদান করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ধিত শুল্কারোপের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে চীন মার্কিন পণ্যের উপর বর্ধিত হারে শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে বর্ধিত শুল্কারোপ নিয়ে বর্তমানে তিক্ততা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে আমদানিকৃত পণ্যের উপর ১৪৫ শতাংশ শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর প্রতিবাদে চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যের উপর ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ১৮টি প্রতিষ্ঠানের উপর চীন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। একইভাবে হলিউডের চলচিত্র আমদানির উপরও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতদিন সংগোপনে বাণিজ্য যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল এখন তা প্রকাশ্যে চলে এলো। বর্ধিত শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিমালা এটাই প্রমাণ করেছে যে, তাদের এই বর্ধিত শুল্কারোপের সিদ্ধান্তের মূল টার্গেট হচ্ছে চীন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্ধিত হারে শুল্কারোপের ঘোষণা দেবার পরই বিশ্বব্যাপী এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। একদিনের ব্যবধানে বিশ্বের শীর্ষ ধনকুবেরগণ ২০৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম্পদ হারিয়েছেন। আগামীতে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বর্ধিত শুল্কারোপ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা বাংলাদেশের জন্য শুভ হতে পারে। যেহেতু কোনো এক বা দুটি দেশের উপর বর্ধিত শুল্কারোপ করা হচ্ছে না তাই প্রতিটি দেশের রপ্তানিকারকগণই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চীনের সঙ্গে বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্ক অত্যন্ত ইতিবাচক। এই অবস্থায় বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য-বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। চীনা পণ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ধিত শুল্ক পরিশোধ করে প্রবেশ করতে হবে বিধায় চীনা পণ্য রপ্তানি কমে যেতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে চীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিযোগী দেশ। চীনা পণ্যের বাংলাদেশি পণ্যের উপর তুলনামূলক কম শুল্কারোপ করা হবে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাগণ বাংলাদেশি পণ্য ক্রয়ে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। চীনের ছোট ছোট শিল্পগুলো ভিন্ন গন্তব্যে সরিয়ে নেয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশ থাকবে তাদের পছন্দের শীর্ষে। বাংলাদেশ যদি চীনা বিনিয়োগ এবং কারখানাগুলো বাংলাদেশে সরিয়ে আনার ব্যাপারে উদ্যোগী হয় তাহলে ভালো ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।

কিন্তু বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেবে অন্যত্র। বাংলাদেশ আগামী বছর উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হতে যাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সব ধরনের অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা হারাবে। বিশেষ করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেয়া জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার নিয়ে। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবার পরও ২০২৯ সাল পর্যন্ত তারা জিএসপি সুবিধা প্রদান করবে। তারপর ইউরোপীয় ইউনিয়ন জিএসপি+ নামে নতুন ধরনের শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করবে। কিন্তু সে সুবিধা পাবার জন্য যেসব শর্ত পরিপালন করতে হবে বাংলাদেশের পক্ষে তা সম্ভব হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও অনেক বেশি বাংলাদেশি পণ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে রপ্তানি করা হয়। অর্থনীতিবিদ এবং রপ্তানিকারকগণ অনেক দিন ধরেই রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ ও রপ্তানি গন্তব্যের বৈচিত্র্য আনায়নের উপর গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে এ ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য তৈরি পোশাকের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। কিন্তু তৈরি পোশাক শিল্প জাতীয় অর্থনীতিতে তুলনামূলক কম মূল্য সংযোজন করে। তৈরি পোশাকের কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ফলে এ শিল্প জাতীয় অর্থনীতিতে তুলনামূলকভাবে কম মূল্য সংযোজন করে। বিপরীত দিকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় তার প্রায় পুরোটাই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করে। কারণ এই খাতের কোনো কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় না। কোনো কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প খাত বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে পুরো রপ্তানি বাণিজ্য ধ্বসে পড়বে।

বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য সীমিত সংখ্যক দেশের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের উপর নির্ভর করে টিকে আছে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য। আগামীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি বিঘ্নিত হলে পুরো রপ্তানি খাত ভেঙ্গে পড়বে। এর লক্ষণ ইতিমধ্যেই দেখা দিতে শুরু করেছে।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার।