সম্প্রতি একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভারত-পাকিস্তান প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেছেন। নানা বিশ্লেষণের পর উপসংহারে তিনি বলেছেন, আজ দক্ষিণ এশিয়ার সামনে প্রশ্ন একটাই- আমরা কি ঘৃণার রাজনীতিকে স্থায়ী করতে চাই, নাকি সাধারণ মানুষের ঐক্য আর শান্তিকে সামনে নিয়ে আসবো? সময়ের দাবি হলো দ্বিতীয় পথটি বেছে নেওয়া। কারণ যুদ্ধ নয়, সহযোগিতা ও বোঝাপড়ার মাধ্যমেই প্রায় ২০০ কোটি মানুষের এ অঞ্চল টেকসই ভবিষ্যতের পথে এগোতে পারবে। টেকসই ভবিষ্যৎ কেনা চায়? তবে এর জন্য যুদ্ধ নয়, বরং প্রয়োজন সহযোগিতা ও বোঝাপড়ার মানসিকতা। কিন্তু এখন তো আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতিতে ঘৃণার চেতনাই প্রবল। তবে সাধারণ মানুষ হিংসা ও ঘৃণার বদলে শান্তিময় বিশ্ব চায়। ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদদের অবস্থান কিন্তু এর বিপরীতে। তাই এখন প্রয়োজন নতুন রাজনীতি। এ রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে হলে দেশে দেশে প্রয়োজন জনতার জাগৃতি, গণজাগরণ। এক্ষেত্রে সময়ের দাবি পূরণে এগিয়ে আসতে হবে দেশের প্রাগ্রসর নাগরিকদের।

ঘৃণা আসলে কোনো কাজের বিষয় নয়। ঘৃণার রাজনীতি দেশে দেশে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, যুদ্ধে লিপ্ত করতে পারে, এমনকি ঘনীভূত করতে পারে আর একটি বিশ^যুদ্ধ। অবশ্য যাদের বিবেক আছে, তারা এখনো ঘৃণা, নৃশংসতা ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। কথা বলছেন যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্র ইসরাইলের অভ্যন্তরেও। সম্প্রতি বৃটিশ সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজায় চলমান নৃশংসতা বন্ধ না করলে ইসরাইলের ওপর ‘কঠোর নিষেধাজ্ঞা’ দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ইসরাইলের ৩১ জন বিশিষ্ট নাগরিক। এ যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন শিল্পী, কবি, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক ও অস্কারবিজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাতা।

বিবৃতিতে এসব বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেছেন, ‘গাজার বাসিন্দাদের অনাহারে রেখে মেরে ফেলতে চাইছে ইসরাইল। পাশাপাশি উপত্যকাটির লাখ লাখ ফিলিস্তিনীকে জোর করে গাজা থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছে। গাজায় ইসরাইলী বাহিনীর এ নৃশংসতা বন্ধ না হলে এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর না করলে ইসরাইলের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবশ্যই কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে।’ দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরাইলের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে দেশটির বিশিষ্ট নাগরিকদের এ ধরনের একটি যৌথ বিবৃতি নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, ইসরাইল সরকারের খোলামেলা সমালোচনার চেয়ে দেশটির নাগরিকদের এ ধরনের যৌথ বিবৃতি দেওয়ার ঘটনা এখানে বিরল। এছাড়া ইসরাইল এমন একটি দেশ যেখানে এ ধরনের আহ্বান কেউ জানালে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইন ও বিধিবিধান রয়েছে। ফলে বলা চলে, ৩১ জন বিশিষ্ট নাগরিক নেতানিয়াহু সরকারের প্রতি এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন।

গত কয়েক মাস ধরে গাজায় ত্রাণ প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ইসরাইল। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)-এর মাধ্যমে গাজায় স্বল্প পরিসরে ত্রাণ দেওয়া শুরু হয়। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল পরিচালিত জিএইচএফ-এর ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে ত্রাণ নিতে গিয়ে প্রতিদিনই ইসরাইলী বাহিনীর গুলীতে কয়েক ডজন করে ফিলিস্তিনী নিহত হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে গাজায় ইসরাইলী হামলা বন্ধের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে ইসরাইলের ওপর। এমনকি ইসরাইলের অভ্যন্তর থেকেও নানাভাবে চাপ আসছে। গত সোমবার ইসরাইলের দু’ শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা ‘বেতসেলেম’ এবং ‘ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস ইসরাইল’ প্রথমবারের মতো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, গাজার ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চলছে। ইসরাইলের মানবাধিকার সংস্থার পক্ষ থেকে এ ধরনের বিবৃতি দেওয়ার ঘটনাও বিরল। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত ইহুদিদের সংগঠন ‘রিফর্ম মুভমেন্ট’ গত রোববার এক বিবৃতিতে গাজায় দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ার জন্য ইসরাইল সরকারকে দোষারোপ করে। সংগঠনটি বলেছে, ‘খাবার, পানি, ওষুধ ও বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেওয়া অমার্জনীয় অপরাধ। ইসরাইলের প্রতি ভালোবাসা যেন দুর্বলদের কান্না অনুধাবনে আমাদের অন্ধ করে না দেয়। আসুন, এ মুহূর্তের নৈতিক এ চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে আমরা সোচ্চার হই।’

ক্রিয়ার তো প্রতিক্রিয়া হয়। কর্মফলও মানুষকে ভোগ করতে হয় এ দুনিয়ায়। আখিরাতের বিষয়টিও ভুলে গেলে চলবে না। যদিও বর্তমান সেক্যুলার তথা ইহলৌকিক সভ্যতায় পারলৌকিক জবাবদিহিতার বিষয়টি বেশ গৌণ হয়ে পড়েছে। তবে এখনো প্রাচ্য ও প্রাতিচ্যের বহু বিশ^াসী মানুষ মহান ¯্রষ্টা ও পয়গম্বরদের বাণীতে আস্থা রাখেন। তারা কর্মফলকে গুরুত্ব দেন। কর্মফলের গুরুত্ব এবার ভালোভাবে উপলব্ধি করেছেন ইসরাইলের সাবেক এক প্রধানমন্ত্রী। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেত মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে এক পোস্টে বলেন, আমেরিকানদের চোখে ইসরাইল এখন ‘অচ্ছুত’ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আমেরিকায় ইসরাইলের সম্মান ধসে পড়েছে। আমেরিকায় ১০ দিন সফরের পর দেশে ফিরে এসে বেনেত এমন মন্তব্য করলেন। উল্লেখ্য, বেনেত ২০২১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বেনেত তার পোস্টে বলেন, সম্প্রতি আমেরিকা সফরে গিয়ে তিনি ইহুদিবিদ্বেষের ভয়াবহ মাত্রা পর্যবেক্ষণ করে এসেছেন। ইসরাইলি সরকারের কর্মকা-ে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এবং তারা আমেরিকার সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক নষ্ট করেছে। তিনি বলেন, ‘আমেরিকার সব সমস্যা, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য আমাদের দায়ী করা হচ্ছে। দু’ রাজনৈতিক দল থেকেই এ দায় দেওয়া হচ্ছে।’ বেনেত বলেন, তার জীবনে আমেরিকায় এমন ইহুদিবিদ্বেষ দেখেননি। ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান দু’ দলের মধ্যেই ইসরাইলের প্রতি সমর্থন হ্রাস পাচ্ছে। সাবেক ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ আন্দোলনের সদস্যরাও ইসরাইলের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখছে। আমেরিকায় ইসরাইলের বন্ধুরাও তেল আবিবের পক্ষাবলম্বন করতে গিয়ে কঠিন বিরোধিতার মুখে পড়ছে। বেনেত তো কিছু কথা বললেন, তবে সব কথা বলেননি।

ইসরাইলের ৩১ বিশিষ্ট নাগরিকও তাদের মনোভাব ব্যক্ত করার চেষ্টা করেছেন। ইসরাইলের মানবাধিকার সংস্থাও এখন বলছে, গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চলছে। মার্কিনীদের চোখেও ইসরাইল এখন একটি ‘অচ্ছুত’ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। কর্মফল মানুষকে ভোগ করতেই হয়। যুদ্ধাপরাধী দাম্ভিক প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে এখন কর্মফল ভোগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তবে তার হুঁশ ফিরতে বোধ হয় আরো কিছুটা সময় লাগবে। না হয়, কী করে তিনি গাজা সম্পূর্ণভাবে দখল করার পরিকল্পনা করতে পারেন। নেতানিয়াহুর এ পরিকল্পনা ঘিরে দেশটির অভ্যন্তরেও ব্যাপক উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। সেনাবাহিনীর ভেতর থেকেও আপত্তি উঠেছে। নেতানিয়াহুর এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তীব্র মতবিরোধে জড়িয়েছেন দেশটির সেনাপ্রধান ইয়াল জামির। সরাসরি এ পরিকল্পনার বিরোধতা করে তিনি বলেছেন, এটা আইডিএফের জন্য একটি ‘ফাঁদ’। বিভক্তির জেরে সেনাপ্রধানকে বরখাস্তের হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। তিনি তো ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে বহু ফাঁদ পেতেছেন। তার জন্যও তো কোনো না কোনো ফাঁদ অপেক্ষা করছে। নেতানিয়াহুর মত একজন নিষ্ঠুর যুদ্ধাপরাধীর জন্য যদি মহান ¯্রষ্টা বড় কোনো ফাঁদ পেতে রাখেন, তাতে আমরা অবাক হবো না।