ইকবাল কবীর মোহন

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কানাডা। দেশটির অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর পার্শ্বে। এর আয়তন ৩৮ লাখ ৫১ হাজার ৮ শত ২১ বর্গমাইল। উত্তর আমেরিকায় অবস্থিত স্বল্প জনসংখ্যার দেশ কানাডা। কানাডার লোকসংখ্যা মাত্র ৪ কোটি। দেশটির শতকরা ৮০ ভাগ লোক দক্ষিণাঞ্চলে বাস করে। উত্তর আমেরিকা মহাদেশের ৪১ শতাংশ ভূমি নিয়ে গঠিত কানাডা। দেশের ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গে জনগোষ্ঠীর মধ্যেও একটি বৈচিত্র্যতা রয়েছে। দেশটির শতকরা ৪৮ ভাগ লোক বৃটিশ বংশোদ্ভূত এবং ৩১ ভাগ ফরাসী। এছাড়া জার্মান, ইতালী ও আমেরিকান-ভারতীয় বংশোদ্ভুত লোকও রয়েছে।

কানাডা একটি ফেডারেল রাষ্ট্র। ১২টি প্রদেশ ও ২টি টেরিটরি নিয়ে এ ফেডারেল রাষ্ট্র গঠিত। কানাডা একসময় ব্রিটিশ শাসনের অধীন ছিল। ১৯৬৭ সালে এটি স্বাধীনতা অর্জন করে। তবে বৃটেনের রাণী এলিজাবেথ এখনও কানাডার রাণী হিসেবে স্বীকৃত এবং এটি একটি প্রতীকী পদ মাত্র। কানাডা মন্ত্রী পরিষদ শাসিত ফেডারেল গভর্মেন্ট দ্বারা পরিচালিত। রাণী এলিজাবেথ রাষ্ট্র প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী সরকার প্রধান। পার্লামেন্ট দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট। সিনেট ও হাউজ অব কমন্স। সিনেট ১০৫ সদস্য বিশিষ্ট এবং হাউজ অব কমন্স ২৯৫ সদস্য বিশিষ্ট। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে হাউজ অব কমন্সের সদস্যরা নির্বাচিত হন।

জনসংখ্যার ৭.২ শতাংশ খ্রিষ্টান, ৩.২ শতাংশ মুসলিম, ১.৫ শতাংশ হিন্দু, ১.১ শতাংশ বৌদ্ধ এবং ২৩.৯ শতাংশ লোকের কোন ধর্ম নেই। এ হিসেবে দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম সম্প্রদায় মুসলিম। বিশ্বের অন্যতম বহুসাম্প্রদায়িক ও শান্তির দেশ কানাডা। এখানে নেই কোনো সাম্প্রদায়িক দ্বন্ধ ও বৈরিতা এবং ধর্মভিত্তিক সংঘাত। ফলে মুসলমানদের জন্যও কানাডায় রয়েছে শান্তি ও নিরাপত্তা। বর্তমানে কানাডায় ১৭ লাখের বেশি মুসলমান আছে, যা মোট জনসংখ্যার ৬.৬ শতাংশ। ২০৩০ সাল এই সংখ্যা তিন মিলিয়ন বা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

কানাডায় ইসলামের ইতিহাস শত বছরের পুরোনো। ১৮৭১ সালের আদমশুমারিতে প্রথম মুসলমানদের নাম অর্ন্তভুক্ত করা হয়। তখন মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র তের জন। এ দেশে মুসলমানরা প্রথমে কানাডিয়ান প্যাসিফিক রেলওয়ে স্থাপনের সময় আগমন করে। পরবর্তীকালে আলবার্টায় কৃষিকাজ এবং অন্যান্য প্রদেশে কল-কারখানায় কাজের জন্য মুসলমানরা ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা থেকে আগমন করে। উচ্চ শিক্ষার জন্যও মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীরা বিভিন্ন দেশ থেকে কানাডার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ফলে ধীরে ধীরে মুসলিম সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। উল্লেখ্য, ১৯৬০ সালের পর থেকে কানাডায় মুসলিম ইমিগ্রেন্ট সংখ্যা বাড়তে থাকে। যেখানে ১৮৭১ সালে দেশটিতে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১৩ জন ১৯৮১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী তা ৯৮ হাজার ৯৭০ জনে উন্নীত হয়। দশ বছর পর ১৯৯১ সালে মুসলিম জনসংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৫৩ হাজারে। ২০০১ সালে এ সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৪ লাখেরও বেশি। বর্তমানে মুসলমানদের এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখে।

কানাডায় সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে অনেক সুযোগ-সুবিধা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকায় দেশটিতে বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলমানরা আগমন করার জন্য আকৃষ্ট হচ্ছে। অনেক মুসলিম দেশ থেকে বিত্তবান মুসলমানরাও ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য স্থায়ীভাবে কানাডায় বসবাস করছেন। ফলে দেশটিতে উত্তরোত্তর মুসলিম সংখ্যা বেড়ে চলছে। কানাডার সব শহরেই মুসলমানরা বাস করলেও কয়েকটি শহরে তাদের বসবাস বেশি লক্ষ করা যায়। মুসলমানদের প্রায় ৬০ শতাংশ বাস করে ওন্টারিও প্রদেশের বিশেষ করে টরেন্টো ও অটোয়ায়। ২০ শতাংশ মুসলিম বাস করে কুইবেক প্রদেশের মন্ট্রিয়েলে। যেসব দেশ থেকে প্রধানত মুসলিমরা কানাডায় এসে বাস করেন সেসব দেশ হলো পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য, আলজেরিয়া, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ এবং ভারত।

মুসলমানরা কানাডার উন্নতি, অগ্রগতি এবং সামাজিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে। দেশের সামগ্রিক অগ্রগতিতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ উল্লেখ করার মতো। দেশটির রাজনীতিতেও মুসলমানরা দৃশ্যমান অবদান রাখছেন। মূলধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে বেশ কয়েকজন মুসলিম এমপি এবং কাউন্সিলর নির্বাচিত হতে সক্ষম হয়েছেন। বিগত নির্বাচনে মুসলিম প্রার্থীদের ৪ জন নারীসহ ১২ জন নির্বাচিত হয়েছেন। কানাডায় অবাধ স্বাধীনতা থাকায় রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে মুসলমানদের কথা. দাবি-দাওয়া ইত্যাদি প্রচারের ব্যবস্থা রয়েছে। দেশটির বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং সরকারি দপ্তরে বহু মুসলিম উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা রয়েছেন যা যেকোনো অমুসলিম রাষ্ট্রের তুলনায় অনেক বেশি। দেশটির বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম অধ্যাপকের উপস্থিতি লক্ষ্য করার মতো। ব্যবসা-বাণিজ্যেও মুসলমানরা অন্য সম্প্রদায়ের চেয়ে কম এগিয়ে নেই। ১৯৯৩ সালের এক হিসেব থেকে জানা যায়, একজন নারীসহ ১০ জন মুসলমান ব্যবসায়ী কানাডিয়ান বিজনেস অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছিলেন। শিক্ষার ক্ষেত্রে মুসলমান ছাত্রদের অবদান অনেকটা ঈর্ষণীয়। শিক্ষাঙ্গনে স্নাতকধারীর ৩১ শতাংশ যেখানে মুসলিম সেখানে কানাডার মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ মাত্র স্নাতকধারী। এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, কানাডার মনট্ট্রিয়েল ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫২ সালে তাদের পাঠ্যক্রমে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করায় অনেক মুসলিম শিক্ষার্থী বিভিন্ন দেশ থেকে কানাডায় আসে এবং এর ফলে দেশটিতে মুসলিম সংখ্যা বেড়ে যায়।

কানাডার সমাজে মুসলমানদের কর্মতৎপরতা লক্ষণীয়।‘ ইসলামের প্রচার ও প্রসারে অনেক মুসলমান ব্যাপক তৎপর রয়েছেন। তারা মসজিদ নির্মাণ, ইসলামিক সেন্টার স্থাপন, মক্তব-মাদরাসা এবং ইসলামি স্কুল স্থাপনে অগ্রসর ভূমিকা পালন করছেন। কানাডার আলবার্টার রাজধানী এডমন্টনে প্রথম মসজিদ ‘আল-রাশিদ’ নির্মিত হয় ১৯৩৮ সালে। বর্তমানে কানাডায় প্রায় ১ হাজার ১৫০টি মসজিদ রয়েছে। দিন দিন মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে মসজিদের এ সংখ্যাও বাড়ছে। রাজধানী টরন্টোতে মুসলমানদের উদ্যোগে সর্ববৃহৎ ইসলামি ইন্সিটিটিউট কমপ্লেক্স রয়েছে। এ কমপ্লেক্সে একটি বড় মসজিদ রয়েছে যেখানে ৫ হাজার মুসল্লী একসাথে নামাজ আদায় করতে পারেন। এখানে পার্কিং লট, ফুটবল ও বাস্কেটবল খেলার মাঠ এবং ইসলামি স্কুলও রয়েছে। প্রায় ৫০ বিঘা জমির ওপর পাঁচ শতাধিক গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।

কানাডার প্রতিটি শহরে এ রকম অনেক ইসলামিক সেন্টার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। শুধু টরেন্টোতে এ ধরনের ১৬টি প্রতিষ্ঠান ও বড় কয়েকটি মাদরাসা রয়েছে। অনেক মসজিদ এমন আছে যেখানে মুসল্লীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় একাধিকবার জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানা যায়, কানাডার প্রায় ৭০ শতাংশ মুসলমান নিয়মিত মসজিদে গিয়ে জামায়াতের সাথে নামাজ আদায় করেন। প্রতি বছর রমযানে কানাডার অধিকাংশ মসজিদে তারাবির নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। আরো উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো দেশটিতে মুসলিম নারী, কিশোর-তরণীরা অবাধে ও নিঃসঙ্কোচে হিজাব পরে চলাচল করে। এতে কোনো বাধা বা ভয় নেই।

কানাডার সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ এতটাই সুন্দর ও অনুকূল যে, সে দেশে মুসলমানরা নির্বিগ্নে তাদের ধর্মীয় পরিচিতি নিয়ে সাবলীলভাবে বসবাস করছেন। ছোটখাটো প্রতিকূলতা ছাড়া কানাডার মুসলমানরা ভালোই আছেন। মহান আল্লাহ মুসলমানদের আরো বেশি সহায়তা করুন এবং কানাডায় ইসলামের প্রচার ও প্রসারে আরো অগ্রসর হওয়ার সুযোগ দান করুন।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।