ফের অশান্ত ভারতের মণিপুর রাজ্য। এ অশান্ত অবস্থা বিরাজ করছে বহু দিন ধরে। বাংলাদেশ লাগোয়া ভারতের যে সেভেন সিস্টার্স বা সাত রাজ্য-তারই একটি মণিপুর। মণিপুর হল উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি স্থলবেষ্টিত রাজ্য। রাজধানী ইম্ফল। এ রাজ্যের উত্তরে নাগাল্যান্ড, দক্ষিণে মিজোরাম, পশ্চিমে আসাম ও পূর্বদিকে মিয়ানমার। বাংলাদেশের সাথে সরাসরি সীমান্ত না থাকলেও আসাম পার হয়েই মনিপুর। ফলে এ অঞ্চলে তিক্ততার একটা খারাপ ফলাফল এ দেশেও পড়তে পারে। মণিপুরে জাতিগত দাঙ্গা চলছে প্রায় দু’বছর ধরে। দাঙ্গায় স্বল্প জনসংখ্যার রাজ্যে প্রায় তিনশ’ লোকের মৃত্যু হয়েছে। গত ডিসেম্বরে সেখানকার বিভিন্ন পক্ষ অবিলম্বে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির আহবান জানিয়েছিল। গত মাসে বিজেপি শাসিত এ রাজ্যে জারি হয় রাষ্ট্রপতির শাসন। দেখা যাচ্ছে এর পরও সহিংসতা কমছে না।

মণিপুরে শান্তি ফেরাতে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তেমন উদ্যোগ দেখা না গেলেও এবার মাঠে নেমেছেন বিচারপতিরা। মানুষ সংবিধান মেনে চললেই মণিপুরে প্রতিবন্ধকতাকে জয় করা যাবে। এমনটাই মনে করেন ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এন কোটিশ্বর সিংহ। আনন্দবাজার পত্রিকা ২৩ মার্চ জানাচ্ছে. রাজ্যের বাস্তবচিত্র খতিয়ে দেখতে মণিপুরে গিয়েছেন শীর্ষ আদালতের বিচারপতি বিআর গবইয়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির প্রতিনিধিদল। ওই প্রতিনিধিদলে ছিলেন বিচারপতি সিংহও। মণিপুরে হাইকোর্ট স্থাপনার দ্বাদশ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে গত রবিবার এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

সে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছিলেন বিচারপতি সিংহ। ওই বক্তৃতাতেই মণিপুরবাসীকে সংবিধান মেনে চলার পরামর্শ দেন তিনি। অপর খবরে জানা গেছে, মার এবং জোমি জনজাতির সংঘষের্র পর এ সপ্তাহের শুরুতেই অশান্তি শুরু হয়। সে আবহে মঙ্গলবার রাতে ফের দুই জনজাতির সংঘর্ষ হয় জেলার বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে। সোমবার চুরাচান্দপুরে কার্ফু জারি হওয়ার পরেই বৈঠকে বসেন মার এবং জোমি জনজাতির প্রতিনিধিরা। দীর্ঘ বৈঠকের পর দু’পক্ষে শান্তিচুক্তিও হয়। কিন্তু তার ২৪ ঘণ্টা পেরোতে না পেরোতেই সংঘর্ষ বাধে দুই জনজাতির মধ্যে। কোথাও কোথাও গোলাগুলিও চলে।

দেখা যাচ্ছে, গত নভেম্বরে নতুন করে যে সংকট বা অশান্তি ডালপালা মেলেছিল তা এখনো শেষ হয়নি। সে সময় সিআরপিএফ গুলি চালালে ১১ জন নিহত হয়। এরপর কুকি আর মেইতেই মধ্যে বিরোধ চলে আসছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাষ্ট্রপতি শাসনের তিরিশ দিনে মণিপুর তেমন কোনও আশাজাগানো বদল দেখল হয়নি। বরং কেন্দ্রীয় নীতির ব্যর্থতাকে সাক্ষী রেখেই ফের উত্তেজনা ফিরেছে পাহাড় ও সমতলের মধ্যে।

২০২৩ সালের মে মাসে মণিপুরের সহিংসতা শুরু হলে কিছুদিন পর থেকে মণিপুরের অংশ কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। মণিপুর রাজ্যের আদিবাসী ও মৈতেই জাতির মধ্যে এই জাতিগত সহিংসতার মাত্রা ছিল ব্যাপক। আদিবাসী সংগঠনগুলি মৈতেই জাতিকে তফশিলি উপজাতির মর্যাদা প্রদানের বিরোধিতা করে ২০২৩ সালের ৩ মে বিক্ষোভ শুরু করেছিল। অল ট্রাইবাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন মণিপুর (এটিএসইউএম) দ্বারা ডাকা “উপজাতি সংহতি মার্চ” চলাকালীন চূড়াচাঁদপুর জেলায় সহিংসতা ছড়িয়ে পরে, যাতে কমপক্ষে ৫৪ জন নিহত হয়েছিল। ৩রা মে দাঙ্গার পর, আসাম রাইফেলস ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মীদের আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের জন্য রাজ্যে মোতায়েন করা হয়েছিল। মণিপুর রাজ্যে ইন্টারনেট পরিষেবা ৫ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছিল এবং আইপিসি-এর ১৪৪ নং ধারা জারি করা হয়েছিল।

গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মণিপুর রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়। রাজ্য প্রশাসন বিজেপির হাত থেকে কেন্দ্রের হাতে চলে যায়। এরপর ১ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চলাফেরার ওপরে নিয়ন্ত্রণ তোলার জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। যার জেরে পুলিশ অভিযান চালাতে যায়। মণিপুরে গত প্রায় দু’বছরের সহিংসতার জেরে অন্তত তিন শ মানুষ মারা গেছেন, গৃহহীন হয়েছেন ৫০ হাজারের বেশি মানুষ।

দ্বন্দ্ব কোথায়? মনিপুরের ৩৬ লাখ জনগোষ্ঠীর ৫৩ শতাংশ মেইতেই। তাদের বড় অংশই হিন্দু। তবে মুসলমান ও বৌদ্ধও আছে। মেইতেইরা মণিপুরের মোট জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ। রাজ্যের বিধানসভায় মেইতেইদের ক্ষমতা অন্যদের চেয়ে বেশি। অন্যদিকে ইম্ফল উপত্যকার আশেপাশের পাহাড়ে বাস করে নৃতাত্ত্বিক বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। পাহাড়ি এলাকার দক্ষিণে বাস করে কুকি ও উত্তর-পূর্বে বাস করে নাগারা। খ্রিস্টধর্মের অনুসারী কুকি ও নাগারা মণিপুরের ৩৬ লাখ মানুষের প্রায় ৪০ শতাংশ। তারা পাহাড়ে সংরক্ষিত এলাকায় বাস করে। এ পাহাড়ি অঞ্চল মণিপুর ভূখণ্ডের ৯০ শতাংশ।

মেইতেই এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদটি রাজনৈতিক ও ভৌগোলিকভাবে স্পষ্ট। দাঙ্গায় এই বিভেদের চিত্রটি সামনে এলেও দুই পক্ষের মধ্যকার উত্তেজনা দীর্ঘ দিনের এবং ভূমি অধিকার, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এই দূরত্ব ও বিভেদ চলছে। রাজ্য সরকার এবং প্রশাসনের বিভিন্ন পদে মেইতেইদের আধিপত্য চোখে পড়ার মতো এবং সেখানে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নতির সুবিধা অন্য আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর তুলনায় তারাই বেশি ভোগ করে। মনিপুরের সংখ্যাগুরু মেইতেই সম্প্রদায়কে তফসিলি উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া যায় কি-না, তা খতিয়ে দেখতে হাইকোর্ট একটি সুপারিশ করার পর থেকে সহিংসতা চলছে। নাগা ও কুকিদের অভিযোগ, অবৈধ অভিবাসী উচ্ছেদের মাধ্যমে মূলত তাদের ভূমি থেকে সরানো হচ্ছে। মণিপুরের ভূমি সংস্কার আইন অনুযায়ী, স্থানীয় জেলা পরিষদের অনুমতি ছাড়া পাহাড়ি এলাকায় বসবাসের অনুমতি ছিল না মেইতেইদের। অন্যদিকে কুকি ও নাগা জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের উপত্যকা এলাকায় বসবাসের ক্ষেত্রে কোনও বিধি-নিষেধ ছিল না। কিন্তু বিজেপি সরকার মেইতেইদের শিডিউল ট্রাইব বা তফসিলি গোত্র ঘোষণা দেওয়ায় তাদেরও এখন পাহাড়ি বনাঞ্চলে বসবাসের সুযোগ দেওয়া হতে পারে। আর এ নিয়েই শুরু হয় এই জাতিগত সংঘাত, সেকথা আগেই বলেছি।

২০২৩ সালের মে মাসে মণিপুর রাজ্যের বড় জাতিগোষ্ঠী মেইতেইদেরও ‘শিডিউল ট্রাইব’ সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দেয় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। মেইতেইরা ‘শিডিউলড ট্রাইব’ (তফসিলি জাতিগোষ্ঠী) হিসেবে গণ্য হয় না। ভারতে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী হিসেবে পরিগণিত হলেও মনিপুরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় মেইতেইদের ‘শিডিউলড ট্রাইব’ হিসেবে স্বীকৃতি দিলে অন্য সংখ্যালঘু আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর জন্য ওই রাজ্যে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে-এ আশঙ্কা থেকে মেইতেইদের ‘শিডিউলড ট্রাইব’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার বিরোধিতা করছে রাজ্যের অন্য আদিবাসী সংখ্যালঘুরা, যাদের একটি বড় অংশ ধর্মীয়ভাবে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী।

জাতিগত সহিংসতা বিষয়ে যা জানা যাচ্ছে তা হলো, বিজেপি সরকারই ছিল সঙ্কটের মূলে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার দাবি করা হলেও মনিপুরে অস্থিতিশীলতার দেড় বছর পার হওয়ার পর সম্প্রতি বিজেপি শাসনের অবসান হয়েছে। কিন্তু এর পরও পরিস্থিতি জটিলই রয়ে গেছে।

রাজ্যের এ নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তটি কেমন হওয়া উচিত এ নিয়ে ভাবনা অনেক। প্রথমে বলা হচ্ছিল, বিজেপির বিবদমান দু’গোষ্ঠীর মধ্যে রফা করিয়ে শীঘ্রই পরের মুখ্যমন্ত্রী বেছে নেবে হাইকমান্ড। শেষ হবে রাষ্ট্রপতি শাসন। কিন্তু রাজ্য নেতৃত্বের আবেদন বা হুমকিতে সাড়া মেলেনি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তরফে বরং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে জানানো হয়, যাঁকেই বেছে নেওয়া হোক, মেইতেই মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে রাজ্যে শান্তি ফেরানো অসম্ভব। তাই রাজ্যে শান্তি ফেরাতে আপাতত সেনা-সহ কেন্দ্রীয় সশস্ত্র বাহিনীর হাতেই আইন-শৃঙ্খলার ভার ছাড়া হবে। সেনা সূত্রে বলা হয়, কুকি ও মেইতেই, উভয় পক্ষেরই সশস্ত্র সমাজকে নিরস্ত্র করতে তিন মাস সময় পাবে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী। কিন্তু কী অর্জিত হল এই এক মাসে এমন প্রশ্ন উটেছে। রাজ্যপাল অজয়কুমার ভল্লা দু’দফায় সময় বেঁধে সব লুট হওয়া ও অবৈধ অস্ত্র জমা দিতে বলেন। কিন্তু সেনা সূত্রে খবর, জমা দেওয়া অস্ত্রের মধ্যে সরকারি অস্ত্রাগার থেকে লুট হওয়া ও বিদেশি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ২০ শতাংশও জমা পড়েনি।

দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কুকি এলাকা দিয়ে অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন নিরাপত্তা বাহিনীকে। কুকিরা জানিয়ে দিয়েছিল, তাদের দাবি পূরণ না করে জোর করে বাস চালালে ফল খারাপ হবে। সেটাই হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, আলোচনার বদলে জোর করে শান্তি ফেরানো যে অসম্ভব, তা জানার পরেও কেন্দ্রের এমন পদক্ষেপের জেরে গত নভেম্বর থেকে আপাত শান্ত রাজ্য ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।

তৃতীয়ত, রাজ্যে শান্তি ফেরানোর প্রধান শর্তই যেখানে মেইতেই ও কুকিদের আলোচনার টেবিলে আনা, সেখানে কেন্দ্রের তরফে সেই চেষ্টাই তেমন হল না। সংঘর্ষে নিরপেক্ষ নাগা ও মেইতেই মুসলিম বা পাঙ্গালরা যৌথ ভাবে শান্তির উদ্যোগের প্রস্তাব রেখেছিল। তারা মেইতেই ও কুকিদের সঙ্গে আলোচনাও চালায়। নাগা-কুকি সংঘর্ষের সময়ে নাগাল্যান্ডের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নেফিউ রিওর নেতৃত্বে এমনই শান্তি মিশন কাজে লাগানো হয়েছিল। কিন্তু মণিপুরে তেমন কৌশল ব্যবহারের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের সাড়া দৃশ্যত মেলেনি।

রাজ্যের ৩৫,১০৪ কোটি টাকার বাজেটে সংঘর্ষে ঘরছাড়াদের অস্থায়ী আবাস তৈরির জন্য মাত্র ১৫ কোটি টাকা ও বাস্তুহারাদের ঘর গড়তে মাত্র ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ত্রাণকার্যে বরাদ্দ হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। ক্ষতিপূরণ বাবদ রাখা হয়েছে মাত্র ৭ কোটি। বিরোধীদের দাবি, সংঘর্ষে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ ঘরছাড়া। তাঁদের বেশির ভাগের বাড়িই গুঁড়িয়ে গিয়েছে বা সম্পূর্ণ ভস্মীভূত। কিন্তু বাজেটে ঘোষিত পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণের বরাদ্দ সেই তুলনায় নেহাতই নগণ্য।