জুলাই বিপ্লব কি ব্যর্থ করার চেষ্টা চলছে? সে প্রশ্ন এখন আত্মসচেতন মানুষের মনে রীতিমত ঘুরপাক খাচ্ছে। কারণ, বিপ্লবোত্তর পতিত স্বৈরাচার নানাভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করে এসেছে। যাতে অর্জিত বিজয় বিতর্কিত ও নস্যাৎ করা যায়। কিন্তু তাদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করা হয়েছিলো। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা নতুন করে নানা শঙ্কার সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশের নয়াদিল্লি ও কোলকাতায় পতিত আওয়ামী লীগের অফিস খোলার খবর রীতিমত আঁৎকে ওঠার মত। যা অর্জিত বিপ্লব নস্যাৎ করতে প্রতিবেশী দেশের গভীর ষড়যন্ত্রের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। কারণ, তারা কখনোই স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় না।

এখানেই শেষ নয় বরং দেশে একের পর এক নানা ধরনের অঘটন ঘটতে শুরু করেছে। যা অন্তর্বর্তী সরকারকে শুধু বিব্রত করা নয় বরং বিপ্লব ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্র বলেই মনে করা হচ্ছে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নূরুল হক নূরের ওপর হামলার ঘটনা। গত ২৯ আগস্ট রাতে নূরের ওপর এমন বর্বরোচিত হামলার চালানো হয়। যা রীতিমত আৎকে ওঠার মত। কারণ, বিপ্লবোত্তর অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এ ধরনের অনাক্সিক্ষত ঘটনা কোনভাবেই কাম্য ছিলো না। যা দেশ ও জাতিস্বত্ত্বাবিরোধী গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ বলেই মনে করা হচ্ছে। মূলত, সেনাবাহিনী ও পুলিশের হামলায় নূর আহত হওয়ার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এ ন্যক্কারজনক ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। জামায়াতে ইসলামী বিক্ষোভ কর্মসূচিও পালন করেছে। এ ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ার পর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর বা আইএসপিআর প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সেনাবাহিনীর অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে। ঘটনাস্থলে ‘মব ভায়োলেন্সের’ মাধ্যমে পরিস্থিতি অশান্ত করার চেষ্টা হয়েছে উল্লেখ করে আইএসপিআরের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জননিরাপত্তা রক্ষার্থে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বল প্রয়োগে বাধ্য হয়’। তবে সেনাবাহিনীর এ বিজ্ঞপ্তি প্রত্যাখ্যান করে গণঅধিকার পরিষদ বলেছে যে, জাতীয় পার্টিকে সুরক্ষা দিতেই নূরসহ গণঅধিকার পরিষদের নেতাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনকে ব্যাহত করতে রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থির করার জন্য একটা মহল কাজ করেছে’।

জাতীয় পার্টি দীর্ঘ ৯ বছর দেশে স্বৈরশাসন চালিয়েছিলো। ধ্বংস করেছিলো দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে। কিন্তু ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনে পতনের পর তারা আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সহযোগী হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের আওয়ামী লীগের তামাশা ও ভাঁওতাবাজীর নির্বাচনের অন্যতম সহযোগি ছিলো জাতীয় পার্টি। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও গণপলায়নের পর রাজনীতিতে বেশ কোণঠাসা অবস্থায় ছিল জাতীয় পার্টি। বিভিন্ন মহল থেকে স্বৈরাচারের সহযোগী হিসাবে দলটিকে নিষিদ্ধ করার জোরদার দাবিও ওঠে। গণঅধিকার পরিষদও সে দাবির সাথে একাত্ম ছিলো এবং সে লক্ষ্যে তারা কর্মসূচি দিয়েছিলো। কিন্তু সে কর্মসূচিকে কেন্দ্র করেই বিপত্তি ঘটেছে। জাতীয় পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সেনা ও পুলিশ সদস্যদের মারধরে গুরুতর আহত হয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নূরুল হক নূর। বিষয়টিকে কেউই স্বাভাবিকভাবে দেখছেন না বরং এটিকে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র হিসাবেই বিবেচনা করা হচ্ছে। সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের মারধরে নূর আহত হওয়ায় নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি এ ঘটনায় আইনসম্মত তদন্তের দাবি জানান সরকারের কাছে। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘এভাবে একটা দলের প্রধানকে নির্মমভাবে আঘাত করা হলো, তার সাথে ৫০ জন আহত হলো। এগুলো তো মেনে নেওয়া যায় না’। অবশ্য অন্তর্বর্তী সরকার জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির অংশ হিসাবেই ইতোমধ্যেই বিচারপতি মো. আলী রেজার নেতৃত্বে এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে এবং এতদসংক্রান্ত গেজেটও প্রকাশিত হয়েছে। সরকারের পক্ষে জানানো হয়েছে, প্রভাব বা পদমর্যাদা যাই হোক না কেন, জড়িত কোনো ব্যক্তি জবাবদিহিতা থেকে রেহাই পাবে না। স্বচ্ছতা এবং দ্রুততার সাথে এর বিচার সম্পন্ন করা হবে’। এর আগে ৩০ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের ব্রিফিংয়ে বলা হয়, ‘হাইকোর্টের একজন বিচারপতিকে প্রধান করে গঠিত একটি কমিটি ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত করবে এবং দোষীদের শনাক্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করবে’। সে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ি গঠিত হয়েছে বিচারবিভাগী তদন্ত কমিটি।

নূরুল হক নূরের ওপর এমন নির্মম হামলা কেউই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিচ্ছেন না বরং এটিকে জুলাই বিপ্লব বিরোধী ষড়যন্ত্র বলেই মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও অনেকে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘পরিস্থিতিকে অস্থির করার জন্য একটা মহল কাজ করেছে। আমি ঠিক জানি না এক্সাক্টলি কারা এটা করছে। কিন্তু করা হচ্ছে এটা। ব্যাপারটা নিয়ে আমরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন’। প্রায় একই ধরনের শঙ্কার কথা বলছে জামায়াতে ইসলামীও। কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘এটা যে এ্যাক্সিডেন্টাল ঘটনা সেটাও মনে হচ্ছে না। একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটের দিকে যাচ্ছে মনে হয়। কে বা কারা এর পেছনে ইন্ধন যোগাচ্ছে’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্টে কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে সরকার ও নির্বাচন কমিশন থেকে। এ নির্বাচন পেছানোর জন্যও ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে এমন আশঙ্কার কথাও কেউ কেউ জানিয়েছেন। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এ ঘটনায় ঠিক নির্বাচন পেছানোর মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘শুক্রবারের ঘটনায় নানা রকম উসকানি আছে। এটা নিয়ে একটা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে নির্বাচনটা সময়মতো হবে কি হবে না। পরিস্থিতি ঘোলা করে নানা রকমের সুবিধা নিয়ে যারা লাভবান হয়, তারা এগুলো করে।’ তার মতে, কিছু রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি বা গোয়েন্দা সংস্থাও মাঝে মাঝে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করে এবং কাকরাইলে গণঅধিকার ও জাতীয় পার্টির সংঘর্ষের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তাহলে কি এমন পরিস্থিতির কারণে নির্বাচন পেছানো বা নির্বাচন নিয়ে কোনো জটিল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে? এ প্রশ্নে মি. আহমদ বলছেন, এ ঘটনা রাজনীতি বা আগামী নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে না।

বস্তত, জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তন করে দেয়। এক সময় মনে করা হয়েছিলো যে, স্বৈরাচার ও ফ্যাসীবাদের জগদ্দল পাথর যেভাবে জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছে, তা থেকে আপাত পরিত্রাণের কোন পথ নেই। কিন্তু ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব জাতিকে নতুন করে আলোর পথ দেখিয়েছে। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৩৬ জুলাই তথা ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন ফ্যাসিবাদ জননী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্ষমতার মসনদে চেপে বসা ১৬ বছরের স্বৈরাচারের অবসান হয়েছে। এরপর ৮ আগস্ট দেশের দায়িত্ব নেয় প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। পরবর্তীতে ৫ আগস্টকে গণঅভ্যুত্থান দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার।

জুলাই আন্দোলন কোন রাজনৈতিক আন্দোলন ছিলো না। কিন্তু বাকশালী নেত্রী শেখ হাসিনা অতিমাত্রায় সীমালঙ্ঘনের কারণেই তা রাজনৈতিক রূপ নেয় এবং তা সরকারের পতন নিশ্চিত করে। মূলত, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার দাবিতে গত বছর ১ জুলাই শুরু হয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি সরকার মেনে নেয় নি বরং পেশীশক্তির মাধ্যমে তা দমন করার চেষ্টা চালিয়েছে। আন্দোলন চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেপরোয়া গুলী, গণগ্রেফতার এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলা ও সংঘর্ষ একপর্যায়ে সরকার পতনের একদফা দাবিতে রূপ নেয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট কারফিউ ভেঙে গণভবন অভিমুখে লাখো মানুষের ঢল নামলে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর ৬ আগস্ট দুপুরে বঙ্গভবন থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেছেন। এতে উল্লেখ করা হয়, তিন বাহিনী প্রধান, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বৈঠকের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এক তরফাভাবে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একচ্ছত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন শেখ হাসিনা। অর্থাৎ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ মাত্র ছয় মাসের মাথায় ভেঙে দেয়া হয়।

ভারতের সমর্থনে টানা ১৬ বছর দেশের ওপর চেপে বসেছিল ভয়ংকর স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। তার ফ্যাসিবাদী শাসন আমলে মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। এর বিরুদ্ধে জেগে ওঠেন ছাত্র-জনতা। তবে আন্দোলন দমাতে বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড চালান হাসিনা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের (ওএইচসিএইচআর) ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টে বলা হয়, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ঘটনায় ১১৮ শিশুসহ এক হাজার ৪০০ জনকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। শিশু হত্যার হার ১২-১৩ শতাংশ। আহত হয়েছেন প্রায় ১২ হাজার। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এ নৃশংস পথ বেছে নেন হাসিনা।

টানা ১৬ বছরের স্বৈরাচারী অপশাসনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিস্ফোরণ ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থান। জুলাই অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল একটি বৈষম্যহীন, দুর্নীতি ও স্বৈরাচারমুক্ত নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে রাষ্ট্রকে জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেয়া। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরে এসব লক্ষ্য বাস্তবায়নে রাষ্ট্রযন্ত্রের সবখাতে ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। জুলাই গণহত্যার বিচার কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে। জুলাই শহীদদের স্মৃতি রক্ষা ও আহত জুলাই যোদ্ধাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে রাজনৈতিক ও নির্বাচনব্যবস্থা এবং প্রয়োজনীয় সব সংস্কারে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সাথে আলোচনা চলমান আছে। একটি টেকসই রাজনৈতিক সমাধানের পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে অন্তর্বর্তী সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। জুলাই আমাদের নতুন করে আশার আলো-একটি ন্যায় ও সাম্যভিত্তিক, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে। হাজারো শহীদের আত্মত্যাগ আমাদের রাষ্ট্র সংস্কারের যে সুযোগ এনে দিয়েছে তা যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। পতিত স্বৈরাচার ও তার স্বার্থলোভী গোষ্ঠী এখনো দেশকে ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। গত বছর ৫ আগস্ট পতন ও পলায়নের পর আওয়ামী বাকশালীরা বিভিন্ন রূপে দৃশ্যপটে ফিরে আসার চেষ্টা করেছে। দেশকে অশান্ত ও অস্থিতিশীল করে তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করেছে।

মূলত, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার দুর্নিবার গণ-আন্দোলনের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একদশকেরও বেশি সময় ধরে চলা নিপীড়নমূলক শাসনের অবসান হয় এ দিনে। পতন ঘটে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারে। যার পরিণতিতে দেশ প্রবেশ করে এক নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ে। কিন্তু ফ্যাসিবাদ শুধু সরকারের পতনে শেষ হয়নি। গেল এক বছরে বহুবার নানা ছদ্মবেশে, নানা প্রলোভন ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তা ফিরে আসার চেষ্টা করেছে। তবে জনগণের সচেতনতা, ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ অবস্থান এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দৃঢ়তায় সেসব চেষ্টা প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে।

আওয়ামী সরকারের পতনের তিন দিন পর, ৮ আগস্ট, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপরই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে-১১ আগস্ট প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ফুল কোর্ট সভা ডাকেন, যা শিক্ষার্থীদের ভাষায় ছিল ‘জুডিশিয়াল ক্যু’-এর চেষ্টা। হাইকোর্ট ঘেরাও করে শিক্ষার্থীরা সে প্রচেষ্টা প্রতিহত করে। বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি। এতে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে ক্ষমতা দখলের অপচেষ্টা।

২৩ আগস্ট আনসার সদস্যদের বিদ্রোহ এবং ২৫ আগস্ট সচিবালয়ের গেট ভেঙে হামলা ছিল ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের আরেকটি বড় প্রয়াস। তবে এ আন্দোলনে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ছদ্মবেশী সম্পৃক্ততা দ্রুতই প্রকাশ্যে আসে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের মুখে আনসারদের পিছু হটতে হয়। এর আগে ১৪ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া গ্রাম পুলিশ সদস্যদের আন্দোলনও সড়ক অবরোধ এবং সচিবালয় ঘেরাওয়ের মাধ্যমে অস্থিরতা তৈরি করেছিল। এসব আন্দোলনের পেছনে গোপনে ছিল পরাজিত সরকারের পরিকল্পিত মদদ ও উত্তেজনা সৃষ্টির অপচেষ্টা।

২০২৫ সালের জানুয়ারিতে সাত কলেজ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনও গোপনে সরকার পতনের নকশার অংশ ছিল বলে কেউ কেউ মনে করেন। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের দাবিসমূহ আংশিক মেনে নেয়ার কৌশলে সে ষড়যন্ত্র প্রতিহত হয়। এরপর গার্মেন্ট শ্রমিকদের আন্দোলন ছিল আরো সুগঠিত চক্রান্তের অংশ। ঈদের আগে বকেয়া পরিশোধ, বোনাস ইত্যাদি দাবিকে সামনে রেখে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সামনে তিন দিনের অবস্থান কর্মসূচিতে নামে শ্রমিকরা। ২৪-২৫ মার্চের সংঘর্ষে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়, যার পেছনে শ্রমিক লীগের সক্রিয় ইন্ধন পাওয়া যায়। সাভার, গাজীপুর, আশুলিয়ায় অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়লেও সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়।

মে মাসে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলনও ছিল পতিত আমলাতান্ত্রিক শক্তির সর্বশেষ প্রতিরোধ। অন্তর্বর্তী সরকারের একটি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে আমলারা সরব হয়। প্রথমে নমনীয় অবস্থান দেখালেও সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আন্দোলন থেমে যায়। ঘটনাগুলো ফ্যাসিবাদী চেতনার পুনরুজ্জীবনের নমুনা। প্রতিবারই গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য ও জনগণের জাগরণ এই শক্তিকে প্রতিহত করেছে।

গোপালগঞ্জে এনসিপির পদযাত্রা ও উত্তরায় মাইলস্টোন কলেজের ওপর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাকে ঘিরে আবারো রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়। গোয়েন্দা তথ্য মতে, এ ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। বরং দিল্লিতে আত্মগোপনে থাকা শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ পরিকল্পনার ফলাফল হিসেবে এগুলোকে দেখা হচ্ছে। এ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে এখনো দেশে সক্রিয় রয়েছে ফ্যাসিবাদী সরকারের সুবিধাভোগী আমলা, পুলিশ ও নিষিদ্ধ ছাত্র-যুব-শ্রমিক লীগ নেতাকর্মীরা। অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল করতে তারা এখনো সক্রিয়।

এক বছর পেরিয়ে এলেও ফ্যাসিবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র থেমে নেই। তবে শিক্ষার্থী-জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ, রাজনৈতিক দলগুলোর সতর্কতা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দৃঢ়তা এখন পর্যন্ত এসব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়েছে। তবে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নূরুল হক নূরের ওপর নির্মম হামলা জনমনে নানাবিধ সন্দেহ-সংশয়ের সৃষ্টি করেছে। বিষয়টিকে কেউ কেউ পূর্ব পরিকল্পিত বলে উল্লেখ করছেন। যা অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ, আসন্ন নির্বাচন বাঞ্চাল ও দেশকে অস্থিতিশীল করার দিকেই অঙ্গুলী নির্দেশ করে। তাই এ বিষয়ে একেবারে নির্লিপ্ত থাকার সুযোগ নেই।

জুলাই বিপ্লব আমাদের জাতীয় জীবনের উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। এ বিপ্লব আমাদের জন্য দ্বিতীয়বারের মত স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। কোন অশুভ শক্তি যাতে এ বিপ্লব ছিনিয়ে নিতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। নূরের ওপর হামলা দেশ ও জাতিস্বত্তাবিরোধী ষড়যন্ত্র কি না তাও খতিয়ে দেখার আবশ্যকতা রয়েছে। মনে রাখতে হবে, ৫ আগস্ট শুধুই একটি তারিখ নয়, এটি ফ্যাসিবাদ পতনের প্রতীক। তাই ফ্যাসিবাদ যাতে নতুন করে ফিরে আসার সুযোগ না পায় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা জরুরি। আর নূরের ওপর হামলার বার্তা নিয়েও ভাবতে হবে আমাদেরকে।