গত ৩ নভেম্বর খ্যাতনামা গবেষক, লেখক ও বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ আমলা ড. কামাল সিদ্দিকী গুলশানে তার নিজ বাসভবনে ইন্তিকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। জীবনের শেষ দিনগুলো তিনি নীরবে-নিভৃতে কাটিয়েছেন। বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীদের সাথে তার যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। অত্যন্ত বন্ধুবৎসল কামাল সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার তিন বছরের সিনিয়র ছিলেন এবং ১৯৬৫ সালে কৃতিত্বের সাথে অর্থনীতিতে স্মাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের সেন্ট্রাল সুপেরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সিএসপি অফিসার হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে তিনি তৎকালীন নড়াইল মহকুমার প্রশাসক ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি খুলনার জেলা প্রশাসক হিসেবে সরকারি চাকরিতে পুনরায় যোগদান করেন এবং সর্বশেষ ২০০৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হিসেবে অবসর নেন। এক/এগারোর সরকারের আমলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাথে ড. কামাল সিদ্দিকীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির বানোয়াট মামলা রুজু করা হয়। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি দেশত্যাগ করে অস্ট্রেলিয়া, ফিজি, জার্মানি ও ইংল্যান্ডের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও গবেষণার সাথে যুক্ত হন। তিনি এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফ্লোরা অ্যান্ড ফাউনা অব বাংলাদেশের প্রধান সম্পাদক ছিলেন, যার প্রথম খণ্ড ২০০৮ সালে ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ প্রকাশ করেছিল। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব এবং ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে (ম্যানিলায়) বাংলাদেশের বিকল্প পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন শেখ হাসিনার চক্ষুশূল।
তিনি ক্ষমতায় আসার পর তাকে এডিবি থেকে প্রত্যাহার করা হয়। একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি দেশপ্রেমে উজ্জীবিত ছিলেন এবং আওয়ামী লীগের ভারত তোষণ নীতি ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের চরম বিরোধী ছিলেন।
১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে ফিলিপাইনের লস বেনস্থ ফিলিপাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ অব ইকোনমিক্স ও আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে তিন মাসব্যাপী একটি কর্মসূচিতে আমি অংশগ্রহণ করি। ঘটনাক্রমে এ কর্মসূচির উদ্যোক্তা ছিলেন এডিবির দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের Poverty Alleviation খাতের প্রধান ড. নির্মল ফারনান্ডো। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমি, আমার দুই সহকর্মী শাহীদুল আজম ও শাহজাহানকে ড. কামাল সিদ্দিকী এডিবি সদর দপ্তরে দাওয়াত করেন। তার আতিথেয়তা এখনো আমি ভুলতে পারি না। বাংলাদেশে তখন আওয়ামী লীগের তাণ্ডব চলছিল। তাদের হরতাল, অবরোধ, অগ্নিসংযোগ ও বিএনপির নেতৃত্¦াধীন সরকারবিরোধী আন্দোলন এতই তুঙ্গে উঠেছিল যে, মানুষের জানমাল ও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে উঠেছিল। প্রতি রোববার তখন বিশ্ববিদ্যালয় ও এডিবি দপ্তরের সাপ্তাহিক ছুটি ছিল। এ সুযোগে ছুটির দিনগুলোতে ড. সিদ্দিকীর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে আমরা এডিবির সাউথ প্লাজায় অফিসার্স ক্যান্টিনের প্রশস্ত লবিতে আড্ডা জমাতাম। এ আড্ডায় তার চোখে-মুখে বাংলাদেশের রাজনৈতিক শিষ্টাচারের ক্রমবর্ধমান অবনতি ও একটি দল কর্তৃক ভারতীয় আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদকে উৎসাহ প্রদান এবং ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে তা ব্যবহারের প্রবণতায় উদ্বেগের লক্ষণ প্রত্যক্ষ করেছি। শেখ হাসিনা সম্পর্কে তার ধারণা ছিল অত্যন্ত কঠোর। তার ক্ষমতালিপ্সা, অর্থের প্রতি মোহ এবং প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল ও নেতানেত্রীদের অবজ্ঞা উপেক্ষা, অপমান এবং দুনিয়া থেকে নিঃশেষ করে দেওয়ার আকাক্সক্ষাকে তিনি জঘন্য বলে গণ্য করতেন।
তিনি এ গল্প বলতে গিয়ে একটি ঘটনা উল্লেখ করেছিলেন। শেখ হাসিনা তার মেয়ের বিয়েতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দাওয়াত দিয়েছিলেন এবং ঐ বিয়েতে ড. কামালও উপস্থিত ছিলেন। খালেদা তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া ছাড়াও ঐ সময়ে দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে তিনি যথারীতি বিয়েতে হাজির হয়েছিলেন; কিন্তু খালেদা জিয়াকে তিনি অভ্যর্থনা জানাননি। তার পক্ষ থেকে অথবা তার স্বামীও এ কাজটি করেননি। তিনি দুঃখ করে বলেনÑ সায়মা, তথা তার কন্যার পিতা ও তার স্বামী ড. ওয়াজেদ এ বিয়েতে অনাহূত ছিলেন। তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছিল অহিনকুল সম্পর্ক। কোনো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান অথবা রাষ্ট্রীয় সফরে তাকে সঙ্গী হিসেবে স্বামীকে নিতে দেখা যায়নি। তার আক্ষেপ ছিল, ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে যে মুসলিম মহিলা রাজনীতিবিদ নিকৃষ্ট আচরণের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন তিনি আমাদের নেতা হওয়ার অযোগ্য।
এডিবির বিকল্প পরিচালক থাকাকালেও তিনি ব্যাংকটির অর্থায়নে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্প পল্লী জীবিকায়ন প্রকল্প (Rural Livelihood Project) বাংলাদেশকে দিয়েছিলেন, এর আগে এডিবি ব্যুরো টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচিতে তহবিল প্রদান করতেন।
বাংলাদেশের ভূমি সংস্কারের উপর লিখিত একাধিক গবেষণাগ্রন্থ তার অনবদ্য কৃতিত্ব হয়ে থাকবে। সমাজ বিবর্তন ও সামাজিক পরিবর্তনের উপর তার সম্পাদিত গবেষণা কর্মগুলোর পর এই দেশের আর কোনো আমলা-অর্থনীতিবিদ এ ধরনের কাজে হাত দেননি। আমাদের তরুণসমাজ তার জীবন থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে।
ড. কামাল সিদ্দিকীর সাথে একই সময় ম্যানিলায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন মেজর (অব.) খায়রুজ্জামান। তিনি ছিলেন অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ও দক্ষ কূটনীতিক। তার কাছ থেকে ম্যানিলায় যে আতিথেয়তা ও সহযোগিতা পেয়েছি তা ভোলার নয়। আমরা ফিলিপাইন থেকে ফেরার পথে হংকং সফরের ইরাদা করেছিলাম। বলা বাহুল্য, ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই থেকে হংকংয়ের কর্তৃত্ব ব্রিটেনের হাত থেকে চীনের উপর ন্যস্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আমাদের কাছে হংকংয়ের ভিসা ছিল না। মেজর খায়রুজ্জামানকে বললেই তিনি সরকারি অফিসার হিসেবে কূটনৈতিক কোটায় আমাদের হংকং সফরের ব্যবস্থা করেছিলেন। তখন চীনে নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। জনাব জামান তাৎক্ষণিকভাবে তাকে টেলিফোন করে আমাদের তিনজনকে (আমি, জনাব শাহীদুল আজম ও শাহজাহান) হংকং বিমানবন্দরে ক্যাথে পেসিফিক বিমান থেকে গ্রহণ করে হংকং নগরীতে আবাসন, ভিক্টোরিয়া হার্ভার ও দর্শনীয় স্থানসমূহ পরিভ্রমণের ব্যবস্থা করার জন্য দূতাবাসের একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব প্রদান করার অনুরোধ করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রদূত মুস্তাফিজুর রহমান দূতাবাসের মিনিস্টার পর্যায়ের একজন কর্মকর্তাকে আমাদের খেদমতের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনসমূহে যে সমস্ত রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার বা চার্জ দি এফেয়ার্স কাজ করেন তাদের অনেককেই আমি জানি, যারা রাষ্ট্রীয় অর্থে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। খায়রুজ্জামান ছিলেন এর ব্যতিক্রম। মেজর খায়রুজ্জামানকে জেলহত্যা মামলায় আসামী করা হয়। ১৯৯৬ সালের জুনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জিন্দা করা হয় এ মামলা। খায়রুজ্জামানকে দেশে তলব করা হয়। তিনি সরকারি নির্দেশ অমান্য করে মালয়েশিয়া চলে যান এবং সেখানে দ্বিতীয় আবাস (Second Home) গড়ে তোলেন। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে মালয়েশিয়ান সরকার তাকে গ্রেপ্তার করেন; কিন্তু মালয়েশিয়ান আদালত তাকে মুক্ত করে দেন। ব্রিটিশ সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক চৌধুরী মুঈনুদ্দিনের অনুকূলে প্রদত্ত চাঞ্চল্যকর রায়ের ন্যায় এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা ছিল, যা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী আমলের বিচার ব্যবস্থার অন্তঃসারশূন্যতাকে প্রমাণ করে।