গণমানুষের কল্যাণের ধারণা বা চিন্তা থেকেই প্রচলিত রাজনীতির পথচলা শুরু হয়েছে। কিন্তু কালের বিবর্তনে রাজনীতির ইতিবাচক ধারার বড় ধরনের বিচ্যুতি ও কক্ষচ্যুতি ঘটেছে। বিশেষ করে আমাদের দেশের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা আরো প্রান্তিকতায় এসে পৌঁছেছে। মূলত, একশ্রেণির রাজনীতিকরা রাজনীতিকে কল্যাণমূখীতার পরিবর্তে আত্মস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, ক্ষুদ্র ব্যক্তি ও সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার মোক্ষম হাতিয়ারে পরিণত করেছেন। ফলে রাজনীতি হারিয়ে ফেলেছে ইতিবাচক ও কল্যাণমুখী বৈশিষ্ট্য। ক্ষেত্র বিশেষে একশ্রেণির কুশীলবরা রাজনীতিকে ভিক্ষা বৃত্তির মোক্ষম অনুষঙ্গে পরিণত করেছেন। যা কালজয়ী কথাশিল্পি মানিক বন্দোপধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র ভিখারীনি পাঁচী ও দস্যু ভিখুর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। যা সংশ্লিষ্টদের আত্মপ্রবঞ্চণা বৈ কিছু নয়।

স্বাধীনতা উত্তরকালে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করতে যখন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা প্রয়োজন ছিলো, ঠিক তখনই মহল বিশেষ রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য জাতিকে বিভক্ত করার মিশন শুরু হয়। ক্রমেই তা ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়ে ওঠে এবং জাতীয় বিভাজন জোরালো ভিত্তি পায়। মূলত, তখনই একটি শিশু রাষ্ট্রে স্বাধীনতার বিপক্ষ ও স্বপক্ষের ধূঁয়া তুলে জাতিস্বত্ত্বার মর্মমূলেই আঘাত করা হয়েছিলো। তৈরি করা হয়েছিলো অভিনব ও অতিচটকদার সব নেরেটিভ। এসব রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চরিত্র হননের কাজে লাগানো হতো। যা জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে এখনো সবচেয়ে বড় অন্তরায়। মূলত, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে স্বাধীনতা বিরোধী, রাজাকার, আল বদর ও আস-সামস সহ নানাবিধ অপবিশেষণে বিশেষিত করে প্রতিপক্ষকে নির্মমভাবে হত্যা, ভিন্নমতাবলম্বীদের নাগরিকত্ব বাতিল, হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারারুদ্ধ করে নির্যাতন সহ সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে দেশে একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করা হয়েছিলো। কলুষিত করা শুরু হয়েছিলো আমাদের দেশের প্রচলিত রাজনীতিকে। ফলে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো জাতীয় বিভাজন। আমরা মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে রাজনীতির গতি-প্রকৃতি এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেয়ার জন্য প্রয়াসী হবো। যা পাঠকদের রাজনীতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিতে কিছুটা হলেও সহায়ক হবে।

বস্তুত, রাজনীতি; রাষ্ট্রনীতি কিংবা রাজবুদ্ধি হলো দলীয় বা নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ক্ষমতার সম্পর্কের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিষয়ক কর্মকাণ্ডের সমষ্টি। আসলে, রাজনীতি একটি বহুমুখী শব্দ। সঙ্গত কারণেই এর ব্যাপ্তি ও পরিসর খুবই বিস্তৃত। এটি আপোসের ও অহিংস রাজনৈতিক সমাধানের ক্ষেত্রে ইতিবাচক অর্থে অথবা সরকার বিষয়ক বিজ্ঞান বা কলা হিসেবে বিশদভাবে ব্যবহৃত হতে পারে বা হয়ে আসছে। যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই হচ্ছে আর্ত-মানবতার কল্যাণ। একথা অনস্বীকার্য যে, রাজনীতিতে বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে কারও নিজস্ব রাজনৈতিক অভিমত, আদর্শ ও মূল্যবোধ মানুষের মধ্যে প্রচার, অপরাপর রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মতবিনিময়, আইন প্রনয়ন এবং বল প্রয়োগের চর্চা। তবে তা হতে হবে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে; আর্ত-মানবতার বৃহত্তর কল্যাণে। ঐতিহ্যবাহী সমাজব্যবস্থায় গোত্র ও গোষ্ঠী থেকে শুরু করে আধুনিক স্থানীয় সরকার, ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত। আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রগুলোতে মানুষ প্রায়ই নিজস্ব মতবাদ তুলে ধরতে রাজনৈতিক দল গঠন করে। কোন দলের সদস্যগণ প্রায়শই বিভিন্ন বিষয়ে সহাবস্থানের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করে এবং আইনের একই পরিবর্তন ও একই নেতার প্রতি সমর্থনে সহমত হয়। এক্ষেত্রে নির্বাচন হলো সাধারণত বিভিন্ন দলের মধ্যে একটি নৈতিক ও আদর্শিক প্রতিযোগিতা মাত্র। রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু সে প্রতিযোগিতা অবশ্যই হতে হবে আদর্শিক ও মূল্যবোধভিত্তিক। যেকোন মূল্যে অনৈতিক সুবিধা লাভ রাজনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হতে পারে না।

অবশ্য মনীষীগণ রাজনীতির সংজ্ঞা নানাভাবেই দিয়েছেন। এক্ষেত্রে সামান্য মতভিন্নতা থাকলে মূলত নির্যাসটা একই। ডেভিড ইস্টনের মতে, ‘রাজনীতি হল কোন সমাজের জন্য মূল্যবান বিষয়গুলোর কর্তৃত্বপূর্ণ সুষম বণ্টন’। আড্রিয়ান লেফ্টউইচ রাজনীতির সংজ্ঞা দিয়ে বলেছেন, ‘রাজনীতি সমাজে সমবায়, মতবিনিময় ও দ্বন্দ্বের সকল কাজের জন্ম দেয়, যার দ্বারা মানুষ তাদের জৈবিক ও সামাজিক জীবনের উৎপাদন ও প্রজননের নিমিত্তে মানবীয়, প্রাকৃতিক ও অন্যান্য সম্পদ ব্যবহার, উৎপাদন ও বণ্টনের ব্যবস্থাপনা সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করে’। ইবনে সিদার-এর মতে, বিষয়াবলির ব্যবস্থাপনা করাই হল সিয়াসাত বা নীতি বা রাজনীতি। সাহিব ইবনে আব্বাদও একই মত পোষণ করে বলেন, সিয়াসাত বা রাজনীতি হল রাজনীতিবিদ বা শাসকের কাজ, প্রশাসক তার প্রজাদের শাসন করে, আর তার নিম্নস্তরের শাসকেরা তাদের নিম্নস্তরের প্রজাদের শাসন করে।

একথা সর্বজনবিদীত যে, রাজনীতিতে মতপার্থক্য, প্রতিপক্ষকে মোকাবেলার নানা কলাকৌশল থাকলেও তা হতে হবে দেশ, জাতি ও আর্ত মানবতার কল্যাণে নিবেদিত এবং মূল্যবোধভিত্তিক। গুণীজনেরা রাজনীতিকে রাজার নীতি না বলে নীতির রাজা বলাকেই অধিক যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন। তাই রাজনীতিতে কৌশল গ্রহণের নামে কারো প্রতি অহেতুক দোষারোপ, অপবাদ দান, সহিংসতা ও হানাহানি কোনভাবেই স্বীকৃত নয়। সংশ্লিষ্টদের একথা মনে রাখা উচিত, কৌশল যখন প্রকাশ পায়, তখন তা আর কৌশল থাকে না বরং সকলের কাছে মিথ্যা হিসাবে বিবেচিত হয়। আর জনগণের কাছে একবার বিশ্বাস হারালো বিশ্বাসযোগ্য হওয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। বস্তুত, রাজনীতৈক দর্শন ও আদর্শে ভিন্নতা থাকলেও নৈতিকতা বা মূল্যবোধ চর্চার ক্ষেত্রে কোনভাবেই আপোষ করার সুযোগ নেই বরং দেশ, জাতি ও মানুষের কল্যাণে দলমত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকাই বাঞ্ছনীয়। মূলত, রাজনীতি মানুষের জন্য; রাজনীতির জন্য মানুষ নয়। একথা সংশ্লিষ্টরা স্মরণ রাখলেই তা হবে দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, স্বাধীনতা উত্তরকালে নেতিবাচক রাজনীতির কারণে আমাদের দেশের রাজনীতি গণমুখী চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। ভিন্নমতাবলম্বীদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মনে না করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যক্তিগত বা একেবারে জান-প্রাণের শত্রু বানানো হয়েছে। যা আমাদের দেশের রাজনৈতিক শিষ্টাচার, সংস্কৃতি, সৌন্দর্য ও মূল্যবোধকে ধ্বংস করতে সহায়ক হয়েছে। একথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। এর সাথে কোন কিছুর তুলনা করার সুযোগ নেই। কিন্তু আমাদের চরম দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতা অর্জনের পর আমরা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারিনি বা ঐক্যবদ্ধ হতে দেয়া হয়নি। জাতীয় বিভাজন আমাদের জাতিস্বত্ত্বাকেই দুর্বল করে দিয়েছে। শ্রেণি ও গোষ্ঠী বিশেষের নেতিবাচক রাজনীতি ও অভিসন্ধির কারণে আমাদের স্বাধীনতার সুফলগুলো পুরোপুরি ঘরে তোলা যায়নি। ফলে স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরেও আমাদের প্রাপ্তিগুলো আজো অনেকটাই অধরাই রয়ে গেছে। তারা ১৯৭১ সালের মহান অর্জনকে রীতিমত ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করেছে। এরা নিজেদের প্রয়োজনে অতীতে যে কাউকে স্বাধীনতার পক্ষ বা বিপক্ষ শক্তি বানিয়েছে, এখনো বানাচ্ছে এবং আগামী দিনেও এ শুভ তৎপরতা অব্যাহত রাখা হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদ পতন আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামী ৮ দল, ৭ দল ও ৫ দলের সাথে যুগপৎ আন্দোলন করেছে এবং সে আন্দোলন সফল হয়েছে। এমনকি ১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর সরকার গঠনের জন্য জামায়াতের সহযোগিতা নিতে হয়েছে বিএনপিকে। তখন কেউ বা কোন পক্ষই জামায়াতের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ, স্বাধীনতা বিরোধী বা রাজকার-আল বদরের অভিযোগ তোলেনি। এমনকি ১৯৯৬ সালে নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে বিএনপির বিরুদ্ধে জামায়াতের সাথে আওয়ামী লীগ যুগপৎ আন্দোলন করেছিলো। তখনও এ অভিযোগ তোলা হয়নি। কিন্তু ২০০৮ সালে পাতানো ও ষড়যন্ত্রের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ উপলব্ধি করতে পারে যে, জামায়াতকে শায়েস্তা করতে না পারলে তাদের ক্ষমতা নির্বিঘ্ন ও নিরঙ্কুশ হবে না। তাই তারা প্রতিবেশীদের প্রেসক্রিপশনে যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক একটি মিমাংসিত বিষয়কে নতুন করে ইস্যু বানিয়েছে এবং কথিত বিচারের নামে প্রহসন করে জনপ্রিয় জাতীয় নেতাদের নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। যা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কোন মহলের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি মূলত, বিগত আওয়ামী শাসনামলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়ের করার জন্য কথিত যুদ্ধাপরাধ-স্বাধীনতা বিরোধী ও রাজাকার-আল বদর ছিলো প্রধান ইস্যু। সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললে সবার গায়েই এ তকমা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। আর এভাবেই দীর্ঘায়িত করা হয়েছিলো প্রায় ১৬ বছরের অপশাসন-দুঃশাসন।

তবে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী-বাকশালীদের লজ্জাজনক পরাজয় হয়েছে। দলনেত্রী সহ দলীয় নেতাকর্মীরা রীতিমত বিদেশে পালিয়েছেন। আবার কেউ কেউ গ্রেফতারও হয়েছেন। অনেকেই দেশেই আত্মগোপন করে আছেন বলে শোনা যায়। মনে করা হয়েছিলো যে, ফ্যাসিবাদের পতনের পর রাজাকার, স্বাধীনতা পক্ষ-বিপক্ষ ইস্যুর অবসান ও অপমৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু আমাদের চরম দুর্ভাগ্যই বলতে হবে যে, ফ্যাসিবাদের অনুপস্থিতিতে সে শূন্যস্থান অন্যরা ইতোমধ্যেই পূরণ করে নিয়েছে। তাদের মুখেও এখন রীতিমত রাজকারের জিকির-আজকার শোনা যাচ্ছে। প্রতিধ্বনিত হচ্ছে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষের গল্পকথা। অথচ ইতিহাস বলছে ভিন্নকথা। ১৯৯০-এর এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ও ২০০১ সালের ৪ দলীয় জোটের ব্যানারে নির্বাচন এবং যুগপৎভাবে সরকারও গঠন করা হয়েছিলো এসব কথিত রাজাকারদের সাথে নিয়েই। আবার ২০১৮ সালের নির্বাচনে এসব রাজাকারদের হাতেই ধানের শীষ প্রতীক তুলে দেয়া হয়েছিলো। তখন কিন্তু এসব অভিযোগ তোলা হয়নি। এতে সহজেই প্রমাণিত হয় যে, রাজাকার বা স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ ইস্যুটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অপকৌশল মাত্র।

স্বাধীনতা বিরোধী বা রাজকার ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক ময়দানে আওয়ামী লীগ যেভাবে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করেছিলো, তাদের উত্তরসূরিরা একইভাবে সে কাজ করে যাচ্ছেন। পতিত স্বৈরাচারের মত তাদের শোনা যাচ্ছে একই কোরাস। একাত্তর সালে যেসব শিক্ষার্থীদের মা-বাবার জন্মই হয়নি তাদেরকে স্বাধীনতা বিরোধী বা রাজকার বলতে কসুর করছেন না। এতে প্রমাণ হয় হীন রাজনৈতিক অভিসন্ধি ও অন্ধ ক্ষমতালিপ্সা তাদেরকে আদর্শিকভাবে দেউলিয়া করে ফেলেছে। এখন চলছে তাদের দেউলিয়াত্বের মাতম। যা তাদেরকে ক্রমেই ব্যাকফুটে ফেলে দিচ্ছে এবং ইতোমধ্যেই তারা রীতিমত ক্ষয়িষ্ণু শক্তিকে পরিণত হয়েছে। এ বিষয়ে তারা যদি বাস্তবতা উপলব্ধি করে তাহলে তাদেরকে ভবিষ্যতে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে।

আওয়ামী শাসনামলে অনেক খারাপ কাজ করলেও তারা একটি অতি প্রশংসনীয় কাজ করেছিলো। তারা ২০১৯ বিজয় দিবসের প্রাক্কালে একটি রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করে। প্রকাশিত এ তালিকায় যাদের নাম ছিলো তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৮০৬০ আওয়ামী লীগের, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিএনপির ১০২৪, তৃতীয় স্থানে ৮৭৯ জন ছিলো অন্য দলের। তালিকায় সর্বনিম্নে ৩৭ জন ছিলো জামায়াতের। কিন্তু মজার বিষয় হলো যাদেরকে কথিত বিচারের নামে প্রসহন করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিলো তাদের কারো নামই এ তালিকায় ছিলো না। তাহলে আসল রাজাকার কারা তা এ তালিকা থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। দেশবাসী প্রকৃত অবস্থা জানতে পারে।

মূলত, একশ্রেণির রাজনীতিকদের ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণেই আমাদের দেশের রাজনীতি গণমুখী চরিত্র হারিয়েছে। দেশ ও জাতির স্বার্থের পরিবর্তে আত্মস্বার্থ, ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ ও সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ স্থান করে নিয়েছে। ফলে এখন সবার ওপরে ক্ষমতাকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন। একশ্রেণির রাজনীতিকের কাছে এখন রাজনীতি হয়ে ওঠেছে ব্যবসা ও আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার প্রধান অনুষঙ্গ। এমনকি তা রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তিতেও রীতিমত কাজে লাগানো হচ্ছে। বিষয়টি কালজয়ী কথাশিল্পি মানিক বন্দোপধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের বিখারিনী ‘পাঁচী’ চরিত্রের সাথে বেশ সঙ্গতিপূর্ণ। একদিন দস্যূ ভিখু তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, তার এ ঘা নিরাময়যোগ্য কি-না? সে অবলীলায় জানিয়েছিলো, অবশ্যই নিরাময়যোগ্য কিন্তু ঘা সেরে গেলে তার ভিক্ষা করার কোন উপলক্ষ্য থাকবে না। তাই সে এ ঘা সারাতে চায় না। অভিজ্ঞমহলের মনে করছেন, আমাদের দেশের একশ্রেণির রাজনীতিকরা রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তির জন্য অনাকাক্সিক্ষত পাঁচীর ঘায়ের মত সযতনে লালন করছেন। যা তাদের রাজনীতির মূলধন ও অন্যতম অনুষঙ্গ।

তবে একথা সত্য যে, ইতোমধ্যেই পদ্মা, মেঘনা ও যমুনায় অনেক পানি গড়িয়েছে। মানুষ এখন সত্য-মিথ্যা উপলব্ধি করতে শিখেছে। তাই রাজাকার ইস্যূকে ফেরি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা আর সম্ভব হচ্ছে না। যার বাস্তব প্রমাণ সদ্য সমাপ্ত ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন। একথা সংশ্লিষ্টদের মনে রাখতে হবে যে, রাজনীতিবিদদের পরিমিতবোধ থাকা দরকার। ‘সাথে থাকলে সঙ্গী; আর না থাকলে জঙ্গী’ এটা কোন রাজনীতির ভাষা নয়।