উচ্চশিক্ষা জাতির অগ্রযাত্রার অন্যতম ভিত্তি। কিন্তু শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার উপযোগী পরিবেশ না থাকলে সে শিক্ষা কার্যকর হয় না। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর আবাসিক হলগুলো বহু বছর ধরেই শিক্ষার্থীদের জন্য এক বড় সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসনসংখ্যার ঘাটতি, রাজনৈতিক দখল, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং শিক্ষার্থীর ক্রমবর্ধমান চাপ এ সংকটকে আরও তীব্র করে তুলেছে। ফলে শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপ, আর্থিক দুর্ভোগ ও শিক্ষাজীবনে অনুৎসাহের শিকার হচ্ছে।

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার সূচনা ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে যে আবাসিক হলগুলো চালু করা হয়েছিল সেগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য সুলভ ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছিল। পাকিস্তান আমলেও বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজগুলোতে নতুন হল নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর শিক্ষার্থী সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে গেলেও আবাসন সুবিধা ততটা বৃদ্ধি পায়নি। ১৯৮০ বা ৯০ এর দশকে নতুন কিছু হল নির্মাণ করা হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা পর্যাপ্ত ছিল না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী কলেজে ভর্তি হলেও তাদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা তেমন গড়ে ওঠেনি। ফলে ধীরে ধীরে আবাসন সংকট একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

বর্তমানে দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজেই আবাসন সংকট বিদ্যমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড়ো ক্যাম্পাসগুলোতেও মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হলেও সে তুলনায় আবাসন সুবিধা পাননি অনেকেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়-সংযুক্ত বড় কলেজগুলোতেও একই অবস্থা। হলের কক্ষগুলোতে নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে দু’-তিন গুণ শিক্ষার্থী থাকতে বাধ্য হয়। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য পরিস্থিতি আরও করুণ; নিরাপদ ও পর্যাপ্ত আবাসনের অভাব তাদের শিক্ষাজীবনে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ যেমন কারমাইকেল কলেজ, বরিশাল বিএম কলেজ কিংবা খুলনার বিএল কলেজের অবস্থা আরো শোচনীয়। বিএল কলেজে শহীদ তিতুমীর হল এরই মধ্যে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি, করুণ অবস্থা দেখা যায়, টেকনিকাল কলেজ বা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট, অথবা ভেটেরেনারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে। কিছু কিছু হলের ভেতরকার পরিস্থিতি এতটাই নোংরা ও অগোছালো যে, সেখানে আদৌ কোনো মানুষ বসবাস করতে পারে না। উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর এই আবাসন সংকটের নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। যেমন:

১. অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা : দেশে উচ্চশিক্ষা প্রসারিত হলেও আবাসন সুবিধা সে হারে গড়ে ওঠেনি। পুরনো হলগুলো জরাজীর্ণ, নতুন হল নির্মাণ খুব ধীরগতিতে হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশকে বাইরে ভাড়া বাসা বা মেসে থাকতে হয়।

২. রাজনৈতিক দখল ও সিট বণ্টন : অধিকাংশ হল রাজনৈতিক প্রভাবাধীন। ছাত্রসংগঠনগুলো সিট দখল করে রাখে এবং নিজেদের কর্মীদের সুবিধা দেয়। প্রকৃত দরিদ্র বা প্রান্তিক শিক্ষার্থীরা হলে জায়গা পায় না। এর সাথে যোগ হয়েছে “গেস্ট রুম সংস্কৃতি” ও জোরপূর্বক সিট বণ্টন প্রক্রিয়া- যেগুলোর কারণে অনেক শিক্ষার্থী হয়রানির শিকার হয়।

৩. শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধি : প্রতি বছর নতুন নতুন অনুষদ ও বিভাগ খোলা হচ্ছে, ভর্তি কোটা বাড়ছে। কিন্তু সে তুলনায় নতুন হল নির্মাণ হচ্ছে না। ফলে সংকট আরও বাড়ছে।

৪. নারী শিক্ষার্থীদের বিশেষ সংকট : শিক্ষার বিস্তারের ফলে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু তাদের জন্য পর্যাপ্ত ও নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা নেই। অনেককে দূর থেকে যাতায়াত করতে হয় বা ব্যয়বহুল ভাড়া বাসায় থাকতে হয়, যা পরিবারগুলোর জন্য আর্থিক চাপ তৈরি করছে।

সমাজ ও শিক্ষার্থীদের জীবনে প্রভাব : আবাসন সংকট শিক্ষার্থীদের ওপর নানা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যারা বাইরে মেস বা ভাড়া বাসায় থাকে, তাদের অতিরিক্ত ভাড়া, খাবার খরচ ও যাতায়াত ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। এতে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো কষ্টে পড়ে। অধিকন্তু নিরাপত্তাহীনতার সংকটও রয়েছে যা শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপে রাখে। অন্যদিকে, হলগুলোতে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী থাকার ফলে পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট হয়, স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয় এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নষ্ট হয়। এসব কারণে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ফলাফল, মানসিক সুস্থতা ও ক্যারিয়ার পরিকল্পনা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়।

বিদেশের অনেক দেশে শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত আবাসন নিশ্চিত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যাম্পাসে ডরমিটরি ও অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবস্থা থাকে। ভারতেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন হল নির্মাণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে এই খাতে বিনিয়োগ খুবই সীমিত। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট ও অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় যে, আবাসন সমস্যার সমাধান করলে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগ ও শিক্ষার মান দুটোই বাড়ে। আবাসন সংকট নিরসনে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি:

১. নতুন হল নির্মাণ : প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যার অনুপাতে হল নির্মাণ জরুরি।

২. বিদ্যমান হল সংস্কার ও সম্প্রসারণ : পুরনো হলগুলো সংস্কার ও আধুনিকীকরণ করতে হবে।

৩. স্বচ্ছ সিট বণ্টন ব্যবস্থা : রাজনৈতিক দখল বন্ধ করে ন্যায়সংগত নিয়মে সিট বরাদ্দ করতে হবে।

৪. নারীদের জন্য আলাদা ও নিরাপদ হল তৈরি : নারী শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক হল নির্মাণ করতে হবে।

৫. সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব : বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও বেসরকারি খাত একসাথে শিক্ষার্থীদের জন্য সাশ্রয়ী আবাসন প্রকল্প শুরু করতে পারে।

৬. মেস ও ভাড়া বাসা নিয়ন্ত্রণ : যেসব শিক্ষার্থী বাইরে থাকে তাদের জন্য ভাড়া নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

নিম্নমানের খাবার সরবরাহ : শুধু আবাসনই নয়, হলে থাকা শিক্ষার্থীদের অন্যতম বড় সমস্যা হলো নিম্নমানের খাবার। অধিকাংশ হলে মেসের খাবারের মান খুবই খারাপ। খাবারে পুষ্টির ঘাটতি, অপরিষ্কার রান্নাঘর, পঁচা বা বাসি উপকরণ ব্যবহার, পর্যাপ্ত সবজি-প্রোটিনের অভাবÑএসব কারণে শিক্ষার্থীরা নানা রোগে আক্রান্ত হয়। খাবারের মান নিয়ন্ত্রণে কার্যকর তদারকি না থাকায় অভিযোগ করলেও তা সমাধান হয় না। অনেক শিক্ষার্থী বাধ্য হয়ে বাইরে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার খায়, যা ব্যয়বহুল ও স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ।

পরিবহন সংকট : বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত পরিবহনের অভাবও শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় সমস্যা। রাজধানী ঢাকায় কিংবা চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ক্যাম্পাসে প্রতিদিন হাজারো শিক্ষার্থীকে দূরদূরান্ত থেকে যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বাস সংখ্যা শিক্ষার্থীর তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। ফলে বাসে গাদাগাদি করে যাতায়াত, দীর্ঘ সময় অপেক্ষা বা বিকল্প ভাড়ায় যাওয়া শিক্ষার্থীদের নিত্যদিনের বাস্তবতা। এতে শিক্ষার্থীরা শুধু আর্থিক চাপেই পড়ে না, বরং পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় সময়ও হারায়। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা নিরাপদ পরিবহনের ঘাটতিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

চিকিৎসা পরিসেবার সংকট : শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়েও পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সীমিত সংখ্যক চিকিৎসক ও ন্যূনতম ওষুধ সরবরাহ থাকে, যা বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য একেবারেই অপর্যাপ্ত। জটিল রোগ বা দুর্ঘটনা ঘটলে শিক্ষার্থীদের বাইরে প্রাইভেট ক্লিনিক বা সরকারি হাসপাতালের দ্বারস্থ হতে হয়। অনেক সময় জরুরি অবস্থায় দ্রুত সেবা না পাওয়ায় ক্ষতির শিকার হতে হয়। আবাসিক হলে চিকিৎসক ও ফার্স্ট এইড সেবা প্রায় অনুপস্থিতই বলা যায়।

উপরোক্ত সংকটগুলো শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে বহুমুখী প্রভাব ফেলছে। আবাসন সংকট তাদের পড়াশোনার উপযোগী পরিবেশ থেকে বঞ্চিত করছে, নিম্নমানের খাবার শারীরিক সক্ষমতা নষ্ট করছে, পরিবহন সংকট সময় নষ্ট করছে এবং চিকিৎসা পরিষেবার অভাব তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রাখছে। আর্থিক চাপ, মানসিক উদ্বেগ, ক্লান্তি ও নিরাপত্তাহীনতা শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশকে ব্যাহত করছে। ফলে শিক্ষার মান কমে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

এ বিষয়ে আমার কলম ধরার কারণও আছে। কয়েকদিন আগে খুলনায় গিয়েছিলাম। সেখানে বিএল কলেজ পরিদর্শন করতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের আবাসনসহ নানাবিধ সংকট দেখে যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়েছি। আমি কেবল ভেবেছি যে, ছাত্র জনতার এত বড়ো একটি অভ্যুত্থানের পর ছাত্র সংশ্লিষ্ট এসব সমস্যার কোনো সমাধানই হয়নি। বর্তমান অন্তবর্তী সরকারে এখনো দুজন ছাত্র উপদেষ্টা রয়েছেন। ছাত্ররা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কমিশনের সদস্য হয়েছেন। সবমিলিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন এক ডজন ছাত্র নেতা। কিন্তু সরাসরি ছাত্রজীবন থেকে রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে কাজ করার সুযোগ পাওয়ার পরও তারা মাত্র এক বছর আগের তাদের আবাসনস্থল বিশেষ করে আবাসিক হলগুলোর সংকট নিরসনে তেমন কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন বলে চোখে পড়েনি।

উল্টো ছাত্ররা রাজনৈতিক নানা পদে চলে যাওয়ায় এবং রাজনৈতিক দল চালু করাসহ রাজনৈতিক নানা কর্মসূচিতে জড়িয়ে যাওয়ায় তারা প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর বিরাগভাজন হয়ে পড়েছেন। এমতাবস্থায় ছাত্রদের বিষয়ে নানা মহলে কিছু নেতিবাচক মনোভাবও তৈরি হয়েছে। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও ছাত্র উপদেষ্টারা বলবৎ থাকার পরও ছাত্রদের নানাবিধ সংকটের সমাধান না হওয়া উদ্বেগজনক। আগামীতে গতানুগতিক নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসলে ছাত্রদের নিত্যদিনের এসব সংকট সামনের দিনগুলোতে আরো প্রকট হয়ে যেতে পারে- যা খুবই দু:খজনক বিষয় হবে এবং একইসাথে এরকম অনাকাঙ্খিত বাস্তবতা জুলাই অভ্যুত্থানের বৈষম্যবিরোধী চেতনারও সম্পুর্ন বিরোধী। প্রকৃত বাস্তবতা হলো, আবাসন, খাবার, পরিবহন ও চিকিৎসাÑএসব সংকট সমাধান না করলে উচ্চশিক্ষার মান কখনোই কাক্সিক্ষত পর্যায়ে উন্নীত হবে না। শিক্ষার্থীরা দেশের ভবিষ্যৎ সম্পদ; তাই তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং সমাজকে একসাথে কাজ করতে হবে। উন্নত ও আধুনিক বাংলাদেশ গঠনের জন্য এই সকল সংকট নিরসন চলমান সময়ের প্রেক্ষাপটে তাই ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ।