একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ‘বাংলাদেশি কূটনীতিকের বিজেপি বয়ান’। শিরোনামটি অনেকের মতো আমারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ১৯ মে মুদ্রিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনে ঐতিহ্যগতভাবে চলে আসা কুরবানি দেওয়ার প্রথা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন নবনিযুক্ত ডেপুটি হাইকমিশনার শাবাব বিন আহমেদ। কলকাতায় মিশনে যোগদানের আগেই কুরবানি বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছেন এ ডেপুটি হাইকমিশনার। ভারতের আস্থা অর্জনের জন্যই নাকি তিনি কলকাতা মিশনে কুরবানি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। ফলে প্রশ্ন জাগে, আস্থা অর্জনের ব্যাপারে ভারত সরকার কি তাকে কুরবানি বন্ধের কোনো পরামর্শ দিয়েছে? যদি ভারত এমন পরামর্শ দিয়ে না থাকে, তাহলে তো উদ্যোগটা একান্তভাবেই তার নিজের। এমন উদ্যোগ তো কোনো আত্মসম্মান সম্পন্ন সুস্থ মস্তিষ্কের কূটনীতিকের হতে পারে না। ভিন্ন দেশে একজন কূটনীতিকের অন্যতম দায়িত্ব হলো নিজ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরা। শাবাব বিন আহমেদ কি এ বিষয়ে অবহিত নন? তাহলে কার্যক্ষেত্রে যোগদানের আগেই তিনি কুরবানির মতো একটি মহৎ ও ঐতিহ্যিক বিষকে বন্ধের নির্দেশ দেন কেমন করে? একজন মুসলিম হিসেবে কুরবানির ধর্মীয় গুরুত্বের বিষয়টি তো তার না জানার কথা নয়। তাহলে দায়িত্বপূর্ণ পদে থেকে তিনি কুরবানি বন্ধের নির্দেশ দিলেন কোন বিবেচনায়, কোন চেতনায়? এমন কা-ের পর দেশের মানুষ কি তাকে কূটনীতিকের পদমর্যাদায় দেখতে চাইবে?
নতুন ডেপুটি হাইকমিশনারের এ কা-ে কলকাতা মিশনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া তার নির্দেশ কার্যকর হলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হওয়ার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে এটি একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা কূটনীতিকদের। এদিকে স্পর্শকাতর এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ডেপুটি হাইকমিশনার শাবাব বিন আহমেদ সাংবাদিককে তার পদক্ষেপের স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেন, হোস্ট কান্ট্রির আস্থা অর্জন করাটা আমাদের জন্য জরুরি। তিনি আরো বলেন, ‘যারা আমাদের মিশনের নিরাপত্তায় থাকে, তাদের সংখ্যা ২৫ জনের বেশি। এসব নিরাপত্তা কর্মীরা গরুর পূজা করে। আমরা যদি এখন সে গরু জবাই করি, তাহলে তাদের মনের অবস্থা কী হতে পারে, তা কি একবার ভেবে দেখেছেন’? ডেপুটি হাইকমিশনার তো সাংবাদিককে ভেবে দেখার কথা বললেন, আমাদের তো মনে হয় তারও ভেবে দেখার মতো বহু বিষয় রয়েছে। কলকাতা মিশনে কুরবানি করার রেওয়াজ তো দীর্ঘদিনের।
৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কলকাতা মিশনে কুরবানি হয়ে আসছে। প্রতিবছরই পাঁচ থেকে সাতটি গরু এবং ছাগল কুরবানি করা হয়। এ কুরবানি গোশতের একটা বড় অংশ বিভিন্ন এতিমখানায় পাঠানো হয়। তাছাড়া মিশনের চারপাশে বসবাসকারী মানুষের প্রায় ৯০ ভাগই মুসলিম। মুসলিমরাও প্রতি বছর বাংলাদেশ মিশন থেকে গোশত পেয়ে থাকেন। এভাবেই কলকাতা মিশনের কুরবানি একটা ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এখন নব্য ডেপুটি হাইকমিশনারের ঐতিহ্যবিরোধী পদক্ষেপ জনমনে কেমন প্রভাব ফেলবে? বাংলাদেশ সম্পর্কে কী বার্তা দিতে চাচ্ছেন এই কূটনীতিক।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সমমর্যাদার যে বার্তা দিতে চাচ্ছেন ভারতকে, তার বিপরীত পথে হাঁটাছেন নাতো শাবাব বিন আহমেদ? ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কলকাতা মিশনের কুরবানিতে নিরাপত্তা কর্মীদের কোনো সমস্যা না হলে, এখন সমস্যা হতে যাবে কেন? সমস্যাটা নব্য কূটনীতিকের মস্তিষ্কপ্রসূত নয়তো? বাংলাদেশ তো মুসলিমপ্রধান দেশ। তাই বলে এখানে সনাতন ধর্মের ভাইবোনেরা কি পূজা-অর্চনা করেন না? ঢাকঢোল ও ঘণ্টা বাজান না? বেশ ভালোভাবেই বাজান এবং সেসব অনুষ্ঠানে ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তারা আনন্দচিত্তে যান এবং উৎসাহ প্রদান করে থাকেন। এতে তো ভারতের সাথে বাংলাদেশের আস্থার ক্ষেত্রে কোনো সংকট সৃষ্টি হয় না। অথচ এ পূজা-অর্চনা মুসলমানদের দৃষ্টিতে শির্ক তথা মহাপাপ। আসলে যার যার ধর্ম পালন বিশ^াসীদের অধিকার। মানুষ ¯্রষ্টার কাছে তার কর্মের জবাবদিহি করবেন। মানুষ মানুষকে বাধা দেবে কেন? এখানে বলে রাখা ভালো যে, কলকাতা মিশন ভারতে অবস্থিত হলেও মিশনের এলাকাটি বাংলাদেশের সার্বভৌম এলাকা। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী সেখানে নিজেদের কর্মকা- পরিচালনায় বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাই শাবাব বিন আহমেদের আপন ধর্ম-কর্ম পালনে হীনম্মন্যতায় ভোগার কোনো কারণ নেই।
ভারতে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন একজন কূটনীতিক গণমাধ্যমকে বলেন, কলকাতার নতুন মিশনপ্রধান এখনো মিশনে যোগ দেননি। তার আগেই তিনি এ ধরনের স্পর্শকাতর ইস্যুতে যে পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। তার বক্তব্য এবং আরএসএসের বক্তব্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দেশের জন্য এটা বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে। তিনি বলেন, কলকাতা মিশনে কুরবানি করার রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। ওই কূটনীতিক আরও বলেন, কলকাতা মিশনের কুরবানির বিষয়টি ধর্মীয় ঐতিহ্যের পাশাপাশি এর একটি সামাজিক এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। কলকাতা মিশনের কুরবানিকে বিগত এবং বর্তমান মমতা সরকার ইতিবাচক হিসেবে দেখে। তারা এটাকে উদাহরণ হিসেবে দেখাতে চায় যে, পশ্চিমবঙ্গে সব ধর্মের মানুষের সমান ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে। আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন। সুতরাং কলকাতা মিশনে কুরবানি বন্ধ হলে এটা একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হবে। বিজেপি-আরএসএস এটাকে তাদের পক্ষে ব্যবহারের চেষ্টা করবে। আর মমতা সরকার এটাকে মোটেই ভালোভাবে নেবে না। সুতরাং ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
কলকাতার নতুন মিশন প্রধানের কুরবানি বিষয়ে নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে কলকাতা মিশনে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, নতুন মিশনপ্রধান এখন হেগে মিনিস্টার (রাজনৈতিক) হিসেবে কর্মরত আছেন। গত জানুয়ারি মাসে ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে তার কলকাতায় পোস্টিং অর্ডার হয়। আগামী জুন মাসের মধ্যে তার দায়িত্ব নেওয়ার কথা। কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার আগেই কয়েক মাস ধরে মিশনে কুরবানি বন্ধের ব্যাপারে তৎপর হন তিনি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাকে মিশনের কুরবানির বিষয়টি নিয়ে এর স্পর্শকাতরতার কথা বারবার তুলে ধরে এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে অপরাগতার কথা জানান। কিন্তু তিনি কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করেননি। একপর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নতুন মিশন প্রধানকে জানান, আপনি দায়িত্ব গ্রহণের পর আপনার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবেন। আমাদের পক্ষে কুরবানি বন্ধ করা সম্ভব নয়।
কলকাতা মিশন প্রধানের কুরবানি বন্ধের সিদ্ধান্তে মিশনের ভেতরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। তার সিদ্ধান্তের সাথে কেউই একমত নন। তাছাড়া বিষয়টি মিশনের বাইরেও জানাজানি হয়ে গেছে। কলকাতার অনেক সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী ফোন করছেন। তারা সবাই হিন্দু সম্প্রদায়ের। তারা বলছেন, বাংলাদেশ যেন কোনোভাবেই কুরবানি বন্ধের সিদ্ধান্ত না নেয়। কারণ, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে। শাবাব বিন আহমেদের বক্তব্যকে ঘিরে নানা মহলে আলোচনা চলছে এখন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কূটনীতিক কথা প্রসঙ্গে সাংবাদিককে বলেন, আমি বিস্মিত। এ ধরনের বক্তব্য তার দেওয়ার কথা নয়। কুরবানি বন্ধ হবে কিনা, সে সিদ্ধান্ত তো হেডকোয়ার্টার অথবা হাইকমিশনের কাছ থেকে আসতে হবে। ডেপুটি হাইকমিশনার কীভাবে এ ধরনের স্পর্শকাতর ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, যিনি এখনো দায়িত্বই গ্রহণ করেননি। এটি সত্যিই রহস্যজনক! এখানে অন্য কিছু থাকতে পারে। তিনি আরও বলেন, এর আগে এ কূটনীতিক বাংলাদেশের দিল্লি হাইকমিশনে কাজ করেছেন। সে সময় হয়তো তিনি ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির আদর্শে দীক্ষিত হয়েছেন।
শাবাব বিন আহমেদ বিজেপির আদর্শে দীক্ষিত হয়েছেন কিনা তার পূর্ণাঙ্গ বার্তা আমাদের কাছে নেই। তবে মোদি সরকারের অন্যতম প্রধান মুখপত্র ‘দ্য ইন্ডিয়া টুডেতে’ শাবাব বিন আহমেদকে নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশের বার্তা আমাদের কাছে আছে। কলকাতার মিশনপ্রধান হিসেবে শাবাব বিন আহমেদের নিয়োগের পর ইন্ডিয়া টুডেতে বিশাল এক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে শাবাব বিন আহমেদের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যখন রীতিমত পরীক্ষার মধ্যে পড়েছে, ঠিক সে সময় কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে ডেপুটি হাইকমিশনারের নিয়োগটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে, আমরা একজনকে পেতে যাচ্ছি, যিনি দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অবৈধ অনুপ্রবেশ, সাম্প্রদায়িক সহিংসতাসহ স্পর্শকাতর ইস্যুগুলো সমাধানে ভূমিকা নেবেন। দ্য ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে আরও বলা হয়, শাবাব বিন আহমেদের দায়িত্ব পালনকালে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে। মোদি সরকারের মুখপত্র দ্য ইন্ডিয়া টুডেতে যখন এমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়, তখন প্রশ্ন জাগে, শাবাব বিন আহমেদ আসলে কাদের লোক? তবে তাদের আশাবাদ ফলতে শুরু করেছে। কলকাতা মিশনে যোগদানের আগেই তো তিনি কুরবানি বন্ধের নির্দেশ দিলেন। এভাবে তিনি যে যাত্রা শুরু করলেন, তাতে বাংলাদেশের জনমনে তিনি একজন বিতর্কিত কূটনীতিক হিসেবেই চিহ্নিত হলেন। জুলাই অভ্যুত্থানের পরেও বাংলাদেশের কূটনীতিকের এ কেমন চেহারা? গণঅভ্যুত্থানের ফসল আন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে এটি একটি পরীক্ষা এমন কূটনীতিক নতুন বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত কিনা, সেই সিদ্ধান্ত তো অন্তর্বর্তী সরকারকেই নিতে হবে।