আজ ৫ আগস্ট বাংলাদেশের জালেম স্বৈরাচারী শাসন ও ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের দিন। এ দিন বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষ শেখ হাসিনার পলায়নের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার নতুন সূর্যোদয় প্রত্যক্ষ করেছে। দীর্ঘ সতের বছরের দুঃশাসন, অত্যাচার, নিপীড়ন, গুম, খুন, অর্থ লোপাট, বিচারের নামে অবিচারের মাধ্যমে মেধাবি ও নিঃস্বার্থ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, আলেম-ওলামা ও দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের দুনিয়া থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া এবং চাঁদাবাজি, অনাচার-ব্যভিচারের যে সংস্কৃতি আওয়ামী লীগ চালু করেছিল তার অবসানের দিন আজ। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান এ দিনটি অপরিহার্য করে তুলেছিল। এ অভ্যুত্থান দমনের সকল প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দিয়ে যারা প্রাণ দিয়ে, বুকে গুলি পেতে নিয়ে এবং পঙ্গুত্ব বরণ করে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিলেন তারা আমাদেরই সন্তান, তরুণ-তরুণী, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী; তাদের সাথী হয়ে সারা দেশের কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাঁতী ও সাধারণ মানুষ ঢাকার গণভবনমুখী যে অপ্রতিরোধ স্রোতধারা সৃষ্টি করেছিলেন দিনের আলোকে সান্ধ্য আইন, পুলিশ, বিজিবি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি, বেয়নেট, হেলিকপ্টারের গুলি তা প্রতিরোধ করতে পারেনি। লাখ লাখ নয়, কোটি কোটি জনতাকে দমনের জন্য সেনাবাহিনীর প্রতি শেখ হাসিনার গুলিবর্ষণের আদেশ সেদিন দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী পালন করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং এরই প্রেক্ষাপটে ফ্যাসিস্ট হাসিনা বাড়াভাত ফেলে রেখে হেলিকপ্টারযোগে ভারতে পালিয়ে যায়। এ অসাধ্য সাধন করে দেশকে মুক্ত করার জন্য আমরা আমাদের সন্তানপ্রতীম সংগ্রামী যুবসমাজকে সালাম জানাই। শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্যের জন্য দোয়া করি। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর প্রতি আমরা আমাদের সমবেদনা জানাই; আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের আপনজনের বিয়োগ ব্যথা সহ্য করার তৌফিক দান করুন।

স্বৈরাচারী জালেম শাসক, শোষক ও জনগণের সম্পত্তি আত্মসাৎকারীরা এ দেশের বিদ্যমান পদ্ধতিরই সৃষ্টি। এ পদ্ধতি পরিবর্তনের দাবি উঠেছে। আওয়াজ উঠেছে নতুন চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজ ও স্বৈরাচার তৈরির জন্য পুরাতনদের উৎখাত করা হয়নি। উৎখাত করা হয়েছে সম্পূর্ণ সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিবর্তন করে সৎ, যোগ্য, ধর্মভীরু ও জনগণের বন্ধুসুলভ ব্যক্তিদের রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ করে দেয়া, যা হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে জুলাই সনদ তৈরি ও তা কার্যকর করার ব্যাপারে ভবিষ্যৎ সরকারের বাধ্যবাধকতার বিষয়টিকে আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার শক্ত দাবিও উঠেছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের অসম্মতির প্রেক্ষাপটে এ সনদটি এখনো আইন কাঠামো নিয়ে সাধারণ্যে প্রকাশিত হয়নি। যারা এর বিরোধী তারা কেন এর বিরোধিতা করছেন, অত্যাচার-অবিচার-দুর্নীতির পথ রুদ্ধ করতে তাদের কেন আপত্তি মানুষ তা যে উপলব্ধি করতে পারছেন না তা নয়, এ দল বা দলসমূহের অভ্যুত্থান-উত্তর আচার-আচারণ ও দেশের বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি, দখলবাজি মানুষকে সজাগ করে দিচ্ছে।

দেশের দুর্যোগ মুহূর্তে হালধরে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হয়ে নোবেল জয়ী ড. ইউনূস বিপাকে পড়েছেন বলে মনে হয়। কিছু কিছু রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতা-নেত্রী এবং বহুদিন ধরে হাসিনা-মোদির উচ্ছিষ্টভোগী সাংবাদিক-গণমাধ্যমকর্মী তার সাফল্যগুলোর পরিবর্তে আপাত ব্যর্থতাগুলোকে বড় করে প্রচার করে এবং প্রকারন্তরে তাৎক্ষণিক নির্বাচন দাবি করে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। আবার কেউ কেউ হাসিনা-আওয়ামী লীগ জুজুর ভয় দেখিয়ে আওয়ামী লীগের শক্তিকে অতিরঞ্জিত করে প্রদর্শন করে দেশে ভয়ভীতি ও ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। হাসিনা কর্তৃক ধ্বংস করা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোসহ দেশের আইন ও বিচার বিভাগ, প্রশাসন এবং শৃঙ্খলা বিভাগে হাসিনা ও আওয়ামী লীগের আপনজনদের এখনো উপস্থিতি এই ত্রাসের অনুকূলে কাজ করছে বলে মনে হয়। আবার ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর ভূমিকা ও তৎপরতা এখনো যে নেই তা বলা যাবে না। এ অবস্থায় আমাদের রক্ষাকবচ একমাত্র জাতীয় ঐক্য। এ ঐক্যের পক্ষে এখন স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির প্রবক্তা হাসিনার কিছু প্রেতাত্মা আমাদেরই ভ্রাতৃসুলভ কিছু দলের নেতাকর্মীদের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে বলে মনে হয়। এ আগাছাগুলোর পরিস্কার প্রয়োজন। এছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানের সময় একটি বড় দলের নেতা যিনি এ আন্দোলনের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছিলেন তাকে এখন আন্দোলনের নেতৃত্বের দাবি করতেও দেখা যাচ্ছে। আবার তিনি এটাও বলছেন যে, এ অভ্যুত্থানের মধ্যে তিনি দক্ষিণপন্থীদের উত্থান দেখতে পারছেন। কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা মুজাহিদুল ইসলামও তো বলেই ফেললেন যে, এর মাধ্যমে মৌলবাদীরা তাদের অবস্থানকে দৃঢ় করেছে; এগুলো কি নেতাদের কথা, না তাদের প্রলাপ!

এখন অন্য প্রসঙ্গে আসি। প্রসঙ্গটি আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমানের প্রসঙ্গ। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ডা. শফিকুর রহমান বাংলাদেশে বহুল আলোচিত একজন জাতীয় নেতা হিসেবে আবির্ভুত হয়েছেন বলে মনে হয়। তিনি যুবসমাজের আইডলেও পরিণত হচ্ছেন। স্বল্প ও মিষ্টভাষী, প্রতিভা ও প্রত্যয়দীপ্ত, প্রখর উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন এ মানুষটিকে শিশু-কিশোরদেরও প্রিয়পাত্রে পরিণত হতে দেখা গেছে। পাড়ায় পাড়ায় ছোট্ট সাত/আট বছরের বাচ্চাদের অনেক জায়গায় আমি দেখেছি ডা. শফিকুর রহমানের মতো মুখে সাদা দাড়ি ও মাথায় টুপি লাগিয়ে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে প্রদত্ত তার ভাষণের শেষাংশ আবৃত্তি করছে।

আমি গতকাল ইমাম গাজ্জালীর নাসিহা আল মুলুক কিতাবটি পড়ছিলাম। তিনি একজন মুসলিম নেতার ১৫টি বৈশিষ্ট্য পুস্তকটিতে উল্লেখ করেছেন। এগুলো হচ্ছেÑ১. তাকওয়া, ২. ন্যায়পরায়নতা এবং পক্ষাপাতহীন আচরণ, ৩. দয়াদ্রতা, ৪. বিনম্রতা, ৫. সততা ও চারিত্রিক সংহতি, ৬. দূরদৃষ্টি ও কৌশলী চিন্তাধারা, ৭. সবাইকে আপন করে নেয়ার ক্ষমতা ও শূরাভিত্তিক সিদ্ধান্ত, ৮. ধৈর্য ও সহনশীলতা, ৯. বিকল্প নেতৃত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে অধীনস্তদের ক্ষমতায়ন, ১০. দয়াদ্র নেতৃত্ব, ১১. নমনীয়তা ও পরিস্থিতির সাথে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা, ১২. ত্বরিৎ যোগাযোগ ও লেনদেনের দক্ষতা, ১৩. আপনি আচার ধর্ম অন্যকে শেখানোর নীতিতে বিশ্বাস, ১৪. অধঃস্তন নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখার যোগ্যতা ও ১৫. ন্যায়বিচারের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার।

উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো স্বল্প পরিসরে আলোচনা ও বিশ্লেষণের অবকাশ এখানে নেই। তবে আমার বিশ্বাস ডা. শফিকের চরিত্রে এর অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যেরই উপস্থিতি লক্ষ্যণীয় যা তাকে দলের ভেতরে-বাইরে দেশের মানুষের কাছে এবং এমন কী বিদেশিদের কাছেও প্রিয় করে তুলেছে। আল্লাহ তাকে হায়াতে তাইয়েবা দান করুন।

গত শনিবার ইউনাইটেড হাসপাতালে আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমানের ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে। দল, পরিবার, সদস্য এবং বন্ধু-বান্ধবদের পরামর্শ উপেক্ষা করে তিনি বিদেশে চিকিৎসা নিতে রাজি হননি। তিনি নিজেই এবং তার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, সবাই চিকিৎসক। তার কথা ছিল, আমি যদি বিদেশে চিকিৎসা নেই তাহলে দেশের মানুষের কাছে কী বার্তা যাবে? তাদের তো সিংহভাগ বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবে না। ইউনাইটেড হাসপাতালের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জাহাঙ্গীর কবির তার সফল অস্ত্রোপচার করেছেন এবং চারটি ব্লক অপসারণ করেছেন। তার এ সিদ্ধান্তটি সারা দেশে বিশেষ করে স্বাস্থ্য অঙ্গনে ব্যাপকভাবে নন্দিত হয়েছে। আমাদের দেশের চিকিৎসকরা গর্ববোধ করেছেন এবং সম্মানিত বোধ করেছেন। বলা বাহুল্য, বিদেশে বিশেষ করে ভারত, সিঙ্গাপুর ও ব্যাংককে চিকিৎসা নেয়া আমাদের দেশের অনেক বরেণ্য ব্যক্তির একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল যা ব্যয়সাধ্য এবং দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা ও চিকিৎসকদের প্রতি অবজ্ঞার সামিল। তিনি তা ভেঙে দিলেন, তার অস্ত্রোপচারের পর জানা গেল যে, আমাদেরই গর্ব ডা. জাহাঙ্গীর কবির এ যাবত এ ধরনের আঠারো হাজার অস্ত্রোপচার করেছেন। পক্ষান্তরে ভারতের দেবী শেঠি করেছেন ১৫ হাজার অস্ত্রোপচার। অথচ দেবী শেঠি সকলের মুখে মুখে কিন্তু ডা. জাহাঙ্গীর কবিরকে আমার কেউ চিনতাম না। এর অবসান হওয়া দরকার।