এক অনিবার্য বাস্তবতায় দেশে গত বছর জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। বিকল্পও ছিল না এর কোনো। কারণ আওয়ামী ফ্যাসিবাদীরা ২০০৮ সালে সাজানো, পাতানো ও সমঝোতার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে দেশ ও জাতির ঘাড়ে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল। কথিত এ নির্বাচন ছিল বানরের পিঠাভাগের নির্বাচন। এমন দাবি আওয়ামী বিরোধীদের নয়, বরং দলটির তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুল জলিল এ বিষয়ে রীতিমতো আত্মস্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি খোলাসা করেই বলেছিলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচন ছিল সমঝোতার নির্বাচন। তাই ১/১১-এর জরুরি সরকার এবং সে সরকারের অধীনে নির্বাচনকে সাজানো-পাতানো নির্বাচন বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত। মূলত এটি ছিল সে সময় ফখরুদ্দীন-মঈন উদ্দিনের আওয়ামী পুনর্বাসন প্রকল্প। দীর্ঘ ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল। আর সে মাফিয়াতান্ত্রিক শাসন অব্যাহত ছিল প্রায় ১৬ বছর ধরে।

‘বিপ্লব’ দীর্ঘ পরিসরের আন্দোলনের সফল পরিণতির নাম। বিশ্বের বড় বড় বিপ্লবের ইতিহাস ঘাটলে সে কথারই সত্যতা মেলে। এক্ষেত্রে আমরা ফরাসী বিপ্লব (১৭৮৯-১৭৯৯), রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব (১৯১৭) ইরানে ইসলামী বিপ্লব (১৯৭৯) এবং চীন বিপ্লব ( ১৯৪৯) সহ বিশ্বের বড় বড় বিপ্লবের কথা উল্লেখ করতে পারি; যেসব বিপ্লবের মাধ্যমে সনাতনী ধারার সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার খোল-নলচে পাল্টে দেয়া হয়েছিল। আর জুলাই বিপ্লবের পর আমরা তেমনটিই আশা করেছিলাম।

মূলত, বিপ্লব প্রতিনিয়ত বা প্রতিদিনই হয় না বরং তা কালে-ভদ্রেই হয়ে থাকে। জুলাই বিপ্লবের জন্য আমাদেরকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এজন্য ত্যাগও স্বীকার করতে হয়েছে বেশ। অবলীলায় হজম করতে হয়েছে হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, গুম, অপহরণ, গুপ্তহত্যা ও আয়না ঘরের বর্বরতাকে। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতে হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে। কথিত ক্রস ফায়ারের নামে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। এ বিষয়েও আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান মুখ ফসকে সবকিছু ফাঁস করে দিয়েছেন। বিরোধী আন্দোলন দমাতে সরকারি বাহিনীর গুলীবর্ষণ ও হামলায় লাখ লাখ মানুষ আহত হয়েছেন। এদের কেউ কেউ হাত, পা ও চোখ হারিয়ে স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও গায়েবী মামলা দিয়ে গ্রেফতার, কারা নির্যাতন এবং কথিত রিমান্ডের নামে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছে। এমনকি ভিটেমাটি ছাড়া করা হয়েছে অসংখ্য নেতাকর্মীকে। ধ্বংস করা হয়েছে দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। দলীয়করণ করা হয়েছে জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, শিক্ষা প্রশাসন ও বিচার বিভাগ সহ রাষ্ট্রের সকল অবকাঠামোকে। সাংবিধানিকভাবে বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশে ক্ষমতাসীনদের সাথে দ্বিমত পোষণ করাই ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এমনকি আওয়ামী লীগের মিত্র বৃহত প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে টু-শব্দ করার কোন সুযোগ ছিল না। ভারতীয় অধিপত্যবাদ বিরোধী পোস্ট দেয়ার কারণেই ছাত্রলীগের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে।

ফ্যাসিবাদীরা দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকেই তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বানিয়েছিল। সে ধারাবাহিকতায় তারা দেশ বরণ্যে আলেম ও ইসলামী ব্যক্তিত্বদের মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় জড়িয়ে কথিত বিচারের নামে প্রহসন করে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল। মূলত, আওয়ামী ফ্যাসিবাদীরা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বোধ-বিশ্বাস, আবেগ-অনুভূতি, তাহজিব-তমুদ্দন নিয়ে নানা ধরনের তামাশার আশ্রয় নিয়েছে। এমনকি ভিন্নমত দমনের জন্য ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধকে রীতিমত আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। এভাবেই চালানো হয় প্রায় ১৬ বছরের দীর্ঘ পরিসরে অপশাসন ও দুঃশাসন। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম প্রতিশোধে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে তাদেরকে লজ্জাজনকভাবে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। অনেক কিছু করেও চিরস্থায়ী করা সম্ভব হয়নি আবু হোসেনের নবাবী। অত্যাচারীদের তখতে তাউস তাসের ঘরের মত ভেঙে-চুরে খান খান হয়ে গেছে।

‘বিপ্লব’ একটি বহুল অর্থবোধক তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ। এটি হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে একটি মৌলিক সামাজিক পরিবর্তন, যা তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত সময়ে ঘটে; যখন জনগণ চলমান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জেগে উঠে। অবশ্য দার্শনিক এরিস্টটল দু’ধরনের রাজনৈতিক বিপ্লবের বর্ণনা দিয়েছেন। এক সংবিধান থেকে অন্য সংবিধানে পূর্ণাঙ্গ পরিবর্তন এবং একটি বিরাজমান সংবিধানের সংস্কার। বস্তুত, বিপ্লবের পথ সংকীর্ণ নয় বরং খুবই বিস্তৃত। বিপ্লব মানব ইতিহাস জুড়ে ঘটেছে এবং পদ্ধতি, স্থায়ীত্ব এবং প্রেরণাদায়ী মতাদর্শ হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছে। ফলে সংস্কৃতি, অর্থনীতি, এবং সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহে বিশাল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

অধিকাংশ সময়, ‘বিপ্লব’ শব্দটি সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহে একটি পরিবর্তন সূচিত করা বোঝায়। অবশ্য কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস সামাজিক সম্পর্কসমূহের গুণগত পরিবর্তনকেই বিপ্লব আখ্যা দিয়েছেন। তারা দেখিয়েছেন, ইতিহাস মূলগতভাবে গতিময় এবং এ গতিময়তার উৎস হলো সমাজের বিভিন্ন সম্পর্কের, বিশেষত অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্রমাগত পরিবর্তন। সে ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার যুগপৎ বিপ্লব সফল হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা হারিয়ে দলীয় প্রধান সহ অধিকাংশ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। কেউ কেউ দেশেই আত্মগোপনে আছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। আবার অনেকেই এখন কারারুদ্ধ হয়ে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন, যা ইতিহাসের নির্মম ধারাবাহিকতা মাত্র।

নিবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, জুলাই বিপ্লব ছিল এক অনিবার্য বাস্তবতা। কারণ, পৃথিবীর কোন স্বৈরচারী বা ফ্যাসিবাদী শাসকের শান্তিপূর্ণ বা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে পারেনি বা তারা স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেয়নি বরং এজন্য গণঅভ্যুত্থান বা গণবিপ্লব আবশ্যক হয়ে পড়েছে। তাই দেশ ও জাতিকে ফ্যাসিবাদের জগদ্দল পাথর থেকে মুক্ত করতে জুলাই বিপ্লবের কোন বিকল্প ছিল না। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ও নির্মম প্রতিশোধে যা হবার তাই হয়েছে। অবসান ঘটেছে মাফিয়াতান্ত্রিক অপশাসন-দুঃশসনের। আশা করা হয়েছিল যে, স্বৈরাচার পরবর্তী ফ্যাসিবাদের রেখে যাওয়া ধ্বংসস্তুপের ওপর নতুন করে বিজয় কেতন ওড়ানোর জন্য জাতীয় ঐকমত্য হবে। সকল প্রকার রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও সংকীর্ণতা ভুলে দলমত, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হবেন। সে প্রত্যাশাকে সামনে রেখেই গত বছরের ৮ আগস্ট প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্ব একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।

নতুন সরকারের অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতিই ছিল রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার, আইনী ভিত্তি প্রদান সহ জুলাই সনদ প্রণয়ন, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান হওয়া সাপেক্ষে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। বিপ্লবোত্তর এসব বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম। হয়তো রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণেই দেশে নতুন করে স্বৈরশাসন ফিরে আসার পথ চিরতরে রুদ্ধ হবে। বিপ্লব পরবর্তী রাজনীতিকদের কথায় মনে হয়েছিল তারা নিজেরা যেমন দুর্নীতি ও অনিয়ম করবেন না, আর কাউকে প্রশ্রয়ও দেবেন না। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সকলেই শ্রদ্ধাশীল থাকবেন। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতির ওপর শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে নি জুলাই বিপ্লবের কোন কোন স্টেক হোল্ডার। ফলে পতিত আওয়ামী লীগের চাঁদার স্পটগুলোতে একদিন বা এক মুহূর্তের জন্য চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি বরং আরেকটা পক্ষ স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে চাঁদার হার আগের তুলনায় বেড়েছে।

আবার কাউকে কাউকে চাঁদাবাজির পক্ষে সাফাই গাইতেও শোনা গেছে। বিএনপি নেতা ও বর্ষীয়ান রাজনীতিক অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান তো মুখ ফসকে বলেই ফেলেছেন, ‘চাঁদা ছাড়া রাজনীতি করা সম্ভব নয়’। তিনি চাঁদাবাজির পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেছেন, রাজনীতিকের স্ত্রী অসুস্থ হলে তার চিকিৎসার জন্য চাঁদা আদায় করা অনৈতিক নয়। তাই তার কথার প্রত্যুত্তরে একথা বললে অত্যুক্তি হবার কথা নয় যে, যেসব রাজনীতিকের স্ত্রীর চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহের জন্য চাঁদাবাজির আবশ্যকতা দেখা দেয় তাদের বিয়েসাদী না করে বৈরাগ্যবাদ গ্রহণ করা শ্রেয়তর।

যাহোক, জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে দেশের চাঁদাবাজি বন্ধ হয়নি বরং বাজিকর পরিবর্তন হয়েছে। চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় চাঁদাবাজ কর্তৃক নির্মম নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা আমরা গণমাধ্যম সূত্রে জ্ঞাত হয়েছি। এমনকি আধুনিক প্রযুক্তি ও সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে তা আমরা প্রত্যক্ষও করেছি। পুরান ঢাকার মিটফোর্টে চাঁদাবাজরা একজন ব্যবসায়িকে পাথর মেরে হত্যা করার মত বিভৎস ঘটনাও দেখেছি। তা যা জুলাই বিপ্লবের অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে।

জুলাই বিপ্লবোত্তর সংস্কার, গণহত্যার বিচার ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছিল সব রাজনৈতিক দলের ঐক্যবদ্ধ স্লোগান। এ রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণেই রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ৬টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ম্যারাথন বৈঠকে মিলিত হয়ে একটা জাতীয় ঐক্যে পৌঁছার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শ্রেণি বিশেষের ক্ষমতা লিপ্সা ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণেই ঐকমত্য কমিশনগুলো খুব একটা সফল হয়নি। একশ্রেণির রাজনীতিক এক্ষেত্রে বেঁকে বসেছে। তারা কোন সংস্কার বা সংবিধান সংশোধনের বিরোধীতা করতে শুরু করেছেন। এমনকি তারা ’৭২-এর সংবিধানকে রীতিমত ঐশিগ্রন্থ মনে করা শুরু করেছেন। বিএনপির বর্ষীয়ান নেতা মীর্জা আব্বাস তো তার দল কোন সংস্কার মানবে না বরং অন্তর্বর্তী সরকার কোন সংস্কার চাপিয়ে দিলে তারা সরকারে আসার পর বাতিল করার ঘোষণা দিয়ে বসেছেন।

গত ৫ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক জুলাই ঘোষণা জাতির সামনে প্রকাশ করা হলেও সে ঘোষণা পত্রে অনেক অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যায়। মূলত, জুলাই ঘোষণা পত্র নিয়ে জুলাই বিপ্লবের স্টেক হোল্ডার সহ রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি বরং পক্ষ বিশেষ জুলাই বিপ্লবের চেতনাকে ভুলে দিয়ে সে সনাতনী বৃত্তের রাজনীতিতে ফেরার কসরত চালিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তারা যেনতেনভাবে একটা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে আগ্রহী। তাদের ধারণা একটা নির্বাচন হলেই তারা ক্ষমতাসীন হবেন এবং আওয়ামী স্টাইলে বিরোধী দলগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবেন। কিন্তু তারা বেমালুম ভুলে গেছেন যে, জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে দেশে চলমান রাজনীতির মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে। কেউ ইচ্ছা করলেই সে বৃত্তে পুরোপুরি ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, অনেক ত্যাগ ও কুরবানী রয়েছে এ বিপ্লবে। যে জাতি বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বিপ্লব সংঘঠিত করেছে; তারা তা ধরে রাখতেও সক্ষম। বিষয়টি উপলব্ধি করার মধ্যেই সংশ্লিষ্টদের কল্যাণ রয়েছে।

মূলত, বিপ্লব পরবর্তী সময়ে একটি পক্ষ নিজেদেরকে রাজা-মহারাজা ভাবতে শুরু করেছেন। তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জনপ্রশাসন সহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন যে, নিকট ভবিষ্যতে তারাই ক্ষমতাসীন হবেন এবং তাদের কথাই সকলকে মান্য করে চলতে হবে। একই সাথে অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির সাথে তারা কর্মচারীর মত আচরণ শুরু করে। বিভিন্ন সংস্কার কমিশনে তারা দাবি করে বসছেন যে, তারাই দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি। তাই তাদের কথার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আর এভাবেই তারা সকল সংস্কার কমিশনকে তাল পাতার সেপাই ও আমড়া কাঠের ঢেঁকি মনে করতেই পুলকবোধ করছেন। তারা সংবিধান সংশোধন ও গণভোটে আপত্তি তুলছেন বেশ জোরালোভাবেই। এমনকি তারা জামায়াত সহ অন্যান্য দলের নায্য দাবি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের ঘোরতর বিরোধীতা শুরু করেন। কিন্তু প্রবল জনমতের চাপে শেষ পর্যন্ত গণভোটে রাজী হলেও ভোট গ্রহণের দিন-তারিখ নিয়ে নতুন করে জট পাকিয়েছে। যা কোন দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলের কাজ নয়।

একান্ত বাধ্য হয়ে তারা গত ১৭ অক্টোবর জুলাই সনদ স্বাক্ষর করলেও তারা বিভিন্ন বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট তথা ভিন্নমত পোষণ করেছে। তারা ধরেই নিয়েছে যে, আগামী নির্বাচনে তারাই ক্ষমতাসীন হবেন এবং দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসাবে নিজেরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবেন। এ বদ্ধমূল ধারণা থেকেই তারা বিভিন্ন বিষয়ে প্রভাব খাটিয়ে চলছেন। তারা অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন। ‘রাজা রাজা’ ভাবই তাদের মধ্যে কাজ করছে। যার সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ডাকসু, জাকসু, চাকসু ও রাকসু নির্বাচনই তার প্রমাণ। এসব নির্বাচনের পর তাদের ভাবটা কিছুটা হলেও কমেছে। তবে জুলাই সনদ যাতে আইনী ভিত্তি না পায় সে কসরত তারা এখনও অব্যাহত রেখেছেন। ইতোমধ্যেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোটের রূপরেখা প্রধান উপদেষ্টার কাছে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু এতে সংশ্লিষ্টরা মোটেই সন্তষ্ট হতে পারেন নি বরং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দীন আহমদ বলেই ফেলেছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জাতীয় অনৈক্যের পথে হাঁটছে। অপর বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে তারা গণভোট মানবেন না। আর এ বিষয়ে কোন আলোচনারও সুযোগ নেই। বিএনপির দু’জন সিনিয়র নেতার বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয়েছে, তারা জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি বা সংবিধান সংশোধনের পক্ষপাতি নয়; তারা পুরনো বৃত্তেই আবদ্ধ থাকতে চান। যা তাদের জন্যই এক সময় আত্মঘাতি হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বোদ্ধামহল।

জুলাই বিপ্লবের পর মনে করা হয়েছিল যে, জাতীয় রাজনীতিতে একটি ইতিবাচক ধারা সূচিত হবে। কিন্তু একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতালিপ্সা, অদূরদর্শিতা ও অহমিকার কারণে সে আশায় গুড়ে বালি পড়তে শুরু করেছে। বিপ্লবোত্তর জাতীয় রাজনীতিতে যে ইতিবাচক ধারার আবহ সৃষ্টির যে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল, পক্ষ বিশেষের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণেই তা এখন রীতিমত হুমকির মুখে পড়েছে। ফলে আমাদের দেশের চলমান রাজনীতি রীতিমত গণমুখী চরিত্র হারাতে বসেছে।

বস্তুত, আর্ত-মানবতার কল্যাণের ধারণা থেকে রাজনীতি নামের সেবামূলক কাজের ব্যুৎপত্তি। রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতি বা রাজগতি বা রাজবুদ্ধি হলো দলীয় বা নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ক্ষমতার সম্পর্কের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিষয়ক কর্মকাণ্ডের সমষ্টি। রাজনীতিতে বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, যার মধ্যে আছে কারও নিজস্ব রাজনৈতিক অভিমত মানুষের মাঝে প্রচার করা, অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে মতবিনিময়, আইন প্রনয়ন, এবং বলপ্রয়োগের চর্চা করা, যার মধ্যে আছে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা লড়াই। আর রাজনৈতিক ব্যবস্থা হল কোন কাঠামো যা কোন সমাজের মধ্যকার গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক পদ্ধতিসমূহকে সংজ্ঞায়িত করে। রাজনৈতিক চিন্তার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় প্রাথমিক প্রাচীন যুগে, যেখানে প্লেটোর রিপাবলিক, এরিস্টটলের রাজনীতি, চাণক্যর অর্থশাস্ত্র ও চাণক্য নীতি (খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী) এবং কনফুসিয়াসের লেখার ন্যায় দিগন্ত উন্মোচনকারী কাজগুলো পাওয়া যায়। তবে উপসংহারে একথা বলা যায় যে, আর্ত-মানবতার কল্যাণের ধারণা থেকে রাজনীতির পথচলা শুরু হয়েছে। তবে কালের বিবর্তনে রাজনীতির কক্ষচ্যুতি ঘটেছে। ফলে রাজনীতি এখন শ্রেণি বিশেষের আত্মস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, শ্রেণিস্বার্থ, ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের মোক্ষম অনুসঙ্গে পরিণত হয়েছে। ফলে রাজনীতিতে থেকে সুবিচার, যৌক্তিকতা ও নৈতিকতা গৌণ হয়ে এখন ক্ষমতায় মুখ্য হয়ে উঠেছে। ফলে আমাদের দেশ ও জাতিস্বত্তাই এখন হুমকীর মুখোমুখি। এ বিষয়ে চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.) বক্তব্য হলো, ‘রাজ্যের পতন হয় দেশ হতে সুবিচার উঠে গেলে, কারণ সুবিচারে রাজ্য স্থায়ী হয়’।

সার্বিক দিক বিবেচনায় দেশ এক মহাক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এ অবস্থায় আমাদের দেশের রাজনীতিবিদের অভাব নেই, বরং রাষ্ট্রনায়কোচিত ব্যক্তির অভাব জোরালোভাবেই অনুভূত হচ্ছে। দার্শনিক জেমস ফ্রিম্যান ক্লার্কের ভাষায়, ‘একজন রাজনীতিবিদ হলেন তিনি, যিনি পরবর্তী নির্বাচনের কথা ভাবেন, একজন রাষ্ট্রনায়ক হলেন তিনি, যিনি পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভাবেন।’ বিষয়টি আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবেন ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল, যা জুলাই-বিপ্লবোত্তর রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ।