জসিম উদ্দিন মনছুরি

স্বৈরাচার ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের আমলে বহু সাংবাদিক নির্যাতিত হয়েছেন এবং বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম। বন্ধ হওয়া গণমাধ্যমের মধ্যে দৈনিক আমার দেশ, চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি। হস্তক্ষেপ করা হয়েছে স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর। সত্য প্রকাশের জন্য অনেক সাংবাদিককে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। মামলা, হামলা ও জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে সত্যবাদী সাংবাদিকদের নির্মমভাবে কণ্ঠরোধ করা হয়েছে। শত শত মিথ্যা মামলা দিয়ে সাংবাদিকদের ওপর জুলুমের স্টিম রুলার চালানো হয়েছে। নির্বাসিত জীবনযাপন করতে হয়েছে সাহসী সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান ও শফিক রেহমানের মতো দুঃসাহসী সাংবাদিকদের। এমনকি আমেরিকায় অবস্থানকারী শেখ হাসিনা পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যাচেষ্টা মামলায় সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান ও শফিক রেহমানকে আসামি করা হয়। মিথ্যা মামলায় তাদের সাজাও দেয়া হয়েছিল। মাহমুদুর রহমানকে আটক করে রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার করা হয়েছে। আবুল আসাদকে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অফিসে ঢুকে টেনে-হিঁচড়ে হেনস্তা করে পুলিশে দিয়েছে, তাকেও জেল খাটতে হয়েছে। রুহুল আমীন গাজীকে হাতে দড়ি বেঁধে জেলে নেয়া হয়েছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শনাক্তই করা হয়নি। ফটোসাংবাদিক কাজলকে দীর্ঘদিন গুম করে রাখা হয়েছে, দৈনিক ইনকিলাবের রবিউল্লাহ্ রবি, রফিক মোহাম্মদ, আহমেদ আতিক ও আফজাল বারীকে গ্রেপ্তার এবং পত্রিকার অফিস ও প্রেস সিলগালা করে দেয়া হয়। প্রথম আলোর রোজিনা ইসলামকে আটক করা হয়। সাংবাদিক কনক সরোয়ারকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে। খুলনার সাংবাদিক মুনীর উদ্দীন আহমেদ এবং কক্সবাজারের সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফাকে সীমাহীন নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে। বিশাল তালিকার এ এক ভগ্নাংশ মাত্র।

১৫ বছরে এতো সাংবাদিক নিগ্রহ ও মিডিয়ার কণ্ঠরোধের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার হয়েছিলেন তারা চরমভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। হাসিনা রেজিমকে ম্যাস মার্ডারে উসকানি দেয়া এবং বিপুলভাবে অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়া কিছু সাংবাদিক নেতার কারণে প্রচার বা প্রকাশ হয়নি অনেক কিছু। মানবাধিকার রক্ষায় যারা মারাত্মক সোচ্চার তারা কি সেদিন টুঁ-শব্দটিও করেছিল? নাকি সোল্লাসে হাসিনাকে এসব নিবর্তনে মদদ যুগিয়ে গেছে? দেশ স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের আমলে অলিখিত কারাগারে পরিণত হয়েছিল। হত্যা, গুম, অপহরণ ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে যে সাংবাদিকরা কলম ধরেছে তাদের হতে হয়েছে চরম নির্যাতনের শিকার। কুষ্টিয়ায় আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশের উপস্থিতিতে মেরে রক্তাক্ত করা হয় আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে।

কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইয়াসির আরাফাত তুষারের করা একটি মানহানি মামলায় জামিন নিতে গিয়েছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পর্কে মাহমুদুর রহমানের দেয়া একটি বক্তব্যে মানহানি হয়েছে মর্মে মামলাসহ সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রায় ১২৫টি মামলা করা হয়েছিল বলে জানা যায়। এসব মামলায় জামিন নিতে এবং হাজিরা দিতে তাকে দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চষে বেড়াতে হয়েছে। মামলার অভিযোগের সত্যাসত্য, বস্তুনিষ্ঠতা বা বিচারের রায় যাই হোক, একজন মানুষকে শত শত মামলায় হাজিরা দিতে হলে এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে হলে তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও পেশাগত জীবনের কাজ করার আর কোনো সুযোগ থাকে না। মাহমুদুর রহমানসহ বিএনপি ও জামায়াতের শত শত নেতাকর্মীর ক্ষেত্রে এমনটিই ঘটছে।

মাহমুদুর রহমান গতানুগতিক ধারার রাজনৈতিক নেতা নন। তিনি বুয়েট থেকে পাস করা একজন ইঞ্জিনিয়ার, সে সাথে সফল ব্যবসায়ী এবং বিএনপি শাসনামলে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। পরবর্তিতে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা নির্বাচিত হওয়ায় তিনি বিএনপি সমর্থক রাজনীতিক বলে গণ্য হতে পারেন। তবে গতানুগতিক রাজনৈতিক তৎপরতা ও ক্ষমতা ভোগ তার ধাঁতে নেই। তিনি তার মেধা ও কলমকে একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পক্ষে পরিচালিত করতে চাইছেন। বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইসলামের ইতিবাচক প্রভাব এবং তার মতে দাসত্বের শৃঙ্খল ভাঙার লক্ষ্যে বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে একটি ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক চেতনা ও জনমত গড়ে তোলা তার কলম যুদ্ধের মূল প্রতিপাদ্য। গ্রেপ্তার এড়াতে মাহমুদুর রহমান মাসাধিককাল ধরে কারওয়ান বাজারে আমার দেশ অফিসে সহকর্মী সাংবাদিকদের নিয়ে অবস্থান করছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাকে গ্রেপ্তার ও কারাবরণ করতে হয়েছিল।

মাহমুদুর রহমানের গ্রেপ্তার এবং আদালতে নিজের আইনজীবী নিয়োগ না করে আত্মপক্ষ সমর্থন, যুক্তি উপস্থাপন এবং প্রতিপক্ষের যুক্তিখণ্ডনের পাশাপাশি আদালতের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন তুলে জামিন না চাওয়ার মধ্য দিয়ে অত্যন্ত দৃঢ় মনোবল ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। মাহমুদুর রহমান ও তার সমর্থকদের দাবি অনুসারে বিনা অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার ও বিচারিক হয়রানির মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছিলো। মাহমুদুর রহমান কখনো ভোটের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন না। সরকারের বিরুদ্ধে তার সাহসী ও ক্ষুরধার লেখনী পাঠকপ্রিয়তা ও প্রচার সংখ্যায় আমার দেশ পত্রিকার জনপ্রিয়তা সরকারের পক্ষ থেকে তার বিপদের মূল কারণ বলে মনে করেন তার সমর্থকরা। একজন সম্মানীয় পেশাজীবী, সিনিয়র সিটিজেন, সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা এবং বহুল প্রচারিত একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক হওয়ার দীর্ঘ সময়ে মাহমুদুর রহমান কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, ব্যাংকে ঋণখেলাফের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন কিংবা লুটপাট-দখলবাজির মতো কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি। এমনকি বিএনপি ও জোটের ভুল রাজনীতি এবং দলীয় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধেও তাঁকে কলম ধরতে দেখা গেছে। দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদকে দিনের পর দিন রিমান্ড নিয়ে ও জেলে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। কথিত যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া কাদের মোল্লাকে ‘শহীদ’ লেখায় রাষ্ট্রদ্রোহ ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদকে এ নির্যাতনের শিকার হতে হয়। অসুস্থ ও বয়োবৃদ্ধ এ সাংবাদিককে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা টেনে-হিঁচড়ে চরমভাবে অপদস্ত করে নির্যাতন চালিয়েছিল।

কথিত একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর ফাঁসি কার্যকর করা হয় কুখ্যাত কসাই কাদেরের অভিযোগ আনা হয় শহীদ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে। সে দিনের স্মরণে দৈনিক সংগ্রামের প্রথম পাতায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘শহীদ আবদুল কাদের মোল্লার ষষ্ঠ শাহাদাত বার্ষিকী আজ’। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ সমাবেশ করে সংগ্রামের কয়েকটি কপি পোড়ান ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। বিকালে দৈনিক সংগ্রামের কার্যালয় ঘেরাও ও ভাঙচুর করে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। দৈনিক সংগ্রামের কার্যালয়টি জামায়াত-শিবিরের অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে অভিযোগ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পত্রিকাটির ‘ডিক্লারেশন’ বাতিলের দাবি জানানো হয় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে। ওই ঘটনার পর সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদকে রাতেই হাতিরঝিল থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোহাম্মদ আফজাল ওই থানায় মামলা দায়ের করেন। দণ্ডবিধির রাষ্ট্রদ্রোহের ধারা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা এ মামলায় সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদ ছাড়াও প্রধান প্রতিবেদক বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, এবং বার্তা সম্পাদক সাদাত হোসেনের নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়া অজ্ঞাত পরিচয় আরও ৬-৭ জনকে আসামি করা হয় এজাহারে।

এভাবে বহু সাংবাদিক ও পত্রিকার বিরুদ্ধে কঠোর নজরদারি ছিল আওয়ামী সরকারের। যারাই আওয়ামী দুঃশাসনের চিত্র তুলে ধরেছেন তাদেরই জেল-জুলুমসহ চরম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের জনপ্রিয় গণমাধ্যম আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি, চ্যানেল ওয়ানের মতো জনপ্রিয় গণমাধ্যমগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর জনগণের প্রত্যাশা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ফিরে আসুক। স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার ফিরে পাক জনগণ ও সত্য উদঘাটনী সাংবাদিকরা। আর কখনো যেন এভাবে তার শিকার হতে না হয় সাংবাদিকদের। বন্ধ যেন না হয় আর কোনো গণমাধ্যম।

লেখক : প্রাবন্ধিক