জাফর আহমাদ

“বলো! আমি আশ্রয় চাচ্ছি মানুষের রব, মানুষের অধিপতি, মানুষের ইলাহ-এর কাছে “খান্নাস তথা প্ররোচনা দানকারীর অনিষ্ট থেকে যে বার বার ফিরে আসে, যে মানুষের মনে প্ররোচনা দান করে, সে জিনের মধ্য থেকে হোক বা মানুষের মধ্য থেকে।” (সুরা নাস)

খান্নাসের ওয়াসওয়াসাহ এর অনিষ্টতা থেকে আশ্রয় চাই। আরবী খান্নাস এর মূল হচ্ছে খুনুস, খুনুস এর মানে প্রকাশিত হবার পর আবার গোপন হওয়া অথবা সামনে আসার পর আবার পিছিয়ে যাওয়া। খান্নাস শব্দটি ইসমে ফায়েল মুবালেগা অর্থাৎ বেশী ও অত্যাধিক বৃদ্ধির অর্থবোধক শব্দ তাই এর অর্থ হয় প্ররোচনার কাজটি বেশী বেশী বা অত্যাধিক সম্পন্নকারী। ওয়াসওয়াসাহ অর্থ প্ররোচনা এবং ওয়াসওয়াস মানে প্ররোচক বলা হয়। প্ররোচনাদানকারীকে প্ররোচনা দেবার জন্য বারবার মানুষের কাছে আসতে হয়। তাই প্ররোচকের সাথে খান্নাস মিলিত হয়ে আপনা আপনি এ অর্থ সৃষ্টি করেছে যে, প্ররোচনা দান করতে সে পিছনে সরে যায় এবং তারপর প্ররোচনা দেবার জন্য আবার বারবার ফিরে আসে। অন্য কথায় একবার তার প্ররোচনা দান করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর সে ফিওে যায়। তারপর সে প্রচেষ্টা চালাবার জন্য বারবার সে ফিরে আসে।

“বারবার ফিরে আসা প্ররোচনাকারীর অনিষ্ট” এর অর্থ বুঝে নেয়ার পর এখন তার অনিষ্ট থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করার অর্থ কি, এ কথা আমাদেরকে চিন্তা করতে হবে এবং বুঝতে হবে। এর একটি অর্থ হচ্ছে, আশ্রয় প্রার্থনাকারী নিজেই তার অনিষ্ট থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছে। অর্থাৎ এ অনিষ্ট যেন তার মনে কোন প্ররোচনা সৃষ্টি করতে না পারে। আর এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর পথের আহবানকারীদের বিরুদ্ধে যে ব্যক্তিই লোকদের মনে কোন প্ররোচনা সৃষ্টি করে বেড়ায় তার অনিষ্ট থেকে আহবায়ক আল্লাহর আশ্রয় চায়। সত্যের আহবায়কের ব্যক্তি সত্ত্ার বিরুদ্ধে যেসব লোকের মনে প্ররোচনা সৃষ্টি করা হচ্ছে আহবায়কের নিজের পক্ষে তাদের প্রত্যেকের কাছে পৌঁছে খুঁটে খুঁটে তাদেও প্রত্যেকের বিভ্রান্তি দূর করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করার কাজ বাদ দিয়ে প্ররাচনাকারীদের সৃষ্ট বিভ্রান্তি দূও করার এবং তাদের অভিযোগের জবাব দেবার কাজে আত্মনিয়োগ করাও তার পক্ষে সঙ্গত নয়। তার বিরুদ্ধবাদীরা যে পর্যায়ে নেমে এসেছে তার নিজের পক্ষেও সে পর্যায়ে নেমে আসা তার মর্যাদার পরিপন্থী। তাই মহান আল্লাহ সত্যের আহবায়কদের নির্দেশ দিয়েছেন, এ ধরনের অনিষ্টকারীদের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর শরণাপন্ন হও এবং তারপর নিশ্চিন্তে নিজেদেও দাওয়াতের কাজে আত্মনিয়োগ করো। এরপর এদের মোকাবেলা করা তোমাদের কাজ নয়, রাব্বুন নাস, মালিকুন নাস ও ইলাহুন নাস সর্বশক্তিমান আল্লাহরই কাজ।

এ প্রসংগে একথাটিও অনুধাবন করতে হবে যে,ওয়াসওয়াসাহ বা প্ররোচনা হচ্ছে অনিষ্ট কর্মের সূচনা বিন্দু। যখন একজন অসতর্ক বা চিন্তাহীন মানুষের মনে তার প্রভাব পড়ে, তখন প্রথমে তার মধ্যে অসৎকাজ করার আকাংখা সৃষ্টি হয় তারপর আরো প্ররোচনা দান করার পর এ অসৎ আকাংখা অসৎ ইচ্ছায় পরিণত হয়। এরপর প্ররোচনার প্রভাব বাড়তে থাকলে আরো সামনের দিকে গিয়ে অসৎ ইচ্ছা অসৎ সংকল্পে পরিণত হয়। আর তারপর এর শেষ পদক্ষেপ হয় অসৎ কর্ম। তাই প্ররোচনাদানকারীর অনিষ্ট থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাওয়ার অর্থ হবে, অনিষ্টের সূচনা যে স্থান থেকে হয়, আল্লাহ যেন সে স্থানেই তাকে নির্মূল করে দেন।

খান্নাস-এর প্ররোচনা বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। বিভিন্নভাবে সে নতুন নতুন কৌশল নিয়ে আর বার বার ফিরে আসে। কোন এক কৌশল ব্যর্থ হলে সে নতুন কৌশল প্রয়োগ করে। প্রথমে সে খোলাখুলি কুফরী, শিরক, নাস্তিকতা বা আল্লাহ ও রাসুলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং আল্লাহপন্থীদের সাথে শত্রুতার উস্কানী দেয়। এতে ব্যর্থ হলে এবং মানুষ আল্লাহর দীনের মধ্যে প্রবেশ করে গেলে, সেও দীনে প্রবেশ করে এবং দীনের হিতাকাংঙী সেজে কোন না কোন বিদআতের পথ অবলম্বনের প্ররোচনা দেয়। এতেও ব্যর্থ হলে তাকে গোনাহ করতে উদ্ধুদ্ধ করে। এখানেও সফলতা অর্জনে সক্ষম না হলে মানুষের মনে এ চিন্তার যোগান দেয় যে, ছোট ছোট সামান্য দু’চারটে গোনাহ করে নিলে তো কোন ক্ষতি নেই। অর্থাৎ এভাবে এ ছোট গোনাহ-ই যদি বিপুল পরিমাণে করতে থাকে তাহলে বিপুল পরিমাণ গোনাহে মানুষ ডুবে যাবে। এ থেকেও যদি মানুষ পিঠ বাঁচিয়ে আসতে পারে তাহলে শেষমেশ সে চেষ্টা করে মানুষ যেন আল্লাহর সত্য দীনকে শুধুমাত্র নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে, কিন্তু যদি কোন ব্যক্তি এ সমস্ত কৌশল ব্যর্থ করে দেয় তাহলে জিন ও মানুষ শয়তানদের সমস্ত দল তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার বিরুদ্ধে লোকদেরকে উস্কানী ও উত্তেজিত করতে থাকে। তার প্রতি ব্যাপকবাবে গালিগালাজ ও অভিযোগ-দোষারোপের ধারা বর্ষণ করতে থাকে। চতুর্দিক থেকে তার দুর্নাম রটাবার ও তাকে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করতে থাকে। তারপর খান্নাস শয়তান সে মর্দে মু’মিনকে ক্রোধান্বিত করতে থাকে। সে বলতে থাকে, এসব কিছু নীরবে সহ্য করে নেয়া তো বড়ই কাপুরুষের কাজ। ওঠো, এ আক্রমনকারীদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হও। সত্যের দাওয়াতের পথ রুদ্ধ করার এবং সত্যের আহবায়কদেরকে পথের কাঁটার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত করার জন্য এটি খান্নাস বা শয়তানের শেষ অস্ত্র। সত্যের আহবায়ক এ ময়দান থেকেও যদি বিজয়ীর বেশে বের হয়ে আসে তাহলে শয়তান তার সামনে নিরুপায় হয়ে যায়।

এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “যদি তোমরা শয়তানের পক্ষ থেকে কোন প্ররোচনা আঁচ করতে পারো তাহলে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করো। তিনি সব কিছু শোনেন এবং জানেন।” (সুরা হামিম আস সাজদা : ৩৬) শয়তান যখন দেখে হক ও বাতিলের লড়াইয়ে ভদ্রতা ও শিষ্টাচার দ্বারা হীনতার এবং সুকৃতির দ্বারা দুস্কৃতির মোকাবেলা করা হচ্ছে তখন সে চরম অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যায়। সে চায় কোনভাবে একবারের জন্য হলেও হকের জন্য সংগ্রামকারী বিশেষ করে তাদের বিশিষ্ট লোকজন ও নেতৃবৃন্দের দ্বারা এমন কোন ত্রুটি সংঘটিত করিয়ে দেয়া যাতে সাধারণ লোকদেরকে বলা যায়, দেখুন খারাপ কাজ এক তরফ থেকে হচ্ছে না। এক পক্ষ নীচ ও জঘন্য কাজ করছে বটে কিন্তু অন্য পক্ষও তো কম যায় না। শয়তান দ্বারা প্ররোচিত মানুষের ন্যাচার হলো, সত্য পথের সংগ্রামকারী যদি একবার পা পিছলে যায় তবে সেটিকে খুব বড় দেখে বা শয়তান বড় করে দেখায়। তখন মানুষ এক পক্ষের অত্যাচার ও বাড়াবাড়ি এবং অপর পক্ষের জবাবী তৎপরতার মধ্যে ইনসাফের সাথে তুলনামূলক বিচারের যোগ্যতা থাকে না।

এ জন্য বলা হয়েছে, শয়তানের প্রতারণার ব্যাপারে সাবধান থাকো। সে অত্যন্ত দরদী ও সঙ্গকামী সেজে এ বলে তোমাদেরকে উত্তেজিত করবে যে, অমুক অত্যাচার কখনো মেনে নেয়া উচিত হবে না, বরং এর দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া উচিত এবং এ আক্রমনের সমুচিত জবাব দেয়া প্রয়োজন। ইমাম আহমাদ তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে হযরত আবু হুরাইরা (রা:) থেকে যে ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন সেটি এ বিষয়ের সর্বোত্তম ব্যাখ্যা। তিনি বলেন: নবী (সা:) এর সামনে একবার এক ব্যক্তি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:)কে অকথ্য গালিগালাজ করতে থাকলো। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) চুপচাপ তার গালি শুনতে থাকলেন আর তাঁর দিকে চেয়ে নবী (সা:) মুচকি হাসতে থাকলেন। অবশেষে হযরত আবু বকর (রা:) ধৈর্য হারিয়ে ফেললেন এবং জবাবে তিনিও তাকে একটি কঠোর কথা বলে ফেললেন। তার মুখ থেকে সে কথাটি বের হওয়া মাত্র নবী (সা:) এর ওপর বিরক্তিভাব ছেয়ে গেল এবং তা তাঁর পবিত্র চেহেরায় ফুটে উঠতে থাকলো। তিনি তখনই উঠে গেলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:)ও উঠে তাঁকে অনুসরণ করলেন এবং পথিমধ্যেই জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কী? সে যখন আমাকে গালি দিচ্ছিল তখন আপনি চুপচাপ মুচকি হাসছিলেন। কিন্তু যখনই আমি তাকে জবাব দিলাম তখনই আপনি অসন্তুষ্ট হলেন। সবী (সা:) বললেন: তুমি যতক্ষণ চুপচাপ ছিলে ততক্ষণ একজন ফেরেশতা তোমার সাথে ছিল এবং তোমার পক্ষ থেকে জবাব দিচ্ছিলো। কিন্তু যখন তুমি নিজেই জবাব দিলে তখন ফেরেশতার স্থানটি শয়তান দখল করে নিল। আমি তো শয়তানের সাথে বসতে পারি না।” (হাদীস নং ৪৮৯৬, কিতাবুল আদাব, বাবুল ইনতেসার)

আল কুরআনে বলা হয়েছে যে, মন্দের জবাব যেন মন্দ দ্বারা দেয়া না হয় বরং ভালো কিছু জবাব দিবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “(হে মুহাম্মদ!) মন্দকে দূও করো সর্বোত্তম পদ্ধতিতে। তারা তোমার সম্পর্কে যেসব কথা বলে তা আমি খুব ভালো করেই জানি। আর দোয়া করো, “হে আমার রব! আমি শয়তানের উস্কানি থেকে তোমার আশ্রয় চাই। (এমনকি হে রব!) সে আমার কাছে আসুক এ থেকেও তোমার আশ্রয় চাই।” (সুরা মু’মিনুন : ৯৬-৯৮)

আল্লাহ তা’আলা বলেন, “যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের অবস্থা এমন হয় যে, কখনো শয়তানের প্রভাবে কোন অসৎ চিন্তা তাদেরকে স্পর্শ করলেও সঙ্গে সঙ্গেই সজাগ হযে যায় এবং তারপর তারা নিজেদের সঠিক কর্মপদ্ধতি পরিস্কার দেখতে পায়। আর তাদের (অর্থাৎ শয়তানের) ভাই-বুন্ধুরা তো তাদেরকে তাদের বাঁকা পথেই টেনে নিয়ে যেতে থাকে এবং তাদেরকে বিভ্রান্ত করার ব্যাপারে তারা কোন ত্রুটি করে না।” (সুরা আরাফ : ২০১-২০২) এ আয়াতগুলোতে নবী (সা:)কে প্রচার পথ নির্দেশনা দান সংস্কার ও সংশোধন কৌশলের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানিয়ে দেয়া হয়েছে। কেবল নবী (সা:) কে নয় বরং যারাই নবী (সা:)-এর মিশন বাস্তবায়নের স্থলাভিষিক্ত হবেন তাদের জন্যও একই কৌশল প্রযোজ্য। এই কৌশল প্রয়োগ করে শয়তানের প্ররোচনাকে ব্যর্থ করতে হলে সত্যের আহবায়ককে কোমল স্বভাবের সহিষ্ণু ও উদার হৃদয়, নিজের সঙ্গী-সহযোগীদের জন্য স্নেহশীল, সাধারণ মানুষের জন্যে দয়াদ্র হৃদয় এবং সিজের বিরোধীদের জন্যে সহিষ্ণু হতে হবে। বিরোধীদের চরম ও কঠোর ব্যবহারকে সহ্য করতে হবে। চরম উত্তেজনার মুহূর্তেও নিজের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। আর এ জন্যই যারা শয়তানের এই অস্ত্রেও আঘাতও ব্যর্থ করে দিয়ে সফলকাম হয়ে বেরিয়ে আসে তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, “অতি সৌভাগ্যবান ব্যক্তিরা ছাড়া আর কেউ এ জিনিস লাভ করতে পারে না।” (হামীম আসসাজদা : ৩৫)

এ প্রসংগে আরো একটি কথাও মনে রাখতে হবে। সেটি হচ্ছে, মানুষের মনে কেবল জিন ও মানুষ দলভুক্ত শয়তানরাই বাইর থেকে প্ররোচনা দেয় না বরং মানুষের ভেতরকার নিজের নফসও প্ররোচনা দেয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর আমি তাদের নাফস থেকে উদ্বুদ্ধ প্ররোচনাসমূহ জানি।” (সুরা কাফ : ১৬) এ কারণেই রাসুলুল্লাহ (সা:) তাঁর এক বহুল প্রচারিত ভাষণে বলেন: আমরা নফসের অনিষ্টকারিতা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাচ্ছি।”

লেখক : ব্যাংকার।