কলাম
মব জাস্টিস কাক্সিক্ষত নয়
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে সহিংস ও রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট ২০২৪ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের দুঃশাসন আর নিষ্ঠুর নিপীড়নের হাত থেকে মানুষ মুক্তি পায়। মুক্তি পায় গণতন্ত্র। পরাজিত হয় স্বৈরতন্ত্র।
Printed Edition
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে সহিংস ও রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট ২০২৪ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের দুঃশাসন আর নিষ্ঠুর নিপীড়নের হাত থেকে মানুষ মুক্তি পায়। মুক্তি পায় গণতন্ত্র। পরাজিত হয় স্বৈরতন্ত্র। কিন্তু দিন কয়েকের ব্যবধানে আবার ফ্যাসিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠার পাঁয়তারা করে। তারপরও কারও কারও কাছে যখন শুনি ওরা নাকি আমাদের বন্ধু তখন কিছুতেই হিসেব মিলাতে পারি না। কারণ একটি স্বাধীন দেশের হাজারো মানুষের খুনি কিভাবে প্রতিবেশী দেশে নিরাপদ আশ্রয় পায় তা বোধগম্য নয়। অথচ সেখান থেকে তিনি প্রতিনিয়ত হুমকি-ধামকি দিয়ে যাচ্ছেন। শুধু কী তাই! ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বিজয়কে কলঙ্কিত করার জন্য দলটির নেতা কর্মীদের উসকে দিতে কুন্ঠাবোধ করছে না। হেন কাজ নেই যা তারা করেনি। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে ষড়যন্ত্রের নীল নকশা বাস্তবায়নে উঠে পড়ে লেগেছে। কখনো আনসার, কখনো বিদ্যুৎ কর্মী, কখনো রিকশাচালক, কখনো গার্মেন্টস কর্মী সেজে দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়ার পাঁয়তারা করছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার তাদের যড়যন্ত্রকে ছিন্নভিন্ন করে দেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছে, যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির অবনতি সরকারের ভাব-মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করছে, যা দুঃখজনক। পতিত ফ্যাসিস্টের দোসরা এখনো প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘাপটি মেরে বসে আছে। ফলে গণঅভ্যুত্থানের ৭ মাস পেরিয়ে গেলেও ধর্ষণ, খুন, হত্যা কিংবা মব জাস্টিস বন্ধ হয়নি!
গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক বিদায় নেওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো হতে একটু সময় লাগে! তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু ইদানিং মব জাস্টিসের নামে যা হচ্ছে তা দুঃখজনক। মব জাস্টিসের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে আওয়ামী শাসনামলে সবেচেয়ে বেশি মব জাস্টিসের শিকার হয়েছে মানুষ। আমরা প্রত্যেকটি ঘটনার সুষ্ঠু বিচার প্রত্যাশা করি। মব (mob) অর্থ উত্তাল জনতা বা উচ্ছৃঙ্খল জনতা। জাস্টিস (Jutice) অর্থ বিচার বা ন্যায়বিচার। মব জাস্টিস অর্থ উত্তাল জনতা বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার বিচার। অর্থাৎ একদল উচ্ছৃঙ্খল জনগণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা আদালতের তোয়াক্কা না করে অপরাধীর শাস্তি নিজেই বিচারক বনে যান। অথচ দেশে প্রচলিত আইন ও শাস্তির বিধান রয়েছে। এভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া অপরাধ; তা জেনেও অতি উৎসাহী কিছু মানুষ আইন হাতে তুলে নিচ্ছে যা রীতিমত উদ্বেগের বিষয়! এ বিষয়টি খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের ১৫-১৬ বছরের জুলুম, নিপীড়ন, গুম, খুন, হত্যা ও আয়নাঘরের বিরুদ্ধে মানুষের মনে যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল তার বহিঃপ্রকাশ এ মব জাস্টিস। নৈরাজ্য সৃষ্টিতে যে আওয়ামী লীগ জড়িত তা যুগান্তরের শিরোনাম দেখলেই বুঝা যায়। ১১ মার্চ, যুগান্তর পত্রিকার শিরোনাম ‘‘বেশির ভাগ ছিনতাই ডাকাতি পরিকল্পিত নিষিদ্ধ ছাত্রলীগই মাস্টারমাইন্ড’’। ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও ডাকাতির মতো অপরাধ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যাওয়ার পেছনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ অনেকাংশে দায়ী (সূত্র : ১১ মার্চ, যুগান্তর, ২০২৫) তারপর ও বলব দেশের প্রত্যেকটি মানুষের জানমাল রক্ষা করা ও পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া সরকারের দায়িত্ব। প্রসঙ্গক্রমে হযরত ওমর (রা.) সেই বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে গেল- তিনি জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেছিলেন-‘‘আমার শাসনামলে যদি ফোরাত নদীর তীরে একটি কুকুর না খেয়ে মারা যায় তাহলে ওমর সেজন্য দায়ী থাকবে।’’ সুতরাং রাষ্ট্র নায়কদের হৃদয়ে যদি হযরত ওমর (রা.) মতোই অনুভূতি জাগ্রত হয় তাহলে নিঃসন্দেহে দেশে শান্তির সুবাতাস পাল তুলবে।
ইদানীং কিছু মানুষের পৈশাচিকতা আর বর্বরতা আইয়ামে জাহেলিয়াতের কথাই বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে; মাগুরা শহরে বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে ৮ বছরের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হলেন। আরেকটি খবর দেখলাম-মাদারীপুরে বালুর ব্যবসা ও হাট ইজারা নিয়ে বিরোধের জেরে তিন ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে (সূত্র: প্রথম আলো- ০৯ মার্চ, ২০২৫) চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় তো আরও ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে-সালিশের জন্য ডেকে নিয়ে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে ‘মব জাস্টিস) তৈরি করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দুই কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চন ইউনিয়নের সেক্রেটারি জায়েদ হোছেন প্রথম আলোকে বলেন, নিহত ব্যক্তিরা জামায়াতের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। একটি সালিস বৈঠকের কথা বলে তাঁদের এওচিয়া এলাকায় ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত দুজনের মাথায় পর্যায়ক্রমে আঘাত করা হয়। (সূত্র : প্রথম আলো, ০৪ মার্চ,২০২৫) তার আগে ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে উত্তরায় ছিনতাইকারী সন্দেহে দুজনকে পিটিয়ে পায়ে দড়ি বেঁধে উল্টো করে বিএনএস সেন্টারের সামনে ফুটওভারব্রিজের রেলিংয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এসব ঘটনা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়! সুতরা জরুরি ভিত্তিতে এসব মব জাস্টিস বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
গণপিটুনি দিয়ে মানুষ হত্যা ডাল ভাতের মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে কিংবা আদালত প্রাঙ্গণে মানুষ গণপিটুনির শিকার হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে একশ্রেণীর অতি উৎসাহী কিছু মানুষ চলতি পথে ধর ধর, মার মার চিৎকারের আওয়াজ শুনলেই হুমড়ি খেয়ে চড়াও হয়। শুরু হয় চড়-কিল-ঘুসির নিষ্ঠুরতা, সবাই মারছে, তাই সেও মারছে। কিন্তু একবারও ভাবে না আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়াও অপরাধ। রাজনৈতিক সংঘাত সহিংসতা না থাকলেও ‘‘মব জাস্টিস’’ এর নামে যখন তখন কাউকে না কাউকে গণপিটুনি দেওয়া হচ্ছে, কারও কারও বাড়ি-ঘর লুটপাট করা হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে আসামীকে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে, কাউকে জুতার মালা পরিয়ে কিংবা গাছে সঙ্গে বেঁধে বিচার করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও এ ধরনের বেদানাদায়ক ঘটনা ঘটছে। অথচ ইহাও ফৌজদারী অপরাধ। ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ৩৪ ধারায় সাধারণ অভিপ্রায় সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে যৌথ দায়িত্বশীলতার নীতি অনুসারে কতিপয় ব্যক্তি অভিন্ন অভিপ্রায় নিয়ে অপরাধ করলেও তাদের প্রত্যেকে একইভাবে দায়ী করে শাস্তির কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ৩৪ ধারা অনুযায়ী গণপিটুনিতে অংশ নেওয়া সকল ব্যক্তি সমানভাবে দায়ী। যদি কোন অপরাধী মারা যায় তার জন্য সবাইকে সমানভাবে দায়ী করা যাবে।
পৃথিবীর কোনো সভ্য জগতের মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেয় না। অথচ আমাদের দেশে আইন হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা বেশি। ফলে একের পর এক গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। ২০১১ সালের জুলাই মাসে ঢাকার আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামে শবেবরাতের রাতে ডাকাত সন্দেহে ৬ ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এ নিষ্ঠুর ঘটনার মামলায় ২ ডিসেম্বর ২০২১ সালে ঢাকা জেলার দ্বিতীয় অতিরিক্ত দায়রা জজ ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৫ জনকে খালাস প্রদান করে রায় ঘোষণা করেন। (সূত্র : ২ ডিসেম্বর, ২০২১ প্রথম আলো)।
গণপিটুনির একটি পরিসংখ্যান দৈনিক আমার দেশ তুলে ধরেছে। তার হুবহু অংশ পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো - ‘‘আমার দেশের ভাষ্যনুসারে দেশে ২০১৫ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে ১০০৯টি গণপিটুনির ঘটনায় কমপক্ষে ৭৯২ জন নিহত এবং ৭৬৫ জন আহত হয়েছেন। বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এ তথ্য জানায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও নিজস্ব সংগ্রহীত তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এইচআরএসএস জানায়, অন্তর্ববর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত ৭ মাসে গণপিটুনিতে অন্তত ১১৪টি ঘটনায় নিহত ১১৯ জন এবং ৭৪ জন আহত হয়েছেন। গত ১০ বছরের মধ্যে ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান ছিল সবচেয়ে ভীতিকর। গত বছরে অর্থাৎ ২০২৪ সালে গণপিটুনিতে অন্তত ২০১টি ঘটনায় ১৭৯ জন নিহত এবং ৮৮ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ২০২৫ সালের প্রথম ২ মাসে গণপিটুনিতে অন্তত ৩০টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৯ জন এবং আহত হয়েছেন ২০ জন। সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী ২০১৫ সালে ৮৯ ঘটনায় ১২৮ জন আহত এবং ৯৫ জন নিহত হয়েছেন। ২০১৬ সালে ১১১ ঘটনায় ১০৪ জন আহত ৪১ জন নিহত হয়েছেন। ২০১৭ সালে ৮৫ ঘটনায় ৬৫ জন আহত এবং ৮৫ জন নিহত হয়েছেন। ২০১৮ সালে ৭৪ ঘটনায় ৪৪ জন আহত এবং ৬৪ জন নিহত হয়েছেন। ২০১৯ সালে ১০৩ জন নিহত, ২০২০ সালে ৩০ জন নিহত, ২০২১ সালে ৮৫ জন নিহত, ২০২২ সালে ৮৩ জন নিহত, ২০২৩ সালে ৯১ জন নিহত হয়েছেন।’’ (সূত্র ০৫ মার্চ দৈনিক আমার দেশ)
মানুষ পিটিয়ে হত্যা করার সংস্কৃতি বেশ পুরানো। ২০০৬ সালের ২৮ শে অক্টোবরে রাজধানীর পলন্টন ময়দানে রাজনৈতিক বিরোধীতার কারণে আওয়ামী গুণ্ডাবাহিনী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিরীহ নেতা কর্মীদের ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। প্রকাশ্যে দিন দুপুরে মানুষ হত্যার উৎসব পালন করেছিল। এমনকি লাশের ওপর উঠে নৃত্য পর্যন্ত করেছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত শহীদের স্বজনেরা সুষ্ঠু বিচার পায়নি। প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের বিচার যদি সুষ্ঠুভাবে করা যেত তাহলে ‘‘মব জাস্টিস’’ এর নামে এভাবে মানুষের জীবন বিপন্ন হতো না।
পৃথিবীর কোন দেশই শতভাগ অপরাধমুক্ত নয়! প্রত্যেকটি দেশে কম-বেশি অপরাধ আছে। কোথাও কম আবার কোথাও বেশি। উন্নয়নশীল, স্বল্পোন্নত কিংবা অনুন্নত সকল দেশে তা প্রতিরোধে রাষ্ট্রকেই কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হয়, বিধায় রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমকে গতিশীল রাখতে সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আমাদেরও একটি সংবিধান আছে। সংবিধানের ২৭,৩১,৩৩,৩৫ অনুচ্ছেদের ভাষ্যমতে রাষ্ট্রের সব নাগরিক আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না ও অপরাধের জন্য যতটুকু শাস্তি প্রাপ্য তার চেয়ে বেশি ভিন্ন কোনো শাস্তি দেওয়া যাবে না। সুতরাং আমরা মনে করি ‘মব জাস্টিস’ প্রতিরোধে সরকার, সংশ্লিষ্ট আইনপ্রয়োগকারী বাহিনী, মসজিদের সম্মানিত খতিবগণ, ইমামগণ, সামাজিক গণমান্য ব্যক্তিবর্গ, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ব্যক্তিগণ এগিয়ে আসলে জাতি এ ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে পারে।