পাঠকদের অনেকেরই হয়তো গগনমুচির বাবার শ্রাদ্ধের গল্পটি মনে থাকতে পারে। তবুও আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। গগন দরিদ্র পিতার একমাত্র সন্তান ছিল, জাতে মুচি। অভাব-অনটন তার সংসারে লেগেই থাকত। জুতা সেলাই করে দু’চার পয়সা যা রোজগার করত তা দিয়ে কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে তার সংসার চলত। বৃদ্ধ বাবার রোজগার ছিল না। একবার গ্রামে গরু-ছাগলের মড়ক দেখা দিল। এতে কৃষক পরিবারে হাহাকার উঠল, তবে গগনের ভাগ্য খুলে গেল। সেদিন রাতে মরা গরু-ছাগলের চামড়া খুলে বাজারে বিক্রি করতে শুরু করল। তার প্রচুর উপার্জন হলো। সংসারের অভাব বিদায় নিল। বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে এবং বউ সবার শখ-আল্লাদ সে পূরণ করল। নিজের জন্য অরবিন্দ অদ্দির ধূতি-পঞ্চাবিও কিনল। ভাঙা ঘর আর থাকল না। তার জায়গায় টিনের ঘর উঠল। গগনের অবস্থা এখন রমরমা। কিন্তু তাহলে কী হবে? সামাজিক প্রতিষ্ঠা না থাকায় গগনকে এখনো সবাই মুচি বলে ডাকে, সভা মজলিসে গেলে কেউ দাঁড়িয়ে সম্মান দেখায় না; রাস্তায় দেখলে আদাবও দেয় না। গগনের মাথায় চিন্তা ঢুকল কিভাবে জাতে ওঠা যায়। দিন-রাত জাতে ওঠার স্বপ্ন মাথায় তার কিলবিল করতে লাগল। এ সময় তার বৃদ্ধ বাবা স্বর্গে চলে গেলেন।

গগন ভাবল এই তো মহাসুযোগ। মহা ধুমধামের সাথে বাবার শ্রাদ্ধ করতে পারলেই তো সামাজিক প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে। গগন কাজে লেগে গেল। সকল ধর্মের, সকল শ্রেণির লোককে সে নিমন্ত্রণ করল। শ্রাদ্ধ পড়ানোর জন্য পুরোহিতকেও নিমন্ত্রণ জানানো হলো। পুরোহিতের পরামর্শ অনুযায়ী দুটো নতুন পিড়ি কেনা হলো। নাপিত ডাকা হলো। শ্রাদ্ধ পড়ানোর জায়গা গোবর-চুনা দিয়ে লেপে-মুছে রাখা হলো। শ্রাদ্ধ পড়ানোর বিনিময়ে ঠিক হলো পুরোহিতকে আতপ চাল, কাঁচকলা এবং এক জোড়া গারদের ধূতি এবং কিছু নগদ টাকা দেয়া হবে। নির্ধরিত দিনে শ্রাদ্ধ পড়ানো শুরু হলো। পুরোহিত ঠাকুর এক পিড়িতে বসলেন। অন্য পিড়িতে বসল গগন। তার ছিল মাথা মুড়ানো। ঠাকুর গগনকে বললেন,্ আমি যা যা বলব তুইও তা তা বলবি এবং করবি। অন্যথা হলে শ্রাদ্ধ হবে না। তখন তোর ক্ষতি হবে। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রাদ্ধ শুরু হলো।

ঠাকুর বললেন বল, নমঃ। গগন বলল, বল নম;। টাকুর বললেন, না, শুধু বল নমঃ। ঠাকুর বললেন, ওরে বেটা, শুধু বল নমঃ। গগন বলল, ওরে বেটা শুধু বল নমঃ। ঠাকুর বললেন, মহা বিপদে পড়লাম ছোট জাত নিয়ে। গগন বলল মহাবিপদে পড়লাম ছোট জাত নিয়। ঠাকুর বললেন, হারামজাদা মারবো গালে এক চড়। গগন বলল, হারামজাদা মারবো গালে এক চড়।

এ অবস্থায় পুরোহিত ঠাকুর সাংঘাতিকভাবে রেগে যান। তিনি গগনের কান ধরে টান দেন। গগনও টাকুরের অনুসরণ করে তার কান টানাটানি শুরু করে এবং এভাবে শুরু হয় শ্রাদ্ধের শ্রাদ্ধ। কান টানাটানি থেকে জড়াজড়ি, মারামারি এবং গড়াগড়ি। শেষ পর্যন্ত গড়াগড়ি খেতে খেতে দু’জনই গিয়ে পড়লো ঘরের পেছনের পায়খানার গর্তে। গগন ও ঠাকুর মশাই দু’জনই পায়খানা আর ময়লা-আবর্জনা পা থেকে মাথা পর্যন্ত মেখে ক্লান্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল।

ঠাকুর দুঃখ করে বললেত লাগলেন ছোট জাত মুচির শ্রাদ্ধ করতে এসে মানসম্মান সবই হারালাম। তার কথা শুনে গগন মুচিও নাকের পানি চোখের পানি একত্র করে কাতর কণ্ঠে বলতে লাগল, ঠাকুর মশাই যদি জানতাম বাবার শ্রাদ্ধ এতদূর গড়াবে তাহলে টাট্টি পর্যন্ত গোবর দিয়ে লেপে পুতঃপবিত্র করে রাখতাম।

৩৬ জুলাই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী অবস্থা দেখে গগন মুচির বাবার শ্রাদ্ধের এ গল্পটি আমার মনে পড়ল। গগন মুচি সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য তার পিতার শ্রাদ্ধ করতে চেয়েছিল। আমাদের একটি রাজনৈতিক দল সামাজিক ও বৈষয়িক প্রতিষ্ঠার জন্য জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের অধিকার হরণ করে তার প্রতিবেশী ঠাকুরের পরামর্শ অনুযায়ী বাবার শ্রাদ্ধের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট করে ২০ কোটি মানুষের একটি সাম্রাজ্যের সম্রাট/সম্রাজ্ঞী বনতে চেয়ে গড়াগড়ি খেয়ে আবর্জনার স্তূপে পড়ে সব হারিয়েছে। এ অবস্থায় আরেকটি দলও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচনের আগেই শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের কাজে লেগে পড়ে গড়াগড়ি খেতে শুরু করেছে বলে মনে হয়।

প্রথমোক্ত দলটির প্রধানসহ রাষ্ট্র পরিচালনা ও লুটপাটের সাথে সম্পৃক্ত হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে এখন মামলা; হত্যা, গুম, খুন, দুর্নীতি, দুঃশাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধে তারা অপরাধী। তারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ, কোর্ট-কাচারি, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সবকিছুকেই ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেছিলেন। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলসমূহের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রহসনের মামলায় নিজেরা রায় লিখে বিচারকদের দিয়ে দস্তখত করিয়ে তাদের কারাদণ্ড ও ফাঁসির আদেশ দিতেন। বিচারের আদালত হয়ে পড়েছিল তাদের হাতে বিচারের দোকান। পুনঃগঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার শুরু হয়েছে। শীর্ষ স্থানীয় অনেক অপরাধী ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গেছে। অন্যরা দেশে থাকলেও লো প্রোফাইলে আছে। এমতাবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার চাপের মুখে বিচার ও সংস্কারের ক্ষেত্রে দর্শনীয় কিছু ঘটার আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়ে গগন মুচির মতো একটি গড়াগড়ি খেয়েছেন বলে মনে হয়। দ্বিতীয় গড়াগড়ি খাবার পথে নির্বাচন কমিশনকে হাঁটতে দেখা যাচ্ছে। কমিশনের শীর্ষ কর্মকর্তা পি আর নির্বাচন পদ্ধতির প্রশ্নে সাংবিধানিক প্রশ্ন তুলে আনছেন কিন্তু যারা তাকে নিয়োগ দিয়েছেন তাদের সাংবিধানিক ভিত্তির কথা ভুলে গেছেন বলে মনে হয়। আরো কয়েকটি দল পতিত স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্টদের সাথে রুটি রুজি ভাগাভাগি করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করে মসনদে যাবার উগ্র প্রচেষ্টায় মেতেছেন এবং সব ক্ষেত্রে পূজারি ঠাকুরের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা যা করছেন তাতে গগনের বাড়ির পেছনের ময়লা পায়খানার স্তূপে পড়ে বেইজ্জত হবার সম্ভাবনা নেই তো?