বাংলাদেশে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই যেন শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার পর ভালো চাকরি পাওয়া। যদিও তা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য নয় আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের আকাক্সক্ষাই নয়; অনেক অভিভাবকেরও সুপ্ত মনোবাসনা, সন্তান যেন শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকরি পায়। বিশেষ করে সরকারি চাকরি। অথচ একসময় মানুষ চাকরি খুঁজে পাওয়ার আগ্রহী ছিল না; জ্ঞান অর্জন করাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। আর এখন অর্থকড়ি দিয়ে হলেও চাকরি চাই! যেনতেন উপায়ে চাকরি পাওয়া নিয়েও গর্ববোধ করে। কিন্তু অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধা ভাগিয়ে নেয়াও যে অপরাধ, এ বিষয়টিকে এখন অনেকেই তুচ্ছ মনে করে। কেউ কেউ পান্তাভাত মনে করে। ফলে কিছু মানুষ সরকারি চাকরির লোভে বাপদাদার ভিটে বাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করতে কুন্ঠাবোধ করে না। সরকারি চাকরি যেন তাদের কাছে সোনার হরিণ। কিন্তু আশির দশকের দিকে মানুষ চাকরির পেছনে খুব বেশি ছুটাছুটি করতো না। কাউকে কাউকে জোর করেও চাকরিতে পাঠানো যেত না। সরকারি চাকরি কেউ কেউ পছন্দ করতো না। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পাওয়া যেত না। তখন অনেকেই বেসরকারি চাকরিমুখী ছিলেন। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। শিক্ষার হার বাড়ছে, কিন্তু কর্মসংস্থান ততটা নয়। ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। বর্তমানে এ সংখ্যা আরও বাড়ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে প্রতি বছর কমপক্ষে ২০-২২ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। তাদের এক-তৃতীয়াংশ বিদেশে কর্মসংস্থান। বাকি ১৪-১৫ লাখ দেশে কর্মসংস্থান হয়। (সূত্র : প্রথম আলো, ৯ মার্চ, ২০২৫) বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬.৮ শতাংশ। ২০২৪ সালের বিবিএস এর সমীক্ষা অনুসারে সাক্ষরতার হার ৭৭.৯ শতাংশে পৌঁছেছে, তবে চাকরির সুযোগ বাড়েনি। ফলস্বরূপ বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।

যারা বেকার। তারাও মানুষ। তাদের জীবন বিপথে ঠেলে দিয়ে দেশ কখনো এগোতে পারবে না। উন্নয়নশীল দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে, বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন। বিশ্বের অনেক দেশে বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন ধরনের সহায়তা রয়েছে। যেমন : নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, লুক্সেমবার্গÑ বেকারদের জন্য মাসিক বেতন/ ভাতা, স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থান সুযোগ নিশ্চিত করে। যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্ব বীমা (টহবসঢ়ষড়ুসবহঃ ওহংঁৎধহপব) ব্যবস্থা চালু আছে, যা বেকারদের আর্থিক সহায়তা দেয়। আলজেরিয়াতে মাসিক বেকার ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা আছে। ফ্রান্সে বেকারদের জন্য বিশেষ ‘পুন:প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম’ এবং আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা হয়। সুইডেনে বেকারদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থান সহায়তা এবং মাসিক বেতন দেয়া হয়। জাপানে বেকারদের পুনর্বাসন এবং চাকরির প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামের পাশাপাশি আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। কানাডাতে বেকারত্ব বীমা ও পুনঃপ্রশিক্ষণ সুবিধা রয়েছে, যাতে চাকুরি হারানো ব্যক্তিরা দ্রুত পুনরায় কর্মসংস্থান পেতে পারে। অস্ট্রেলিয়াতে বেকারদের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা, কর্মসংস্তান প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশেও বেকার ভাতা চালু করা যায় কিনা এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা জরুরি। পাশাপাশি প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এটা করতে পারলে লাখো চাকরিপ্রার্থী তাদের মানসিক চাপ ও আর্থিক কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে। এভাবে তারা দক্ষতা ও মেধা কাজে লাগাতে পারবে, দেশের শ্রম বাজারে যোগদান সহজ হবে এবং সমাজে স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। প্রয়োজন কেবল একটি সুপরিকল্পিত ও কার্যকর উদ্যোগ, যা লাখো তরুণ-তরুণীর জীবনকে সহজ করবে এবং দেশের উন্নয়নে স্থায়ী অবদান রাখবে।

বাংলাদেশে চাকরির নিয়োগী পরীক্ষা মানেই যেন ভোগান্তি। এসব ভোগান্তির সীমাহীন কষ্ট কেবলমাত্র ভুক্তভোগী চাকরিপ্রত্যাশী প্রার্থীরা অনুধাবন করতে পারেন, অন্য কেউ তা অনুধান করতে পারেন না। প্রতি বছর লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ-তরুণী সরকারি ও বেসরকারি চাকরির আশায় নিয়োগ পরীক্ষার সম্মুখীন হন, ভোগান্তির শিকার হন। এ বিষয়গুলো তুলে ধরাই এ নিবন্ধনের উদ্দেশ্য।

ইদানীং একই দিনে একাধিক নিয়োগ পরীক্ষা নেয়া নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এতে হাজারো প্রার্থী একটি পরীক্ষা বাদ দিয়ে আরেকটিতে অংশ নিতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে তাদের প্রকৃত মেধা যাচাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। একই দিনে একাধিক পরীক্ষা নেয়া মানে চাকরি প্রার্থীদের প্রতি অবিচার করার শামিল। গত ২৩ জুন রাজধানীতে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় ২৩টি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে কতজন প্রার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু এতটুকু বলা যায় একজন প্রার্থীর পক্ষে ২৩ টি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা সম্ভব না। একজন শিক্ষার্থীকে একটি পরীক্ষায় অংশ নিলে অন্যগুলো বাদ দিতে হয়। এভাবে একজন প্রার্থীর শ্রম ও সময় অপচয় হচ্চে। বিশেষ করে যানজট ও দূরত্বের কারণে দুটি পরীক্ষা দেয়া খুবই কষ্টকর। নিয়োগ পরীক্ষার এসব ভোগান্তি তাদের জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত নিয়োগ পর্যন্ত সময়ক্ষেপণ কিছুতেই কমছে না; বরং দিন দিন এই দেনা বাড়ছে। কোথাও এটি ৬ মাসে শেষ হয় না, কোথাও ২-৩ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। আবার কোথাও লিখিত পরীক্ষা হয় কিন্তু মৌখিক পরীক্ষা হয় না। মৌলিখ পরীক্ষা হলেও ফল প্রকাশ হয় না। মাসের পর মাস চলে যায়; কিন্তু অপেক্ষার পালা শেষ হয় না। শুধু কি তাই! পরীক্ষার কেন্দ্র ও যাতায়াতের ভোগান্তি কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে গিয়ে পরীক্ষা দিতে হয়। একই দিনে সবাইকে ঢাকায় আসতে হয়। একই দিনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পরীক্ষা থাকায় অনেকে ঠিক করে উঠতে পারেন না কোনটা পরীক্ষা দিবেন আর কোনটা দিবেন না। নিয়োগ পরীক্ষার নামে যত ধরনের অনিয়ম হয় তা জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ করা, ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব বন্ধ করা, মেধা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন করা, ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ করা, তদবির কিংবা সুপারিশ বন্ধ করা। পাশাপাশি যারা পরীক্ষা নিবেন তারা আগভাগেই পরীক্ষার স্থান, যাতায়াতের মাধ্যম, আশপাশে থাকার ঠিকানা, কতজন প্রার্থীকে নেয়া হবে, ফল কবে প্রকাশিত হবে ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে উল্লেখ করা প্রয়োজন। যেন একজন নিয়োগ প্রার্থী তার মেধা এবং সময়কে কাজে লাগাতে পারেন। চাকরি প্রত্যাশীদের ভোগান্তি কমানোর স্বার্থে দেশের সকল বিভাগীয় শহরগুলোতে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। নিকট অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগীয় শহরে ভর্তিপরীক্ষা নিয়েছিল। তাদের এ উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। বিসিএস পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা যদি বিভাগীয় শহরে অনুষ্ঠিত হতে পারে! তাহলে অন্যান্য পরীক্ষার অনুষ্ঠিত হতে বাধা কোথায়? নিয়োগ প্রার্থীদের মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণার বিষয়টি বিবেচনা করে জরুরি ভিত্তিতে এ সমস্যার সমাধান করা প্রয়োজন। যেন তারা মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে। সব নিয়োগ পরীক্ষার ভোগান্তি দূর করতে সরকার উদ্যোগী ভূমিকা নেবেÑ এমনটিই লাখো চাকরিপ্রার্থীর প্রত্যাশা।

লেখক : প্রাবন্ধিক