‘ব্যক্তি’ এমন এক সত্তা যে সত্তার বিশেষ কিছু ক্ষমতা বা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে। ব্যক্তি অবশ্যই একজন মানুষ হবেন, যার মধ্যে মনুষত্বের গুণাবলী বিদ্যমান থাকে। তবে ব্যক্তি যে সকল প্রকার ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে এমনটা ভাবা কোনভাবেই যৌক্তিক নয়। মানুষের মানবীয় ভুলত্রুটি থাকাটাই স্বাভাবিক। বস্তুত, ব্যক্তিসত্তার সংজ্ঞানিরূপক বৈশিষ্ট্যগুলো এবং এর সূত্র ধরে কোন যুক্তিতে কোনও সত্তাকে ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হবে, তা সংস্কৃতি ও পরিপ্রেক্ষিতভেদে ভিন্নতর। তাই ব্যক্তির সংজ্ঞা সকল ক্ষেত্রেই এক ও অভিন্ন নয়।

বস্তুত, ব্যক্তিত্ব (Personality) বলতে পরিবেশগত ও শারীরিক উপাদানের প্রভাবে বিকশিত চারিত্রিক উদাহরণ আচরণ, বোধ, আবেগকে বুঝায়। মনবিজ্ঞানে ব্যক্তিত্ব হচ্ছে, কোনো একজনের মানসিক প্রক্রিয়া ও আচরণের এমন এক স্বতন্ত্র ধরন, যা কেবল তার মধ্যেই বিদ্যমান থাকবে যেটি কিনা অন্যদের কাছ থেকে সেই ব্যক্তিকে আলাদা করবে। এক কথায় ব্যক্তিত্ব এমন একটা জিনিস, যা একজন মানুষকে অন্য মানুষ থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। দেখা গেছে, ব্যক্তিত্বের উপর পরিবেশগত প্রভাব বিজ্ঞানীরা যতটা বিশ্বাস করত তার থেকে বেশি। তাই ব্যক্তিত্ব ও পরিবেশ একে অন্যের পরিপূরক এবং নিবিড় সম্পর্ক যুক্ত। তাই এতদোভয়ের ব্যবচ্ছেদ কোনভাবেই কল্পনা করা যায় না।

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষ ভিন্নতর আচরণ করে থাকে। কারণ, প্রেক্ষাপট মানুষকে অনেক কিছুই করতে বাধ্য করে। কিন্তু কেন মানুষ একই পরিস্থিতিতে সকলেই একই ধরনের আচরণ করে না, এর কারণ হচ্ছে মানুষের প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্ব আলাদা। ব্যক্তির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও পরিবেশগত উপাদানের সমন্বয়েই এর গঠন। ব্যক্তিত্বের গঠন ও বিকাশ কিভাবে হয় তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তত্ত্ব দেয়া হয়েছে। তত্ত্বগুলো নানা কারণেই আলোচিত-সমালোচিত হলেও মনোবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, সমাজবিদ ও শিক্ষকদের কাছে এগুলোর মূল্য ও গুরুত্ব অপরিসীম বলেই বিবেচিত হয়। শিশুদের আচরণের অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজতে গেলে এ তত্ত্বগুলো আমাদেরকে নির্মোহ দিকনির্দেশনা দেয়। এছাড়াও ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন লক্ষণ, যেমন-আত্মধারণা, সৃজনশীলতা ও উদ্বেগ নিয়েও ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। এ লক্ষণগুলো সম্পর্কে জানলে তা বর্তমান শিক্ষক ও আগামী দিনের শিক্ষকদের শিশুর আচরণ আরও ভালভাবে বুঝতে এবং শ্রেণীকক্ষে পাঠদান পদ্ধতিকে আরও উন্নত করতে সাহায্য করবে। আর তা খুবই প্রাসঙ্গিক ও যুক্তিযুক্ত।

বস্তত, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। একজন মানুষের মানবিক মূল্যবোধ, পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা, জ্ঞান অর্জন, আচার-আচরণ, সামাজিক দায়বদ্ধতা ইত্যাকার গুণাবলীর সমন্বয়ে ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের ব্যক্তিত্বের নিরিখেই নির্ধারিত তার পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। শৈশবকাল থেকেই প্রতিটি মানুষ কোন না কোন ব্যক্তিকে নিজের অজান্তে অনুসরণ-অনুকরণ করে। বড় হয়ে তার মত হতে চায়। এসব ব্যক্তির কথাবার্তা, আচার-আচরণ ও ব্যক্তিত্ব আমাদের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। তবে এ অনুসরণটি নির্ভর করে মানুষের জানার ও বোঝার পরিধির উপর। যা খুবই কাক্সিক্ষত ও যৌক্তিক।

আমাদের মধ্যে অনেকে আছেন যারা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি কথা বলেন। আর বেশি কথা বললে বেশি ভুলভ্রান্তি হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। দেখা যায়, বেশি কথা বলার অভ্যাসের ফলে হঠাৎ এমন কোন কথা মুখ থেকে অনাকাক্সিক্ষতভাবে বেরিয়ে আসে যা আমরা বলতে চাইনি। এছাড়া বেশি কথা বললে প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনীয় কথারই আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। এতে অনেক সময় নিজের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পরিবার-পরিজন এবং ঘনিষ্ঠজনদের সম্বন্ধে এমন কোন গোপন কথা বলে ফেলা হয়, যা বলা হয়ত মোটেই সঙ্গত ছিলো না। ফলে আমাদের বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। যা একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের জন্য মোটেই কাক্সিক্ষত ও শোভন নয়। কারণ, একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ অবশ্যই হবেন স্বপ্লভাষী। আর তিনি সব সময় থাকবেন বাহুল্যমুক্ত। একজন আদর্শবান ব্যক্তিকে কম কথায় অধিক ভাব প্রকাশ করা জরুরি। এছাড়া কথা বলতে হবে ধীরে সুস্থে, ভদ্র ও শালীনভাবে। এমন কথা বলা মোটেই সঙ্গত নয়, যে কথা ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের সাথে সাংঘর্ষিক।

সমাজে ভিন্নমত ছিল, আছে এবং আগামী দিনে থাকবে। তাই ভিন্নমতের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে নিজের উপলব্ধি ব্যক্তির গন্তব্য নির্ধারিত হওয়া উচিত। যুক্তিতর্কে কাউকে পরাজিত করার মানসিকতা সবসময়ই পরিতাজ্য। কারণ, এতে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের সঙ্কট দেখা দেয়। আমরা অনেক সময় বুঝে অথবা না বুঝে তর্ক জুড়ে দেই, মেজাজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি। চটুল ও বাজে কথা বলি এবং ক্ষেত্র বিশেষে ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলি। অনেক সময় দেখা যায় আমরা যা জানি না তা নিয়ে অহেতুক তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হই। নিজের পরাজয়ের আশঙ্কায় সত্যটা মেনে নিতে পারি না বরং এলোমেলো কথা বলে পাশ কাটানোর চেষ্টা করি। এটা ব্যক্তির সবচেয়ে বড় বদগুণ। আবার এর বিপরীত ঘটনাও লক্ষ্য করা যায়। অনেক সময় আমরা নিজের জানা সত্যটি প্রতিষ্ঠা করতে পারি না অন্যের অসহনীয় মনোভাবের কারণে। আমরা সবাই সব বিষয়ে জানি না, জানা সম্ভবও নয়। এজন্য যা জানি না তা নিয়ে বিতর্কে জড়ানো বোকামি ও মূর্খতা ছাড়া কিছুই না। অন্যের বলা সত্যটা মেনে নেওয়ায় নিজের সম্মানহানি হয় না। এতে সমাজে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে। যা ব্যক্তিত্বের বিকাশে সহায়ক হয়।

চিকিৎসকরা মনে করেন, মন খুলে হাসাহাসি করলে নাকি অনেক রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। সুস্থ থাকে দেহ ও মন। তবে পরিবেশ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে হাসির ধরন নির্ধারিত হওয়া উচিত। কারণ, স্থান-কাল-পাত্রভেদ বলে তো একটা কথা আছেই। মূলত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলোতে অট্টহাসি পরিহার করাই বাঞ্চনীয়। এতে অনুষ্ঠানের পরিবেশ বিনষ্ট হতে পারে। এছাড়া কথা বলার সময় বক্তার সাথে আই কন্ট্রাক্ট করা দরকার। কথা শুনার সময় অবশ্যই মনোযোগী হতে হবে, খামখেয়ালি হলে চলবে না। বলার সময় গুছিয়ে অল্প কথায় বিষয়টি শেষ করতে হবে। এছাড়া সমাজ ও পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে আলাপের বিষয় ও ধরন। নিজের কোন ভুল হলে তর্কে না জড়িয়ে সরাসরি এজন্য দুঃখপ্রকাশ করা খুবই বুদ্ধিমানের কাজ। এতে উপস্থিত মানুষের মধ্যে নিজের বিনয়-নম্রতা ও ভদ্রতা প্রকাশ পায়; সমাজে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।

আমাদের মধ্যে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা অনর্গল কথা বলতে অভ্যস্ত, কিন্তু অন্য কাউকে বলার কোন সুযোগ দিতে মোটেই রাজি নন। এটা খুবই বাজে ও গর্হিত স্বভাব। এধরনের মানুষকে কেউ পছন্দ করে না। আগে অন্যকে কথা বলতে দিতে হবে, তাদের কথা ও যুক্তিগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। অন্যকে সম্মান দিয়ে কথা বলাটাও জরুরি। কাউকে বোঝাতে যাবেন না আপনিই শ্রেয়। এমনটি মানবচরিত্রে বদগুণ হিসাবে বিবেচিত। আর এটি অহমিকারই নামান্তর। তাই এ বিষয়ে আমাদের সকলকে সতর্ক থাকা খুবই জরুরি। (চলবে)