বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডিন্ট অজয় বাঙ্গা বিশ্বব্যাপী কর্মসংস্থানের অবস্থা দৃষ্টে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, আগামীতে বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করাটাই হবে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য এ চ্যালেঞ্জ হবে খুবই কঠিন। আফ্রিকার দেশগুলো কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। তিনি বলেছেন, উন্নয়নের মূল লক্ষ্যই এখন নতুন নতুন এবং উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। চাকরি এখন শুধু অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার মাত্র নয় বরং এটি এখন মর্যাদা সৃষ্টি, স্থিতিশীলতা এবং আশার প্রতীকও বটে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এর বার্ষিক সাধারণ সভায় বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট এই মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন,আগামী ১০ বছরে প্রতি সেকেন্ডে বিশ্বব্যাপী প্রতি সেকেন্ডে ৪ জন করে চাকরির বাজারে প্রবেশ করবে। কিন্তু এদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা না গেলে অস্থিরতা বৃদ্ধি এবং অভিবাসন অস্বাভাবিক মাত্রায় বাড়তে পারে। কাজেই আগামীতে বিশ্বব্যাংকের মূল ফোকাস হবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা।

উল্লেখ্য, নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারলে তা যে শুধু সংশ্লিষ্ট দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উপর প্রভাব ফেলবে তা নয় উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি এবং সামাজিক ব্যবস্থার উপরও প্রভাব ফেলবে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, আমরা যাদের উন্নয়নশীল দেশ বলে জানি ২০৫০ সাল নাগাদ সেসব দেশে বিশ্ব জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশ বাস করবে। আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে ১২০ কোটি তরুণ এসব দেশের শ্রমবাজারে প্রবেশ করবে। কিন্তু এসব দেশ মাত্র ৪০ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারবে। ফলে কর্মোপযোগী; কিন্তু কাজ পাচ্ছে না এমন মানুষের সংখ্যা হবে ৮০ কোটি। সে পরিস্থিতিতে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, আমরা বক্তব্য চলাকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার কর্মসন্ধানি তরুণ-তরুনী চাকারির বাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু তারা প্রত্যাশিত মাত্রায় চাকরি পাচ্ছে না। এমনকি সাধারণ মানুষের একটি চাকরি যোগার করাও তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িছে। আগামীতে আফ্রিকার দেশগুলোতে কর্মসংস্থানের সঙ্কট সবচেয়ে প্রকট আকার ধারন করবে।

বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট যে বক্তব্য প্রদান করেছেন তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। কোন পরিবারে যদি এক বা একাধিক সদস্য কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে সে পরিবারের আর্থিক অবস্থা উন্নয়নের সম্ভাবনা সংকুচিত হয়ে পড়ে। কর্মক্ষম মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় শাস্তি হলো তাকে কর্মহীনভাবে বসিয়ে রাখা। পরিণত বয়সে প্রতিটি মানুষই কাজ করতে চায়। কেউ পরিবারের বোঝা হয়ে থাকতে চান না। কিন্তু চাইলেই তো আর চাকরি বা কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যায় না। এ জন্য কর্মসংস্থানের মতো অনুকূল অবস্থা থাকতে হয়। কর্মহীন মানুষ সমাজ-সংসারে প্রতিনিয়তই অবহেলিত হয়ে থাকেন। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন। কোন দেশই দারিদ্র্যাবস্থা নিয়ে টিতে থাকতে চায় না। কিন্তু চাইলেই দারিদ্রাবস্থা থেকে মুক্তি মেলে না। এখানে অবশ্য দারিদ্র্য বিমোচন টার্ম নিয়ে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ রয়েছে। মানুষের দারিদ্র্যাবস্থা আল্লাহ্র সৃষ্টি। যদি পৃথিবীর সব মানুষ বিত্তবান হয়ে যেতো তাহলে কাজ করানোর মতো কর্মী পাওয়া যেত না। আবার সব মানুষ যদি বিত্তহীন-দরিদ্র হতো তাহলে কাউকে কাজ দেয়ার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া যেতো না। পৃথিবীর মানবসমাজের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টির জন্যই বিত্তবান-বিত্তহীনের সৃষ্টি করা হয়েছে। কাজেই দারিদ্র্য বিমোচন করতে চাওয়া প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজ। তবে আমরা যদি বিত্তবান-বিত্তহীন নির্বিশেষে সবার জন্য ন্যায় সঙ্গত অধিকার নিশ্চিত করতে পারি তাহলে সমাজে এত অনাচার-অবিচার থাকতো না। তাই প্রতিটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে তার নাগরিকদের জন্য ন্যায্যতার ভিত্তিতে আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নের সুফল ভোগের ব্যবস্থা করা। কোন নাগরিকই প্রত্যাশা করে না যে সরকার প্রতিদিন তাদের বাড়িতে বিনামূল্যে খাবার পৌঁছে দেবে। কিন্তু ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে খাবার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে পারার নিশ্চয়তা তারা অবশ্যই চাইতে পারে।

বলা হয়, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ভোক্তা হচ্ছেন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারি। কিন্তু এ কথাটি মোটেও সত্যি নয়। আমাদের মতো দেশে ভোক্তা সাধারণত কোন পণ্যের মূল্যের উপর কোন চাপ সৃষ্টি করতে পারে না। বরং তারা বাধ্য হন বিক্রেতার চাহিদা মতো পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতে। বিগত সাড়ে তিন বছরেও বেশি সময় ধরে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষ, নির্দিষ্ট আয়ের ভোক্তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। কোনোভাবেই উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। একদিকে বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক উচ্চস্তরে অবস্থান করছে। অন্যদিকে কর্মজীবী মানুষের মজুরি বৃদ্ধির হার তুলনামূলকভাবে বাড়ছে না। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি যদি ৯ শতাংশ বাড়ে তাহলে দেখা যায় মজুরি বৃদ্ধি হার হচ্ছে ৬ শতাংশ। ফলে সাধারণ নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ উচ্চ মূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে পড়ছে। সমাজে যারা বিত্তবান হিসেবে পরিচিত তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই অর্থ-বিত্ত বৃদ্ধির জন্য নানা অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি কোন নিয়ম বা সূত্র মেনে চলে না। বাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণ পণ্যের উপস্থিতি থাকলেও ভোক্তা সেই পণ্যের নাগালে যেতে পারছে না।

যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন তাদের অধিকাংশই ঠিক মতো উপযুক্ততা অনুযায়ী, বেতন-ভাতা পান না। ফলে আর্থিক দুরবস্থা করছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো তাদের প্রতিবেদন উল্লেখ করেছে, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখের মতো। এটা সম্ভবত কোন পাগলেও বিশ্বাস করবে না যে দেশে মাত্র ২৭ লাখ মানুষ কর্মহীন বেকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো উন্নত দেশগুলোর সূত্র অনুসরণ করে বেকারের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। একজন মানুষ যদি অর্থের বিনিময়ে সপ্তাহে এক ঘন্টারও কাজ করতে না পারেন তাহলে তাকে বেকার হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বেকারের সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে উন্নত দেশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেছে কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে বেকারদের কি কি সুবিধা প্রদান করা হয় তা তারা উল্লেখ বা অনুসরণ করছে না। অর্থনীতির পরিভাষায় কেউ যদি তার সঠিক যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ না পান, কেউ যদি যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন-ভাতা না পান অথবা মাঝে মাঝে বেকার থাকেন তাদেরও বেকার বলা হয়।

বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট আগামীতে বিশ্বব্যাপী বেকার সমস্যা কতটা ভয়াবহ রূপ ধারন করতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কর্তৃপক্ষ কি সে ব্যাপারে সচেতন আছেন? বাংলাদেশ গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। কিন্তু সরকার বিষয়টি জানে বলেই মনে হয় না। একটি দেশের মোট জনসংখ্যান দুই-তৃতীয়াংশ বা তারও বেশির বয়স যখন ১৫ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে হয় তখন সে অবস্থাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। একটি জাতির জীবনে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থা একবারই আসে। কারো কারো মতে, হাজার বছরে একবার এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। যেসব দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুযোগ কাজে লাগাতে পারে তারাই বিশ্ব অর্থনীতিতে উন্নতির শিখরে পৌঁছতে পারে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার সুফল কাজে লাগাতে হলে জাতিকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হয়। কারণ শিক্ষা ব্যতিত কোন মানুষের ভিতরে লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনাকে জাগ্রত করা যায় না। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বর্তমানে বেহাল দশা চলছে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। গুণগত মানের চেয়ে পাশের হার বৃ্িদ্ধর উপরই জোর দেয়া হচ্ছে। একজন শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা অর্জনের পরও সংশ্লিষ্ট কাজ করার মতো দক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থা কর্মক্ষম বা কর্মমুখী জনশক্তি তৈরি করতে পারছে না। এ ব্যবস্থা আত্মঅহমিকাপূর্ণ বেকার তৈরি করছে মাত্র। আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটনানো দরকার। শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমিক স্তর থেকেই কারিগরি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। একজন শিক্ষার্থী যদি কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারে তাহলে তাকে চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে হবে না। তিনি নিজেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবেন। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় একজন উচ্চ শিক্ষিত ছাত্র বা ছাত্রী সাধারণ মানের কোন কাজ করতে চাইবেন না। কিন্তু সে যদি কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হতো তাহলে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সেখানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারতেন।

ব্যাপক মাত্রায় কর্মসংস্থানের জন্য ব্যক্তি খাতে প্রোডাক্টিভ সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। কিন্তু অনেক দিন ধরেই ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপি’র ২২/২৩ শতাংশে ওঠানামা করছে। ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয় শিল্প স্থাপনের জন্য। সে ঋণ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে দেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে। বাংলাদেশে যারা প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তা তাদের অনেকের মধ্যেই একটি প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা যায় তাহলো আত্ম কেন্দ্রিকতা। তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠানের অর্জিত আর্থিক সুবিধা কারো সঙ্গে শেয়ার করতে চান না। যেমন কেউ একটি শিল্প-কারখানা স্থাপন করলে উৎপাদন কর্মের সবকিছুই তাদের প্রতিষ্ঠানেই করতে চান। অথচ তিনি যদি বাইরের প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু কাজ করিয়ে আনতেন তাহলে আরো কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠার সুযোগ পেতো। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি যখন জাপানে বাংলাদেশ দূতাবাসে বাণিজ্য সচিব ছিলেন তখন একদিন তাদেরকে টয়োটা গাড়ির কারখানা পরিদর্শনে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি কারখানার ভিতরের অবস্থা দেখে বিস্মিত হন। কারণ সেখানে কোন যন্ত্রপাতি তৈরি করা হচ্ছে না। প্রয়োজনীয় সব যন্ত্রপাতি বাইরে থেকে চুক্তিভিত্তিক করিয়ে আনা হচ্ছে। কোম্পানি সুনির্দিষ্ট স্পেসিফিকেশন দিয়ে দেয় আর সাব কন্ট্রাটিং কোম্পানিগুলো তাদের কারখানায় যন্ত্রপাতি তৈরি করে সরবরাহ করে। এত টয়োটা কোম্পানির পাশাপাশি আরো কিছু ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান বিকশিত হবার সুযোগ পাচ্ছে। আমাদের দেশেও এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। শিল্পায়ন বলি বা অন্য যে কোন কাজই বলি না কেন তা যদি সমন্বিত উদ্যোগে সম্পাদিত হয় সেটাই সবচেয়ে ভালো ফল দিতে পারে।

আগামীতে আমরা যদি কাক্সিক্ষত মাত্রায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন এবং বেকার সমস্যা সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে চাই তাহলে এখনই পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার।