নূরুন্নাহার নীরু

বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে জুলাই বিপ্লব একটি অনন্য সাধারণ “নব চেতনার” দিগন্ত উন্মোচন করেছে। যাকে শুধু একটি বিপ্লবই নয় বরং পুনর্জাগরণও বলা চলে। এ জাগরণ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, এ জাগরণ ফ্যাসীবাদকে ধূলিস্যাৎ করতে। আর এটি কি একদিনে বা এক পর্বেই সম্পন্ন?

এ বিপ্লবকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। যেমন, ২৪ জুলাই, ৩৬ জুলাই, জুলাই গণঅভ্যুত্থান বা গণআন্দোলন। কেউ কেউ বলতে চায় বর্ষা বিপ্লব ! তবে যা ই বলা হোক না কেন এর মূল তাৎপর্য একটাই। আর তা হলো “২৪ শের জুলাই একটি বিস্ফোরণ, একটি নব জাগরণ, একটি নতুন সংস্করণ।” এর মূল শক্তি ছিল ‘জেন-জি’ নামে খ্যাত একবিংশ শতাব্দীর ছাত্রছাত্রীরা। যাদের একটা বদনাম ছিলঃ “মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকা।” এদের দ্বারাই সংগঠিত এ বিপ্লব প্রথমে ঢাবি থেকে শুরু হয়ে রাজশাহী, চট্রগ্রাম, জাহাঙ্গীর নগর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হলেও তৎকালীন সরকারের হটকারী ও অনমনীয় কার্যকলাপে পরবর্তীতে স্কুল, মাদরাসাসহ বিশেষভাবে প্রাইভেট ভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরাও ঝাঁপিয়ে পড়ে এ আন্দোলনে। এটি ছিল মূলত একটি দ্রোহ। দীর্ঘদিনের পূঞ্জীভূত ক্ষোভ।

জনগণের দ্রোহের বিস্ফোরণ বিভিন্ন কারণে ঘটতে পারে যেমন : রাজনৈতিক নিপীড়ন, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক অবিচার, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি, গণতান্ত্রিক ও ভোটাধিকারের অভাব,সাংস্কৃতিক ও জাগতিক বৈষম্য, সংবাদপত্রসহ সব ধরণের মিডিয়ার কন্ঠ রোধ ও জনগণের নিরাপত্তার অভাব। শেখ হাসিনার সাড়ে ষোল বছরের শাসনামলে এ সবগুলো কারণ, সবগুলো বৈষম্যই নিহিত ছিল। এর প্রধান কারণ ছিল এর কিছু মনস্তাত্বিক দিক। যেমন :

শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় এসেই শুরু করেন দমন-পীড়নের রাজনীতি। তিনি ঘোষণা দেন পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তিনি এসেছেন। দেশ গড়ার কাজের চেয়েও তার লক্ষ্য ছিল সেই প্রতিশোধস্পৃহা। সে সাথে স্বীয় ক্ষমতা ও গদীকে মজবুত এবং দীর্ঘস্থায়ী করা। এজন্য তিনি সব সময় মিথ্যা বলা, মিথ্যা রটনার কাজটি দক্ষ অভিনেত্রীর মত করে গেছেন। জাতিকে বিভক্ত করে রাখতে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি, সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু, রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা, জঙ্গী ইত্যাদি তকমা লাগিয়ে রেখেছিলেন চরমভাবে। এমনকি ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে ভারতের কাছে নতজানু হয়ে থাকতেও দ্বিধা ছিলনা তাঁর। যা একটি স্বাধীন দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্নতায় পর্যবসিত হতে চলছিল। দলীয় বাহিনীর নামে অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দানে যুব সমাজকে মেরুদন্ডহীন করে গড়ে তুলছিলেন অনবরত। এমন কি তার পিওন থেকে রাষ্ট্রের কর্ণধাররা পর্যন্ত শুধু টাকার পাহাড় গড়েছে, দেউলিয়া করেছে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে। করাপশন বা অপরাধপ্রবনতা ছড়িয়ে পড়েছিল সাধারণ ঠিকাদার থেকে সেনাবাহিনী পর্যন্ত। ওদিকে গড়ে উঠছিল “আয়না ঘর” নামে লোমহর্ষক নির্যাতন সেল। পিতৃহারা, স্বজনহারা কোন নারী এত নৃশংস হতে পারে তা জাতির অজানা ছিল। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনায় চোখ খুলে যায় এজাতির যদিও মুখটি ছিল বন্ধ স্বৈরভীতির ভয়ে।

২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারীর শেষের দিকে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে চৌকস সেনাদের হত্যার মধ্যে দিয়েই শুরু হয় তার রক্তের হোলি খেলা। এরপর ২০১৩ সালে ৫ মে ঘটে হৃদয় বিদারক কারবালাসম শাপলা চত্বর ঘটনা। এখানে নৃশংস ভাবে হত্যা করে লাশ গুম করা হয় হেফাজতের কর্মীদেরকে। ক্ষমতাকে রিনিউ করতে ২০১৪, ১৮, ২৪শে চলে নির্বাচনের নামে প্রহসন, চলে জাতির সাথে তামাশা। অপরদিকে বিরোধীদলের ভূমিকায় বসিয়ে রেখেছিল পৌষ্যভাঁড় “জাতীয় পার্টিকে।” সংসদকে বানিয়েছিল নায়িকা, গায়িকা, খেলোয়াড়, প্রমোদবালা, ইয়াবা ব্যবসায়ী, ভূমি দস্যুদেরে নিয়ে একটি রঙ্গশালা। আমলা, মন্ত্রীদের কদর ছিল তার চাটুকারিতা আর দালালীতে স্তুতি গাওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠায়। সাংবাদিক সহ মিডিয়া ব্যক্তিত্বরা হয়ে পড়েছিল পদলেহী চাটুকার। এর আগে তথাকথিত সোনার ছেলেরা ২০০৬ সালের অক্টোবরে লগিবৈঠার যে তান্ডব দেখিয়েছিল তা জাতির হৃদয় থেকে মুছে যেতে পারেনি। আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের নামে বিএনপি-জামায়াতের প্রথম সারির নেতাদের ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানো, নৃশংসভাবে হত্যা, গুম, খুন জাতি ভুলে যেতে পারেনি।

দিন দিন তাঁর স্বৈরাচারিতা একনায়কতন্ত্রে পরিণত হতে চলেছিল , ঠিক তাঁর পিতা শেখ মুজীবুর রহমানের বাকশাল কায়েমের মত। দেশ ও জাতির যে কোন বিষয়ে তা যত তুচ্ছই হোক সেখানেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা কর্তৃপক্ষের আগে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীই সব উত্তর দিয়ে দিতেন, যেন তিনিই ছিলেন সব সমস্যার সমাধান কারী। কিন্তু তাঁর এসব প্রগলভবতা জাতির কাছে বালখিল্যতার পরিচায়ক ছিল। একজন দেশ প্রধান মানে দেশমাতা-কিন্তু তিনি তা ধরে রাখতে পারেন নি তার পক্ষপাত দুষ্টতায়। এমনকি নিজ দলের ভেতরেও যখন খুনাখুনি, রাহাজানি চরম পর্যায়ে যেত তখনো না কি তিনি বলতেন, “যে গিয়ে যে থাকে সে ই আমার। “এতটাই দানবী চরিত্র ছিল তার যা পরবর্তীতে ভেতরে ভেতরে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলার প্রয়াশ পায়।

২০১৮ সালে প্রথম কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে যদিও তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি স্বৈরচারী দমন-পীড়নে। এমনকি কোটারও কোন সংস্কার হয়নি এবং অগ্রাধিকারও ঘটেনি মেধাবীদের। এরই মধ্যে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা ছিল জাতির জন্য খুবই মর্মান্তিক ও হতাশা ব্যঞ্জন। নিছক ভারতকে কটাক্ষ করে স্ট্যাটাস দেয়াই ছিল তার অপরাধ। দলীয় পান্ডাদেরে লেলিয়ে দিয়ে খুন করা হয় তরতাজা দেশপ্রেমী ছাত্রটিকে। অথচ ভোট প্রদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল ঐ ছাত্রসমাজই। জন্ম থেকে তারা শুধু দেখেছে শোষণ-নিপীড়ন-নির্যাতন-ভোটাধিকার হরণ। নীরব সহ্যক্ষমতা তখন থেকেই হ্রাস পেতে থাকে ছাত্র-জনতার। উপরুন্তু গুম হওয়া স্বামী সন্তানদের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া “মায়ের ডাক” এর ভূমিকাও ছিল দ্রোহের বিষ্ফোরণের আরেকটা অন্যতম মনস্তত্ব। প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক নিপীড়ন, গুম, হত্যা, ক্রসফায়ার, বিরোধীদলকে দাবানো, মিথ্যা অপবাদ দিয়ে দিয়ে অহেতুক হয়রানি, স্বাধীনভাবে চলতে না পারা, বলতে না পারা, জেলজুলুম, বাড়িঘর ছাড়ানো, স্বজন হারানো সর্বোপরি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রনে নিয়ে অহেতুক অপরাধী সনাক্তকরণ, দমন-পীড়ন এবং দলীয় পোষ্য বাহিনী দ্বারা সবধরনের অপরাধের সুযোগ করে দেয়াসহ মারো-কাটোর রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করাই ছিল মূলত স্বৈরহাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই বিপ্লবের মূল মনস্তাত্বিক কারণ।

মুখ খুলতে না পারা, ভিতরে ভিতরে ফুঁসে ওঠা জনগণ ২০২৪শের জুলাই থেকে শুরু হওয়া ছাত্রদের কোটা বিরোধী আন্দোলন তথা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলননের প্রতিটা পর্যায় ঠিক ঠিক দৃষ্টি সীমায় রাখছিল। যেমন সড়ক-মহাসড়ক-ট্রেনপথ অবরোধ, বাংলা ব্লকেড, রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারক প্রদান, শেখহাসিনার ব্যাঙ্গোক্তি, ছাত্রদের স্লোগান, গ্রাফিতি, দেয়াল লিখন, মার্চ ফর জাস্টিস অবশেষে মার্চফর ঢাকা সবই ছিল জনগণের কাছে পরিস্কার দৃশ্যপট। এমনকি, মোবাইল ও কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকা সেই জেন-জির তৎক্ষণাৎ প্রযুক্তির যথোপযুক্ত ব্যবহার, সময়োপযোগী দিক নির্দেশনা ও সুসংগঠিত আন্দোলন পরিচালনার নিত্যনতুন কারিশমা কোনটিই জাতির দৃষ্টিগোচরহীন ছিল না বরং ধাপে ধাপে, পর্বে পর্বে জাতিকে উজ্জীবিত করেছে। ফলে একসময় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনতা জেন-জির সাথে একাত্ম হয়ে গিয়ে রাজপথে নেমে যেতে বাধ্য হয়ে পড়েছিল। আর তখন এটি হয়ে পড়ে অস্তিত্বের লড়াই, হয়ে পড়েছিল ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াই, চরম হিংস্রতা থেকে জাতিকে বাঁচানোর লড়াই। তাইতো দেখা গেছে দল-মত-জাতি-বর্ন-ধর্ম-লিঙ্গ-ছোট-বড় কেউই বাদ পড়েনি এ আন্দোলন থেকে। পরিশেষে জনগণের তোপের মুখে পালাতে বাধ্য হয় আত্মঅহংকারী, দাম্ভিক, গোঁয়ার স্বৈররানী। স্বনামধন্য কবি আসাদ বিন হাফিজের ভাষায় বলতে হয়” হারিয়ে গেল স্বৈরাচারের ঐরাবত। একবিংশ শতাব্দীর দুঃস্বপ্ন প্রাচীন হিন্দার তুলতুলে মখমলের ঝলমলে সিংহাসন।”

২০২৪ শের ১ জুলাই থেকে ৫ অগাস্ট পর্যন্ত এদেশের উপর দিয়ে কী বয়ে গেছে, কত প্রাণ ঝরেছে, কত জীবন এখনো মরণের প্রহর গুনছে, ফ্যাসীবাদ কিভাবে বিতাড়িত হয়েছে এসবই গোটা দেশবাসীর গোচরে আছে। কিন্তু জাতির দৃষ্টি এখন আগামীর প্রত্যাশার দিকে। জাতি চায়; “থেমে গেলে চলবে না, মুখ থুবড়েও পড়া যাবে না। যে আগল ভাঙ্গা হয়েছে তাকে আবার শক্ত করে নতুন ইটে গাঁথুনী দিতে হবে। দেশ গড়ার কাজে আবারো হতে হবে সীসাঢালা প্রাচীর।” এজন্য সবার আগে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে আসতে হবে দায়িত্বশীল ভূমিকায়। গড়তে হবে দলীয় শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা। বিশেষ করে জুলাই বিপ্লবের প্রথম সারির যোদ্ধারা যে রাজনৈতিক দল গঠন করেছে জাতি তারদিকে আশার আলো নিয়ে তাকিয়ে আছে। তারা ক্ষমতায় আসতে পারুক বা না পারুক জাতি তাদের প্রতি আশাবাদী। তাই তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ হতে হবে আস্থাযোগ্য, আশ্বাসপূর্ণ। তাদের যে কোন ভুলের কারণে স্বৈরাচার পতনের এ কৃতিত্ব যেন ম্লান হয়ে না যায়। জাতিকে যেন হতাশায় পড়তে না হয় তাদের সামান্যতম বিচ্যুতিতেও। এজন্য আজ তাদের প্রথম প্রয়োজন সব ধরনের অন্যায় অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকার কঠোর অঙ্গীকার। চাই নৈতিকতা রক্ষার অকৃত্রিম চর্চা। সত্যিকার অর্থেই যে কোন দূর্জয় দমনে জাতির পাশে থাকার নির্মোহ ব্যত্যয়। পাশাপাশি দেশের সব রাজনৈতিক দলগুলোতে আনতে হবে সৌহর্দ্যপূর্ণ ঐক্য, শ্রদ্ধা , শ্লীলতা। তাদেরে মনে করতে হবে; “ক্ষমতা পাওয়ার লোভে নয় বরং ক্ষমতাকে ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবেই সংসদে যেতে হবে। তাই যে কোন ফলাফলের বা জনগণের রায়কে গ্রহণ করার মত দৃঢ় মনোবল।

যাদের ভেতর এখনো ফ্যাসীবাদী চরিত্রের ছিঁটেফোঁটা দৃশ্যত হচ্ছে, তাদেরও সতর্ক হয়ে যেতে হবে—জাতির প্রত্যাশা সেটিই। এদেশের বুকে ফ্যাসীবাদের স্থান নেই, স্বীকৃতি নেই কোন স্বৈরাচারের। জুলাই বিপ্লব এনে দিয়েছে সেই সম্ভাবনা সেটি কোন ভাবেই ভুলে গেলে চলবে না। মনে রাখতে হবে ১৯৪৭ যেমন একটি স্বাধীনতা, ৭১ তেমনি একটি স্বাধীনতা, ৩৬ জুলাই তেমনি আরো একটি স্বাধীনতা। যুগে যুগে তা ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধেই ঘটে এসেছে। প্রচুর রক্তক্ষরিত এ স্বাধীনতা ধরে রাখার দায়িত্ব আবারো সেই দলমত নির্বিশেষে সকল দেশপ্রেমিকের। এবারের বছর পূর্তিতে ২৪শের বিপ্লব প্রত্যক্ষকারীরা এ প্রত্যাশা ই রাখছে আগামীর দেশ নায়কদের সামনে।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।