পৃথিবীতে যত দেশ উন্নয়নের উচ্চ শিখরে পৌঁছেছে সেসব দেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- দেশের উন্নয়নে যত না জনগণের অবদান, তার চাইতে বেশি অবদান একজন নির্মোহ শাসকের। একজন সৎ, যোগ্য, আমানতদার শাসক ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশকেও উন্নয়নের স্বপ্নীল ছোঁয়ায় যেমন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন, তেমনিভাবে জাতির ভাগ্যের পরিবর্তনও করে দিতে পারেন। আবার স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট শাসক উন্নয়নের নামে লুটপাট আর অর্থ পাচার করে পুরো দেশকে দেউলিয়ায় পরিণত করতে পারেন। শাসক নির্বাচনের ক্ষেত্রে যদি জনগণ ভুল করে তাহলে তার খেসারত পুরো জাতিকে দিতে হয়। যার দৃষ্টান্ত ভূরিভূরি আছে। এ নিবন্ধে দু’জন শাসকের কথা উল্লেখ করবো যারা নিজ উদ্যোগে ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশকে উন্নয়নের স্বপ্নীল ছোঁয়ায় ভাসিয়েছেন। তাদের একজন সিঙ্গাপুরের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান এবং মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মুহাম্মদ।

সিঙ্গাপুর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ। এর আয়তন মাত্র ৭১৬ বর্গ কিলোমিটার। আজ থেকে প্রায় ৬২ বছর আগে সিঙ্গাপুরের অবস্থা আজকের মত এতো উন্নত এতো আধুনিকতার ছোঁয়ায় ভরপুর ছিল না; বরং তাদের জীবন অপরাধ আর দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত ছিল। দেশটির অধিকাংশ মানুষের পেশা ছিল ফিশিং। ১৯৬৩ সালের ৩১ আগস্ট বৃটিশরা সিঙ্গাপুরকে স্বাধীনতা দেয়। ১৯৬৩ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ার সাথে যোগ দেয় এবং মালয়েশিয়ার অংশ হয়ে যায়। কিন্তু সিঙ্গাপুরে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। তারপরও দেশটির জনগণ মালয়েশিয়ার সাথে একসাথে থাকতে চায়। কারণ মালয়েশিয়ার আয় সিঙ্গাপুরের চেয়ে বেশি ছিল। সে সময় টেংকু আব্দুর রহমান ছিলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। তিনি পড়েন মহাবিপদে। দু’দেশকে এক সাথে চালাতে পারলেন না। অবশেষে টেংকু আব্দুর রহমান মালয়েশিয়া থেকে সিঙ্গাপুরকে আলাদা করে দেন। কিন্তু সিঙ্গাপুরের জনগণ বিচ্ছিন্ন হতে চায়নি। পৃথিবীতে একমাত্র দেশ সিঙ্গাপুর যারা স্বাধীন হতে চায়নি। এটাও একটা ইতিহাস। ১৯৬৫ সালের ৬ আগস্ট সিঙ্গাপুরকে যখন আলাদা করে দেয়া হয় তখন দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লি কুয়ানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু তার চোখে মুখে হাহাকার। এত দারিদ্র্য, এত বেকার, এত অশিক্ষিত জনগণকে তিনি কিভাবে গড়ে তুলবেন, সে চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলেন। কারণ ৭১৬ বর্গ কিলোমিটারের দেশ সিঙ্গাপুরের বেশির ভাগ লোকই বেকার ছিল। মাছ ধরে কোন রকমে জীবন-সংসার চালাতো। আমাদের দেশের মতো এত প্রাকৃতিক সম্পদ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করার ব্যবসা ছিল না। চারদিকে শুধু হাহাকার হাওয়ায় ভাসছে। তারপরও সিঙ্গাপুর শূন্য থেকে উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল শুধুমাত্র একজন নির্লোভ যোগ্য শাসক পাওয়ার বদলৌতে। দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর লি কুয়ান তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘‘আমাদের বেঁচে থাকার অভাবনীয় সুযোগের সঙ্গে তীব্র প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চল ছাড়া একটি দ্বীপের উত্তরাধিকারী হয়েছি আমরা, যা দেহছাড়া হৃদয়ের মতো।’’ লি কুয়ান দেশের দায়িত্বভার গ্রহণের পর সিঙ্গাপুরকে আন্তর্জাতিক রাজধানীতে পরিণত করেন। এশিয়ার সবচেয়ে নিরাপদ ও স্থিতিশীল রাষ্ট্রে সিঙ্গাপুরকে পরিণত করেন। জনশক্তির ঘাটতি পূরণ করতে বিদেশী শ্রমিক নিয়োগ দেন। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের তকমা তার বিরুদ্ধে থাকলেও উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে তিনি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হন। লি কুয়ান সিঙ্গাপুরকে বিশ্ববাণিজ্য ও অর্থনীতির কেন্দ্রস্থলে রূপান্তরিত করেন। ২০০৯ সালের অক্টোবরে হোয়াইট হাউসে লি কুয়ানের সঙ্গে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বৈঠক হয়। বৈঠকের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট লি কুয়ানকে এশিয়ার বিশ ও একুশ শতকের কিংবদন্তি নেতাদের একজন বলে উল্লেখ করেন। লি কুয়ান মূলত একজন দেশপ্রেমিক শাসক ছিলেন। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরের গড় আয় ১০০ গুণ বাড়ানোর পথ আবিষ্কার করেন। ক্ষমতার চেয়ারে বসে অর্থ পাচার, লুটপাট কিংবা আয়নাঘর তৈরি করেননি; বরং জনগণের ভাগ্যের উন্নয়নে কাজ করেছেন। দেশে সৎ যোগ্য মেধাবী মানুষ বাছাই করেছেন। তাদেরকে দেশের জন্য কাজে লাগিয়েছেন। ফলে সিঙ্গাপুর দারিদ্রের অভিশাপ থেকে ধীরে ধীরে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়।

লি কুয়ান মানুষের শিক্ষা দীক্ষার চাইতে সততাকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। এককথায় সিঙ্গাপুরের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে তিনি সততার বীজ রোপণ করেছেন। আইনের কঠোর প্রয়োগ সেখানে কার্যকর থাকায় নারীরা নিরাপদে চলাচল করে। নারীদের নিরাপদ চলাচল যে কাউকে মুগ্ধ করবে। ২৪ ঘন্টা সাদা পোশাকে পুলিশ ঘুরে বেড়ায়। একজন নারী মধ্য রাতেও কোন পুরুষ সঙ্গী ছাড়া একাকী ফাঁকা রাস্তায় চলাচল করতে পারে। কোন নারীর দিকে যদি কোন পুরুষ অশোভন দৃষ্টিতে তাকায় তবে সে নারী পুলিশকে রিপোর্ট করতে পারে। সেখানে আইনের শাসন থাকায় কোন পুরুষ দ্বিতীয় বার কোন নারীর দিকে তাকাতেও ভয় পায়। সেখানে ময়লা ফেলার জন্যও আইন আছে। যেখানে-সেখানে থুথু ফেলা বা ময়লা ফেলাও একটি অপরাধ। কেউ ময়লা ফেললে শাস্তি হচ্ছে পুরো একটি দিন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ঝাঁড়ু দিতে হবে। নাগরিক সুযোগ সুবিধা বলতে যা বুঝায় সবই সেখানে আছে। ২৪ ঘন্টা বিদ্যুৎ পানির ব্যবস্থা আছে। চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই উন্নত। শিক্ষার মানও উন্নত। বেকারের সংখ্যা নেই বললেই চলে। সবাই কাজ করে। সৎ যোগ্য শাসক হলে যে কোন দেশ উন্নয়নের উচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারে তার উদাহারণ সিঙ্গাপুর।

মালয়েশিয়ার নাম উচ্চারণ করলে স্মৃতির মানসপটে প্রথমে যার নাম ভেসে ওঠে তিনি আর কেউ নন, আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি ও রূপকার মাহাথির মোহাম্মদ। মূলত তার হাত ধরেই ১৯৮০ সালের দিকে দারিদ্রপীড়িত মালয়েশিয়ার শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে আবির্ভাব ঘটে। শুধু দারিদ্রপীড়িত ছিল তা কিন্তু নয়; নিরক্ষরতা আর পশ্চাদমুখিতার কারণে দেশটির অর্থনীতির অবস্থাও ছিল ভঙ্গুর। কিন্তু মাহাথির মোহাম্মদের নীতি আদর্শ ও দেশ পরিচালনার জাদুস্পর্শী উন্নয়ন তাকে নন্দিত করেছে। স্বাধীনতার সময় মালয়েশিয়ায় বেকারের সংখ্যা বেশী থাকলেও মাত্র দু’দশকে দেশটি বেকারত্ব ঘুচিয়ে কল্যাণমুখী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। নিজ দেশের বেকারের সংখ্যা শুধু কমায়নি; বরং অন্যান্য দেশের লাখ লাখ কর্মী নিয়োগ দেয়। মাহাথির যখন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বভার গ্রহণ করেন সেদিন দেশটি বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র রাষ্ট্র হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত ছিল। তখন দেশটির মাথাপিছু আয় ১৩০ ডলার ছিল। জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করত। সে সময় দেশটির মুদ্রাস্ফীতির হার প্রায় ২৫ শতাংশ ছিল। শিক্ষিতের হার ২০ শতাংশ ছিল। অথচ মাহাথির মোহাম্মদ যেদিন ক্ষমতা ছাড়েন সেদিন দেশটির মাথাপিছু আয় প্রায় ৩ হাজার ৩৩০ ডলার ছিল। শিক্ষিতের হার ছিল প্রায় ৯৯ শতাংশ। তার উন্নয়নের মূলমন্ত্র ছিল সততা আর দেশপ্রেম।” তিনি বলেছিলেন- আমাকে দশজন য্বুক দাও, আমি মালয়ীদের সঙ্গে নিয়ে বিশ্বজয় করে ফেলব। ঠিকই তিনি বিশ্ব জয় করতে পেরেছিলেন। এক আদর্শিক চেতনা দিয়ে তিনি দারিদ্রের তলানীতি অবস্থান করা মালয়েশিয়াকে উন্নয়নের শীর্ষে তুলে এনেছেন। শুধু মালয়েশিয়াতে নয়, তার উন্নয়নের রোলমডেল সারা বিশ্বে স্বীকৃত। বিশ্বের সকল অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জন্য তিনি কেবল অনুপ্রেরণা। দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য নির্মোহ শাসকের বিকল্প নেই। যে দেশ নির্মোহ শাসক খুঁজে পেয়েছে, সে দেশই উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। লেখক : প্রাবন্ধিক।