মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা যখন সভ্যতার শাসকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন যুদ্ধ তো অনিবার্য। নতুন অস্ত্রের জায়গার জন্য গোডাউনের পুরানো অস্ত্রের অপসারণ প্রয়োজন। আর এজন্য দরকার নতুন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। ইরাক, আফগানিস্তান, ইউক্রেন ঘুরে যুদ্ধ এখন ইরানে। যুদ্ধ এখানেই থেমে যাবে না। আরো নতুন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হবে ভূরাজনীতির নামে। এ বিশ^ব্যবস্থা ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ হয়তো চলতেই থাকবে। এ প্রক্রিয়ায় পৃথিবীটাই একসময় ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। কারণ, শান্তি ও সমঝোতার জন্য যে ন্যায়ভাবনা ও মানবিক বোধ প্রয়োজন, তা বর্তমান বিশ^ব্যবস্থার শাসকদের মধ্যে নেই। তারা সবাই সংকীর্ণ স্বার্থ চিন্তার গোলাম। তাদের লাভ-ক্ষতির হিসেবেটা একেবারেই স্থূল। এসব বিশ^নেতার পাথরসদৃশ হৃদয়টা সত্য উপলব্ধিতে অক্ষম। চক্ষু ধারণ করেও সত্যদর্শনে তারা ব্যর্থ। তাদের কর্ণে মজলুমের আহাজারি পৌঁছে না। ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ এদেরই ভ্রষ্ট ভাবনার আয়োজন।
তেলআবিব থেকে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাল্টাপাল্টি হামলা চালিয়ে যেতে অনড় ইসরাইল ও ইরান। আর ১৮ জুন দুবাই থেকে রয়টার্স জানায়, ইরানের সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। এসব হামলার নিশানা করা হচ্ছে ইরানের সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা, পারমাণবিক স্থাপনা ও ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনকেন্দ্র। ইসরাইলি হামলার পাল্টা জবাব দিয়ে যাচ্ছে ইরানও। ইসরাইলের একটি সামরিক গোয়েন্দা কেন্দ্র ও গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের অপারেশন পরিকল্পনা কেন্দ্রে হামলার দাবি করেছে ইরান। ইসরাইলের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। তবে দেশটির হার্জলিয়া শহরের একটি ‘স্পর্শকাতর’ স্থানে হামলার কথা জানিয়েছে ইসরাইলি গণমাধ্যম। ইরান-ইসরাইল সংঘাতের পঞ্চম দিনে এসে উপলব্ধি করা যাচ্ছে, যুদ্ধটি একতরফা হচ্ছে না। উভয় দেশের বড় ক্ষতি হচ্ছে; মানুষও মারা যাচ্ছে। যুদ্ধ সহসা থেমে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ বিশে^ তো কোনো বিশ^নেতা নেতা নেই। হৃদয়হীন বিশাল বপুর নেতাদের মাথায় যুদ্ধের মানচিত্র আছে, সে নিরীখে অস্ত্র উৎপাদনের উত্তেজনা আছে। এমন নেতারা যুদ্ধবন্ধে অবদান রাখবেন কেমন করে? তবে বিশাল বপুর এসব ক্ষুদ্র মানুষদেরও ঠেকা আছে, বিপদ থেকে তারাও মুক্ত নন। তেমন পরিস্থিতি স্পষ্ট হলে, এসব মূর্খরা যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিলেও নিতে পারেন। বিশ^নেতাদের অবনতিশীল মননের চিত্রটা উপলব্ধি করার মত।
বিশে^র উন্নত সাতটি দেশের জোট জি-৭-এর নেতারা গত সোমবার রাতে এক যৌথ বিবৃতিতে ইসরাইলের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। একই সঙ্গে তারা ইরানকে ম্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার উৎস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এরাই আবার পুরো অঞ্চলে সহিংসতা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছেন। এদের এমন আহ্বানকে তো প্রহসনের মতো মনে হচ্ছে। জি-৭ জোটের সদস্য রাষ্ট্রগুলো হলো আমেরিকা, বৃটেন, কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি ও জাপান। অতিগুরুত্বপূর্ণ এ রাষ্ট্রগুলোর নেতারা যৌথ বিবৃতিতে কেমন করে বললেন, মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার উৎস ইরান। আর তারা যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতি সমর্থনই বা ব্যক্ত করলেন কোন কা-জ্ঞানে? গাজা নামক একটি জনপদকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে কারা? ইরানে শুক্রবার নৃশংস হামলা চালিয়েছে কারা? এ রাষ্ট্রটি কি ইসরাইল নয়? আসলে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার উৎস হলো ইসরাইল। এ সত্য উচ্চারণে সক্ষম হলেন না জি-৭-এর বড় বড় নেতারা। ন্যায়ের ঝা-া উড্ডয়নে ব্যর্থতার কারণে তারা অনেক ছোট হয়ে গেলেন। ফলে এদের ওপর বিশ^বাসী আস্থা রাখবেন কোন যুক্তিতে। ফলে বলা চলে, ন্যায়-নীতিহীন এক পঙ্কিল বিশ^ব্যবস্থায় কালান্তরের প্রহর গুণছে বিশে^র শোষিত-বঞ্চিত ও নির্যাতিত মানবম-লি। বিষয়টি এখন উন্নত বিশে^র মানুষও উপলব্ধি করছেন। তারা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করছেন এবং প্রকাশ করছেন ক্ষোভ।
ইসরাইলের ইরানে হামলার বিষয়টিকে তীর্যক ভাষায় সমালোচনা করছেন বিশ্লেষকদের অনেকে। কেউ কেউ তো বলছেন, ইরাকের সে সাজানো গল্পটাই যেন আবার দেখা গেল। আগেরবার ছিল ইরাক, এবার ইরান। যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্র ইসরাইলের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র আছে, কিন্তু কেউ তাদের কাছে জবাবদিহি চাইছে না। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তাররোধ চুক্তিতে (এনপিটি) স্বাক্ষরকারী সদস্য রাষ্ট্র। তারা আন্তর্জাতিক পরিদর্শনের জন্য আন্তর্জাতিক পরমাণুশক্তি সংস্থাকে (আইআইএ) অনুমতি দিয়েছে। ফলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সবসময় নজরদারির মধ্যে থাকে। শুধু সম্ভাব্য পারমাণবিক সক্ষমতার অভিযোগেই ইরানের ওপর বিধ্বংসী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। অন্যদিকে ইসরাইল এনপিটিতে স্বাক্ষর করেনি। ইসরাইল কখনো আইএইএকে তাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের অনুমতি দেয়নি। আর এটা ব্যাপকভাবে বিশ^াস করা হয় যে, ইসরাইলের কাছে ৯০টি পারমাণবিক ওয়্যারহেড রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক অস্ত্রে শক্তিধর একমাত্র দেশ হলো ইসরাইল। দেশটি দীর্ঘদিন ধরে বেসামরিক মানুষদের লক্ষ্যবস্তু করার প্রাণঘাতী কৌশল অবলম্বন করে আসছে।
এছাড়া তারা ধারাবাহিকভাবে আন্তর্জাতিক আইন উপেক্ষা করে আসছে। এখানে উল্লেখ করার মত বিষয় হলো, ইসরাইলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তদন্ত চলছে। তারা গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। প্রতিদিন সেখানে ফিলিস্তিনীদের হত্য করা হচ্ছে। শিশুদের দেহ খ-বিখ- হচ্ছে। বসতি পুড়ে ছাই হচ্ছে। আর এসব নৃশংস ধ্বংসযঞ্জের জন্য দায়ী যে রাষ্ট্র, পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত সে রাষ্ট্রই অন্য রাষ্ট্রকে নজরদারির মধ্যে আনার দাবি জানাচ্ছে। আর তা সমর্থন করছে বিশে^র বড় বড় রাষ্ট্রগুলো। কী অদ্ভুত আমাদের বিশ^ব্যবস্থা। বিষয়টি এখন বেশ স্পষ্ট যে, নিয়ম-কানুন শুধু দুর্বলদের জন্য। কিছু রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অইনকে অবজ্ঞা করে যে কোনো কিছু করতে পারে। আর এ কাজে তারা ভূরাজনৈতিক জোটের প্রশ্রয় পায়। একসময় তো বিশে^র রাজনৈতিক জোট এবং সংবাদমাধ্যম জিগির তুলেছিল, ইরাকের গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে। এ অভিযোগে ইরাকে হামলা করা হলো, দেশটিকে ধ্বংস করা হলো। কিন্তু পরে সবই মিথ্যা প্রমাণিত হলো। কিন্তু এ অপরাধের জন্য সভ্যতার শাসকদের কোনো শাস্তি হয়েছিল কি? ইরাকের সাজানো সে গল্প আবার লক্ষ্য করা যাচ্ছে ইরানের ক্ষেত্রেও। এমন বিশ^ব্যবস্থা ও সভ্যতা দিয়ে মানুষ কী করবে? ধিক এই বিশ^ব্যবস্থাকে।
ইসরাইলের পারমাণবিক অস্ত্রভা-ার আছে, সেটা আতঙ্কের বিষয় নয়, অথচ ইরান পারমাণবিক বোমা বানিয়ে ফেলেছে, এমন প্রোপাগা-ায় উন্নত বিশ^ আতঙ্কিত হচ্ছে কেন? এমন দ্বিচারিতা নিন্দনীয়। আর ওই প্রোপাগা-ার উৎস কোথায়, তা তো উন্নত বিশে^র না জানার কথা নয়। তবে বিশে^র মানুষ বিষয়টি বুঝে ফেলেছে। তেমন উপলব্ধি খোদ যুক্তরাষ্ট্রের মানুষেরও আছে। এ কারণে ট্রাম্প শিবিরেও বিভক্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ট্রাম্প শিবিরের অনেকেই এখন বিনাপ্রশ্নে সিরাইলকে সমর্থন করার বিষয়টিকে মেনে নিতে পারছেন না।
তারা বলছেন, এটা ‘আমেরিকা ফাস্ট’ নীতির পরিপন্থী। অথচ এটি ছিল ট্রাম্পের মূল নির্বাচনী স্লোগান। নীতিহীন রাজনীতি এভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে চলমান যুদ্ধে ‘আগুনে ঘি ঢালছেন’ বলে অভিযোগ করেছে চীন। গত মঙ্গলবার তেহরানের বাসিন্দাদের অবিলম্বের শহর খালি করতে ট্রাম্পের দেওয়া পরামর্শের পরিপ্রেক্ষিতে তেহরানে অবস্থিত চীনা দূতাবাস এক বিবৃতিতে এ অভিযোগ করে। ভাবতে অবাক লাগে, অতি বড় দেশের একজন অতি বড় প্রেসিডেন্ট কী করে এমন আহ্বান জানান। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোনো দেশের কি সার্বভৌমত্ব থাকতে নেই? আগুনে ঘি ঢালার বদলে পানি ঢালার কাজটি কি এখন সঙ্গত নয়? এ ব্যাপারে আমেরিকার নাগরিকরা কথা বলতে শুরু করেছেন।