প্রফেসর আর. কে. শাব্বীর আহমদ

রমযান তাকওয়া বা আল্লাহভীতির গুণ অর্জনের মাস, কুরআন নাযিলের মাস; ক্ষমা লাভের মাস। তাকওয়ার গুণ অর্জনের মধ্য দিয়ে আত্মশুদ্ধির উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’আলা রোজা ফরয তথা অত্যবশ্যকীয় করে দিয়েছেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ঘোষণা-

“হে ঈমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপরও রোজা ফরয করা হয়েছিল, আশা করা যায় তোমরা তাকওয়ার গুণ অর্জন করতে পারবে।” (সূরা আলবাকারা, আয়াত-১৮৩) তাকওয়াবান বা মুত্তাকীর ৫টি গুণের কথা আল্লাহ তা’আলা সূরা বাকারার ৩-৪ নং আয়াতে বলেছেন :

১. যারা না দেখে অদৃশ্য আল্লাহ, রাসূল (সা.), আখেরাত; জান্নাত, জাহান্নামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে।

২. যারা সালাত প্রতিষ্ঠিত করে পরিবার ও রাষ্ট্রে।

৩. যারা আল্লাহ প্রদত্ত রিযিককে তাঁর সন্তুষ্টির পথে খরচ করে।

৪. যারা আপনার (রাসূলের) প্রতি ও আপনার পূর্ববর্তী রাসূলগণের প্রতি প্রেরিত কিতাবের ওপর বিশ্বাস রাখে।

৫. এবং আখিরাতে হিসাব-নিকাশেরের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করে।

এ ৫টি গুণ সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অর্জনকারী ব্যক্তিরাই প্রকৃত তাকওয়াবান বা মুত্তাকী, যারা আল্লাহ তা’য়ালার শাস্তির ভয়ে সমস্ত অন্যায় ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকেন।

রমযান মাসে আল্লাহ তা’আলা কুরআন নাযিল করেছেন সমগ্র মানুষের সঠিক পথ নির্দেশনার জন্য। যে কুরআন সত্য-মিথ্যার সুস্পষ্ট পার্থক্যকারী দলিল, একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। (দ্রষ্টব্য : সূরা আলবাকারা, আয়াত-১৮৫)

এ কুরআনের বিধান মোতাবেক মুত্তাকীরা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করে মানবকল্যাণ সাধন করবে এবং আল্লাহ প্রদত্ত প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করে দুনিয়া আখিরাতে মুক্তির পথ লাভ করবে।

রমযান মাস ক্ষমাপ্রাপ্তির মাস। হযরত সালমান ফারসী (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘....... এটি এমন একটি মাস, যার প্রথম ১০ দিন রহমতের বারিধারায় পরিপূর্ণ। দ্বিতীয় ১০ দিন মাগফিরাত বা ক্ষমা ও মার্জনার জন্য এবং শেষ ১০ দিন জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি লাভের উপায়রূপে নির্দিষ্ট’। (বায়হাকী, শুআবিল ঈমান)

আমরা এখন মাগফিরাতের দশক অতিক্রম করছি। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও আত্মসমালোচনার চেতনায় রমযান মাসের রোজা রাখবে, তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (বুখারি, মুসলিম, তিরমিযি, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমদ)

আমাদেরকে অতীত গুনাহরাশি থেকে তাওবা (আর গুণাহ না করার শপথ) করে বিশুদ্ধ নিয়্যতে রোজা পালন করে হৃদয়ের অশ্রু ঢেলে অতীতের অন্যায় ও গর্হিত কাজের ক্ষমা চাইতে হবে। আল্লাহ তা’আলা মহা ক্ষমাশীল। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এ ক্ষমার মাসেও আল্লাহ তা’আলা ৫ শ্রেণির মানুষকে ক্ষমা করবেন না।

১. মা-বাবার অবাধ্য সন্তান, যারা মা-বাবার সাথে বেআদবি ও খারাপ ব্যবহার করেছে, মা-বাবার কোনো খেদমত করেনি।

২. যারা নেশাগ্রস্ত; মদ, গাঁজা, আফিম, ইয়াবা, সিগারেটখোর।

৩. যারা হৃদয়ে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যায় আত্মসাৎ, গুম, খুন, প্রতারণায় লিপ্ত থাকে।

৪. যারা পার্থিব সম্পদের লোভে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে।

৫. যারা আল্লাহর সাথে শিরক করে মানুষের তোষামোদি করে, মাজারে সেজদা করে নিজের স্বার্থের জন্য প্রার্থনা করে।

হযরত আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, ওই ব্যক্তির নাক ধুলিমলিন হোক, যার কাছে আমার নাম উল্লেখ করা হলো, অথচ সে আমার ওপর দরূদ পড়লো না। ওই ব্যক্তির নাক ধুলিমলিন হোক, যার জীবনে রমযান মাস এলো, কিন্তু সে তাকে ক্ষমাপ্রাপ্ত না করে তা অতিবাহিত করে দিলো। ওই ব্যক্তির নাক ধুলিমলিন হোক, যে তার পিতা-মতাকে (বা তাদের একজনকে) বৃদ্ধাবস্থায় পেল, কিন্তু তাদের খিদমাত করার মাধ্যমে জান্নাতি হতে পারলো না। (সুনানে তিরমিযি, হাদিস-৩৫৪৫)

ইসলাম মানবতার বিধান; ক্ষমার বিধান। পাপীদের আত্মশুদ্ধি ও ক্ষমাপ্রার্থনার জন্য আল্লাহ তা’আলা রমযান মাসে সুযোগ করে দিয়েছেন। রমযানে দীর্ঘ ১ মাস অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার অভ্যাস গড়ে তুলে বাকী ১১ মাস অন্যায়-অশ্লীল কাজ করার শপথ গ্রহণ করলে আল্লাহ তা’আলা বান্দার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে ক্ষমা করে দেবেন।

আসুন আমরা অপরাধমুক্ত, নৈতিকতাপূর্ণ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য সমস্ত অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকি। নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহ তা’আলার ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়ার যোগ্য করে তুলি এবং ক্ষমাপ্রাপ্ত সৎ, যোগ্য নেতৃত্বের হাতে আমাদের দেশ পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করি। যাতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ মৌলিক অধিকার লাভ করে নিরাপদে বসবাস করতে পারে। আল্লাহ ছাড়া কারো গোলামি না করে স্বদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারে।

লেখক : কবি ও শিক্ষাবিদ।