১৯৯০-এর দশকে, একটি জাপানি বুলেট ট্রেন টানেলের ভেতরে প্রবেশ এবং বের হওয়ার সময় একটি অস্বাভাবিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। এটি তার পিছনে বিশাল সংকুচিত বাতাস টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, ফলে একটি কান ফাটানো বিকট শব্দের সৃষ্টি হয়েছিল যা কাছাকাছি যাত্রী এবং বাসিন্দাদের বিরক্ত করেছিল। এ বাধাটি একটি জটিল ইঞ্জিনিয়ারিং চ্যালেঞ্জ ছিল, কিন্তু সমাধানটি আসে একটি অপ্রত্যাশিত উৎস থেকে। মাছরাঙা, একটি দক্ষ শিকারী পাখী, যে দ্রুত পানিতে ডুব দেয় এবং কোনও শব্দ তৈরি না করে কিংবা পানি না ছিটিয়ে দিয়ে। মাছরাঙা পাখির ঠোঁটের সুবিন্যস্ত আকৃতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ইঞ্জিনিয়াররা ট্রেনের সামনের অংশটি নাটকীয়ভাবে বায়ু প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করার জন্য ডিজাইন করে নেন। ফলে কেবল শব্দ অদৃশ্যই হয়নি, বরং যাত্রা আরও মসৃণ, গতিশীল এবং আরও দক্ষ হয়ে ওঠে এবং শক্তি খরচ ১৫% হ্রাস পায়!
এ প্রযুক্তিগত উল্লম্ফন কেবল একটি উন্নতি ছিল না; এটি উচ্চ-গতির ট্রেনের জগতে বিপ্লব এনেছে, যা তাদের আরও আরামদায়ক, শান্ত এবং আরও পরিবেশবান্ধব করে তোলে।
মাছরাঙা পাখির ঠোঁটের সুবিন্যস্ত ও নিখুঁত গঠন মহান আল্লাহর সৃষ্টিকুশলতা আর তিনি পাখিটিকে সে সহজাত সেন্স, শিকার কুশলতা শিখিয়েছেন। এ জীবন চলার সহজাত পথনির্দেশ আল্লাহ প্রতিটি সৃষ্টিকেই দিয়েছেন। আমরা দেখি, জন্মের পর তাৎক্ষণিকভাবেই মাছের পোনা সাঁতার কাটতে শুরু করে, তাকে এজন্য কোন প্রশিক্ষণ নিতে বা দিতে হয় না। বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য এ শিক্ষা তার সহজাত। আল্লাহ তা’আলা শুধু সৃষ্টি করেই ছেড়ে দেন না; পথও দেখান। তিনি প্রতিটি সৃষ্টিকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন এবং সে অনুসারেই তার দেহ-কাঠামো তৈরির পাশাপাশি প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়েছেন। অন্য সকল সৃষ্টির তুলনায় মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অনেক বড় ও ব্যাপক। আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাঁর প্রতিনিধির মর্যাদা দিয়ে। তার দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছা অনুসারে বিশ্বকে পরিচালনা করা। তিনি বলেছেন- ‘তিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের (মানুষের) জন্য সৃষ্টি করেছেন।’ এজন্য তিনি প্রতিনিয়ত মানুষকে এমন প্রজ্ঞা দান করছেন যাতে তারা আল্লাহ’র সৃষ্টিকে কাজে লাগাতে পারে। মাছরাঙা পাখির ঠোঁটের সুবিন্যস্ত আকৃতিকে কাজে লাগানোর ধারণা বা অনুপ্রাণিত হওয়াও লব্ধ জ্ঞান যা প্রতিনিয়ত মানুষের মনে উদয় হতে থাকে। এ লব্ধ জ্ঞান, ধারণা ও আইডিয়াই ইউরেকা হয়ে প্রতিনিয়ত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতাকে এগিয়ে নিচ্ছে।
তবে মানবসত্তার বিকাশের জন্য শুধু জাগতিক উন্নতিই যথেষ্ট নয়। মানবজীবনের প্রকৃত সফলতার জন্য মানুষের আত্মিক বা মনুষ্যত্ব’র বিকাশও জরুরি। এজন্য আল্লাহ মানুষের প্রকৃতিতে আরও কিছু দিয়েছেন। তার মধ্যে একটি হলো ন্যায়-অন্যায় বোধ বা বিবেক। বিবেকবোধের অভাবে মানুষ জাগতিক উন্নতির শিখরে আরোহণ করা সত্ত্বেও ইতর ও দানবে পরিণত হয়। তবে সবচেয়ে মূল্যবান যেটা দিয়েছেন- সেটা হল অহী বা আল্লাহ’র কালাম আল কুরআন। এ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ বলেন- ‘হে মানবজাতি! তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে উপদেশ (কুরআন) এসে গেছে; এতে রয়েছে (তোমাদের) অন্তরের রোগের পূর্ণ নিরাময়; আর যে তা কবুল করবে (ঈমান আনবে) তার জন্য নির্দিষ্ট রয়েছে পথনির্দেশ এবং রহমত।
(হে নবী) বল: এটা আল্লাহ’র অনুগ্রহ ও অপার করুণা যে, তিনি এই প্রত্যাদেশ নাযিল করেছেন। এজন্য তো লোকদের আনন্দ-উৎসব করা উচিত। এটা সেসব থেকে উত্তম, যা লোকেরা সংগ্রহ ও আয়ত্ত করে থাকে।- [সূরাহ ইউনুস: আয়াত ৫৭-৫৮।
পবিত্র কুরআনে মানুষের বিবেকবোধের দৈন্যকে অন্তরের অসুস্থতা, অন্তরের রোগ হিসেবে অভিহিত করে বলা হয়েছে, এ থেকে মুক্তি পেতে হলে কুরআনের কাছে ফিরে আসতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সঠিক সংস্কার বা মেরামতের জন্য মানুষের অন্তরের মেরামত সবার আগে প্রয়োজন। তাই আল্লাহর কালামের প্রতি সঠিক ঈমান ও অন্তরের মেরামত ছাড়া সঠিক পথের সন্ধান লাভ ও আল্লাহর রহমত প্রাপ্তির কোন সম্ভাবনা নেই। আর আল্লাহর কালামের আলোকে অন্তর ও রাষ্ট্র মেরামত করতে পারলেই আমাদের জীবনে নেমে আসবে অনাবিল সুখ, শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য।
সুতরাং সে প্রজ্ঞাময় আল্লাহর প্রশংসা করা উচিত যিনি তাঁর সৃষ্টির সবকিছুকে নিখুঁতভাবে সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি পথ দেখান সব সৃষ্টিকে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।