পূর্ব প্রকাশিতের পর
সার্কের কাঠামোটি প্রকৃতপক্ষে আঞ্চলিক সহযোগিতার অনুকূল নয়। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনই হচ্ছে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক কর্তৃপক্ষ। শীর্ষ সম্মেলনের অংশীদার যে কোনও একটি দেশ অনীহা প্রকাশ করলে সম্মেলন পন্ড হয়ে যেতে পারে। কার্যত হয়েছেও তাই। সার্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ৪০টি বছরে এর সনদ অনুযায়ী ৪০টি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবার কথা থাকলেও হয়েছে মাত্র ১৮টি। অবশিষ্ট ২২টি হয়নি। এর প্রধান কারণ ভারতের বিরোধিতা। ভৌগোলিক আয়তন, অর্থনৈতিক অবস্থা, সামরিক শক্তি এবং আন্তর্জাতিক প্রভাব এর সব ক’টি দৃষ্টিকোণ থেকেই ভারত দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে একটি শক্তিধর দেশ। এ প্রেক্ষিতে আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী একটি শক্তি হিসেবে ভারতের সম্ভাবনা আসিয়ানের তুলনায় সার্ককে একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জোটে পরিণত করেছে। সার্ক ভারতীয় আধিপত্যবাদের খপ্পরে পড়ে যাবে এই ভয়ে প্রাথমিক অবস্থায় পাকিস্তান এতে যোগ দিতে চায় নি। ভারত সার্ককে তার স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের একাধিক নজিরও ইতোমধ্যে স্থাপন করেছে। এর ট্রানজিট ও আঞ্চলিক হাইওয়ে এবং কানেক্টেভিটি সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রকৃতপক্ষে ছিল ভারত-প্রভাবিত। বাংলাদেশের উপর দিয়ে তার উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সংঘাত মুখর রাজ্যগুলোতে সৈন্য ও অস্ত্র সম্ভার পরিবহন এবং এই রাজ্যগুলোতে উৎপাদিত পণ্যের আনা নেয়া নিশ্চিতকরণই ছিল এর লক্ষ্য।
প্রতিবেশী প্রত্যেকটি সদস্যদেশ সার্ক এর উপর ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিরোধী; তাদের ধারণা এর ফলে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ ক্ষুন্ন হতে বাধ্য। আবার ভারতের তরফ থেকে কয়েকটি প্রতিবেশী দেশকে নাম মাত্র কয়েকটি প্রস্তাব দেয়া ছাড়া দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর ভয় ও আশংকা দূর করার কোনও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। তাদের প্রতি ভারতের আচরণ কখনো বন্ধসুলভ ছিল না, এখনো নেই। অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে ভারত বাংলাদেশে কৃষি ব্যবস্থা ও জীববৈচিত্র ধ্বংসের সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানও তার আগ্রাসনের শিকার। বাংলাদেশের সাথে ভারতের দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে সমুদ্র সীমা নির্ধারণ নিয়ে বিরোধ, ছিটমহল বিনিময়সহ স্থল সীমানা নির্ধারণ, আন্তর্জাতিক নদীসমূহের পানি ভাগাভাগি ও ব্যবস্থাপনা সমস্যা, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মান, সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক হর হামেশা বিনা উষ্কানিতে গুলি বর্ষণ, বাংলাদেশীদের হত্যা ও তাদের ছত্রছায়ায় বাংলাদেশ ভূখন্ডে ঢুকে ভারতীয়দের জমি দখল, চাষাবাদ, লুটপাট প্রভৃতি। এ সমস্যাগুলো জিইয়ে রেখে ভারত কৌশলে বাংলাদেশের ভারতপন্থী সরকারের কাছ থেকে বন্দর, করিডোর, ট্রানজিট ও গ্যাস, কয়লা ব্যবহারের সুবিধা আদায় করে নিয়েছে যা দেশের ১৫ কোটি মানুষ সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। সাধারণ মানুষের এ প্রতিক্রিয়া উভয় দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় বাধা হয়ে রয়েছে যা সার্ক-এর দর্শনকে দুর্বল করছে।
প্রক্ষান্তরে ভারত কৌশলে ঝবাবহ Seven Sisters নামক তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা সস্তা, সহজ ও কাছাকাছি করার জন্য বাংলাদেশ থেকে ট্রানজিট-করিডোর ও বন্দর সুবিধা আদায় করলেও যাতে ভারতের ওপর দিয়ে বিমান পথে পাকস্তিান যেতে না পারে সেজন্য তার ভূখণ্ডের উপর দিয়ে বিমান উড্ডয়ন নিষিদ্ধ করে রেখেছে। ফলে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বিমান যোগাযোগ কঠিন ও ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। ইচ্ছুক যাত্রীদের তিন ঘণ্টার রাস্তা ৯ ঘণ্টায় পাড়ি দিতে হয়।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রয়েছে বিশাল ঘাটতি। আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যে এ ঘাটতির পরিমাণ গড়ে বছরে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য বিশেষ করে চোরা কারবারকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে এর পরিমাণ বছরে ৬০ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করে। সার্ক এর সাপটা, সাফটা কিংবা উভয় দেশের মধ্যে সম্পাদিত কোনও প্রকার বাণিজ্য চুক্তিই এই ব্যবধান হ্রাস করতে পারছেনা। ভারতের শুল্ক ও শুল্ক বহির্ভুত বিধি নিষেধ এর জন্য প্রধানতঃ দায়ী। এ ক্ষেত্রে তাদের গৃহিত ব্যবস্থাসমূহের স্বচ্ছতাও নেই। শুল্ক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পণ্যের শ্রেণী বিন্যাস নিয়ে বিরোধ, রাসায়নিক পরীক্ষা ও ইন্ডিয়ান কাষ্টমস্ কর্তৃপক্ষের নিজস্ব মূল্যায়নের উপর গুরুত্বারোপ রুলস অব অরিজিন সার্টিফিকেট গ্রহণে অস্বীকৃতি, একতরফাভাবে ট্যারিফ মূল্য চাপিয়ে দেয়া, আইএসআই সার্টিফিকেট গ্রহণের বাধ্যবাধকতা, বিএসটিআই সনদ গ্রহণে অস্বীকৃতি, কোয়ারেন্টাইন সনদের বাধ্যবাধকতা প্রভৃতি ভারতে বাংলাদেশী পণ্যের প্রবেশকে অসম্ভব করে তুলেছে। ফলে সার্ক-এর বাণিজ্যিক কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। প্রায় একই রকমের অবস্থা অন্যান্য দেশেও বিরাজ করছে।
আবার সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রাধান্যের সুযোগ দেশটিকে প্রতিবেশীদের প্রতি উদ্ধত ও আপোসহীন করে তুলেছে। দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভারতের সাথে প্রতিবেশী দেশসমূহের দীর্ঘ মেয়াদী বিরোধ সার্ক-এর কার্যকারিতার উপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করছে। আবার দ্বিপাক্ষিক বিষয় সার্ক ফোরামে না আনার নীতি বিরোধকে আরো গভীরতর করছে। আঞ্চলিক বাণিজ্যের উপর এর প্রভাব পড়ছে। বস্তুত আঞ্চলিক বিরোধসমূহকে নিষ্পত্তির চেষ্টা না করে আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রচেষ্টা সার্ক-এর একটি দুর্বলতম দিক। বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সার্কের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা বা শাস্তির বিধান নেই। বিরোধ কিভাবে সার্কের অগ্রগতিকে রুদ্ধ করতে পারে তার কয়েকটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কায় এলটিটিআই বিদ্রোহীদের দমনের ব্যাপারে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপ ভারত-শ্রীলঙ্কা সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে অবনতির সৃষ্টি করেছিল তা সার্কের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচী বাস্তবায়নে শ্রীলঙ্কার মধ্যে উন্মাসিকতার সৃষ্টি করেছিল। সদস্য দেশগুলোর উপরও এর প্রভাব পড়েছিল।
ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ এর দ্বিতীয় উদাহরন। নতুন দিল্লীর সাথে বাণিজ্যিক বিষয়ে আলোচনার পূর্বে পাকিস্তান ভারতের সাথে তার দ্বিপাক্ষিক বিরোধসমূহ বিশেষ করে কাশ্মীর সমস্যার মীমাংসার উপর গুরুত্বারোপ করে এসেছে। কিন্তু ভারত সে পথে এগোয়নি বরং পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছে। পরমাণু শক্তিধর এ দু’টি দেশ অস্ত্র প্রাতিযোগিতায়ও নেমেছে। পাকিস্তানের মোকাবেলায় ভারত সার্ক এলাকায় বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানের সমন্বয়ে গঠিত একটি উপ-আঞ্চলিক গ্রুপে যোগদান করেছে। তারা নেপালের সাথে একটি বাণিজ্য ও ট্রানজিট চুক্তিও করেছে। দেশটি বাংলাদেশের রাজনীতিতেও হস্তক্ষেপ করছে এবং তার প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন রাজনৈতিক দল/দলসমূহকে অর্থবিত্তের প্ররোচনা ও প্রলোভন দেখিয়ে কাবু করে এবং প্রত্যক্ষ মদদ দিয়ে ক্ষমতায় এনে স্বার্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টায় ব্যাপৃত রয়েছে। ২০০৯ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে বাংলাদেশে বিডিআর বিদ্রোহ ও সেনা হত্যাকাণ্ডের সময় ভারত কর্তৃক ঘটনার সার্বক্ষণিক মনিটরিং, তাদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন শেখ হাসিনা সরকারকে উদ্ধার করার জন্য প্রয়োজনে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ও সেনা প্রেরণের প্রস্তাব এ অঞ্চলে ভারতীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠারই ইঙ্গিত বহন করে। একইভাবে সম্প্রতি ঢাকায় চূড়ান্তকৃত সার্ক গণতন্ত্র সনদ ও গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় প্রশ্নের অবতারনা করেছে। এ সনদে সদস্য দেশে গণতন্ত্র বিপন্ন হলে অন্য দেশের হস্তক্ষেপের বিধান রাখা হয়েছে যা সার্ক দেশগুলোর রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী। এ বিধান ভারতীয় আধিপত্যবাদকে উৎসাহিত করবে। মজার ব্যপার হচ্ছে এই বিধানটি এমন একটি সরকারের উদ্যোগে সংযোজন করা হয়েছে যে সরকার তার দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং ভারত তাদের অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে।
সার্ককে যদি টিকে থাকতে হয় তাহলে তার সদস্য দেশগুলোর জনসাধারণের সমস্যাবলী সমাধানের পথ ধরেই টিকে থাকতে হবে। জোটবদ্ধ উন্নয়নের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেই এটা করা সম্ভব। এক্ষেত্রে আসিয়ান ও ইইসি থেকে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।
ইইসি একটি পুরাতন প্রতিষ্ঠান। প্রাথমিক অবস্থায় ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানী, বেলজিয়াম ও লুক্সেমবার্গ এ জোট গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। জোটটি ইউরোপীয় কৃষক ও শিল্প মালিকদের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ সমস্যার নিরসন এবং তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। এ জোটের সদস্যপদ এখন ২৫ এ এসে দাঁড়িয়েছে। উৎপাদন, অভ্যন্তরীণ বণ্টন ও রফতানীর ক্ষেত্রে ইইসি তার সদস্য দেশগুলোর সমবায় সমিতি গুলোকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে। ইইসির কয়েকটি নির্বাচিত সদস্য দেশের কৃষি পণ্য বাজারজাতকরণে সমবায়ের হিস্সা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ২০১৮ সালে জার্মানীর কৃষি পণ্য বিশেষ করে খাদ্য শস্যের ৬৭ শতাংশ, ফ্রান্সের ৬৬ শতাংশ, ইতালির ২৬ শতাংশ, ইংল্যান্ডের ৭০ শতাংশ, বেলজিয়ামের ২৫ শতাংশ, লুক্সেমবার্গের ৯০ শতাংশ, ডেনমার্কের ৬০ শতাংশ এবং আয়ারল্যান্ডের কৃষি পণ্যের ৬৫ শতাংশ বাজারজাতকরণ সমবায়ের মাধ্যমে হয়েছে। একইভাবে দুগ্ধপণ্য বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রেও ইইসি দেশগুলো ব্যাপকভাবে সমবায়ের উপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে সমবায়ের উপর জার্মানীর নির্ভরশীলতা হচ্ছে ৭৮ শতাংশ, ফ্রান্সের ৫৮%, ইতালীর ৪৫%, ইংল্যান্ডের ৮৭% বেলজিয়ামের ৬৮%, লুক্সেমবার্গের ৯০%, ডেনমার্কের ৮৭% এবং আয়ারল্যান্ডের নির্ভরশীলতা হচ্ছে ৯০%।
ইইসি দেশগুলো কর্তৃক গৃহিত সাধারণ কৃষি নীতির আওতায় প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা প্রোডাকশন, মার্কেটিং ও কনজুমার কোঅপারেটিভগুলোকে ব্যাপক ভিত্তিতে তাদের সার্বিক অবস্থান সুদৃঢ় করতে সাহায্য করেছে। আশির দশকের পর থেকে এসব দেশে সমবায় সমিতির সংখ্যা কমতে শুরু করেছে এবং বর্তমানে সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এর অর্থ এ নয় যে, ইউরোপে সমবায়ের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে কিংবা সমবায়ের উপর থেকে ইউরোপবাসী আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। সমবায়ের ক্ষেত্রে ইইসি দেশগুলোতে এখন amalgamation, absorption I reconstruction কর্মসূচী বাস্তবায়িত হচ্ছে। ব্যাপক উৎপাদনকে সামনে রেখে তারা ছোট ছোট সমবায়গুলোকে ভেঙ্গে দিয়ে বড় সমিতিগুলোর সাথে একত্রিভুত করছে। একত্রিভুতকরণের এ প্রক্রিয়া কোন কোন ক্ষেত্রে জাতীয় সীমানাকেও অতিক্রম করছে। ড্যানিস ডেইরী কোঅপারেটিভের সাথে নরওয়ে ও সুইডেন তাদের ডেইরী সমিতি একত্রিভুত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের স্বার্থে তারা যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ অথবা গিল্ড গঠনে ঐকমত্য প্রকাশ করছে। দুধ উৎপাদন, গম উৎপাদন, আলু উৎপাদন, গোশত উৎপাদন সর্বক্ষেত্রে তারা কৌটা প্রথা চালু করেছে। বাজারের স্বার্থে কৌটার অতিরিক্ত উৎপাদন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ কায়েমের মাধ্যমে এশিয়ার উদীয়মান দেশগুলো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দেয়া তাদের প্রধান লক্ষ্য। ইইসিতে কয়েক বছর আগে নতুন আরো ১০টি দেশের সদস্য পদ প্রদান ইইসি ও ইউরোপীয় কমন মার্কেটের লক্ষ্য অর্জনকে সহজতর করেছে।
উপসংহার : প্রযুক্তির উৎকর্ষ বিশাল দুনিয়াকে এখন মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। এ প্রযুক্তি উন্নত দেশগুলোকে অনুন্নত দেশগুলোর উপর প্রাধান্য দিয়ে Survival of the fittest নীতিকে জোরদার করতেও সহায়তা করছে। এ প্রেক্ষিতে বৃহৎ অর্থনীতিগুলোর মোকাবিলায় ক্ষুদ্র অর্থনীতিগুলোকে টিকে থাকতে হলে ক্ষুদ্র ও অনুন্নত দেশগুলোর ঐক্য ও জোট গঠনের বিকল্প নেই। সার্ক এ ক্ষেত্রে একটি প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছে। সস্তা শ্রম শক্তি, সস্তা কাঁচা মাল, উর্বর কৃষি ভূমি ও অনুকূল পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে আঞ্চলিক উন্নয়ন ও বাইরের অর্থনৈতিক আগ্রাসন মুকাবিলার জন্য সার্কের সূচনাও এ অঞ্চলের মানুষের মনে একটি অঙ্গীকারের সূচনা করেছিল। কিন্তু ভারতের মোড়লিপনা ও ভারত-পাকিস্তান ঈৎড়ংং Cross Cultural Conflict এর শিকার হয়ে এ প্রতিষ্ঠানটি তার অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে সার্ককে তৎপর ও শক্তিশালী করতে হলে নিম্নোক্ত দুটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী।
১) সার্ক সনদ সংশোধন করে সার্কের বিদ্যমান শীর্ষ সম্মেলনকে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট করা জরুরী। এর উচ্চতর কক্ষে থাকবে সকল সদস্য দেশ এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সামগ্রিক অগ্রগতির মূল্যায়ন ও পরিধারণ হবে তার কাজ। সামিট এর নিম্ন কক্ষে ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব থাকবে না। এ কক্ষের সদস্য দেশগুলো বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন এবং বাধ্যতামূলকভাবে প্রতি বছর একবার শীর্ষ সম্মেলনে মিলিত হবেন। শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানের জন্য সকল দেশের ১০০ ভাগ সম্মতির বিধানটিও রহিত করতে হবে। ভারতীয় আধিপত্য ও ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বকে যদি সার্কের কাঠামোতে গৌন করে তোলা যায় তা হলে এই প্রতিষ্ঠানটির গতিশীলতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
২) উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও আন্তঃবাণিজ্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সার্ক দেশগুলো ইইসি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং সমবায়সহ স্ব-স্ব দেশের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাতে পারে। এক্ষেত্রে ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’- এই নীতির অনুসরণে সার্ক বহির্ভুত দেশসমূহের পরিবর্তে তারা তাদের আমদানী-রফতানী বাণিজ্য যথাসম্ভব নিজেরদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা ও সম্প্রসারিত করার পদক্ষেপ নিতে পারে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান Tarrif-Non-Tarrif বাধাসমূহ অবশ্যই দূর করতে হবে। ভারত-পাকিস্তান যদি এক্ষেত্রে অন্যান্য সদস্য দেশগুলোর সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে চায় আপত্তি নেই। তবে তারা যাতে বাধা না হতে পারে সে জন্যই সনদ সংশোধন জরুরি।