॥ মাজিদুল ইসলাম উজ্জ্বল ॥
রাষ্ট্র তার সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশে পদ্মা সেতু থেকে মেট্রোরেল, মহাসড়ক থেকে স্যাটেলাইট- সবখানে অর্জনের উজ্জ্বল আলোকরশ্মি থাকলেও এর মাঝেই থেকে যাচ্ছে এক অন্ধকার বাস্তবতা। দেশের প্রায় এক কোটি প্রতিবন্ধী নাগরিক আজও শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক মর্যাদার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। তারা যেন রাষ্ট্রীয় নীতির আলোয় উপেক্ষিত, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির অন্ধকারে বন্দী।
২০১৩ সালে বাংলাদেশে প্রণীত হয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ। কাগজে-কলমে এ আইনগুলো যুগান্তকারী হলেও বাস্তবে তা প্রায় অকার্যকর। সারাদেশের অধিকাংশ সরকারি ভবনে হুইলচেয়ারের র্যাম্প নেই, সরকারি অফিস বা হাসপাতালে প্রবেশগম্য টয়লেট নেই। গণপরিবহনে প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত আসন রাখা হলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয় না। ফুটপাত, ওভারব্রিজ, বাস- সবখানেই প্রতিবন্ধীদের জন্য পরিবেশ অনুপযোগী। ফলে আইনের মাধ্যমে দেওয়া অধিকার বাস্তবে থেকে যাচ্ছে অধরাই।
বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের সঠিক সংখ্যা নিয়েও চরম অস্পষ্টতা রয়েছে। ২০২২ এর জরিপে ২২ লাখ বলা হলেও ২০২৩ সালের জরিপে এর সংখ্যা প্রকাশ করা হয় ৪৮ লাখ। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে এ সংখ্যা দেড় কোটির বেশি। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকায় রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন সবসময় বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে।
অন্যদিকে জাতীয় বাজেটে প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্দিষ্ট বরাদ্দ নেই। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় প্রায় ১৮ লাখ মানুষ মাসে মাত্র ৭৫০ টাকা ভাতা পান। প্রতিদিনের হিসেবে যা দাঁড়ায় ২৫ টাকা। এ টাকা দিয়ে একজন মানুষের বর্তমান বাজারে ঠিক কোন চাহিদা মেটানো সম্ভব! । আরও ভয়াবহ হলো, প্রায় ১৬ শতাংশ প্রতিবন্ধী এ ভাতার আওতায়ই আসেন না।
বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সুবিধা অপ্রতুল। গ্রামীণ এলাকায় ফিজিওথেরাপি, অরথোটিক/প্রোস্থেটিক সেবা প্রায় অনুপস্থিত। সরকারি হাসপাতালে প্রতিবন্ধীবান্ধব পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। অনেকেই চিকিৎসা বা হুইলচেয়ার, শ্রবণযন্ত্র, কৃত্রিম অঙ্গ ইত্যাদি কেনার সামর্থ্য রাখেন না। পুনর্বাসন ও কাউন্সেলিং সেবাও খুব সীমিত, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্রতিবন্ধীরা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হন শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে। বিশেষায়িত বিদ্যালয় পর্যাপ্ত নয়, যেগুলো আছে তারও অবস্থা শোচনীয়। থেরাপি যন্ত্রপাতি অকার্যকর, মাঠ নেই, শিক্ষক সংকট প্রকট। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও বাস্তবতা করুণ।
সরকারি চাকরিতে তাদের জন্য বিশেষ সুবিধার কথা বলা হলেও বাস্ততা অনেক দূর। কেননা দেশের অধিকাংশ চাকরির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায়। যেখানে দেশের প্রত্যন্ত এলাকার প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণ করা প্রায় অসম্ভব। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও তাদের জন্য উপযোগী কর্মপরিবেশ গড়ে ওঠেনি। ফলে তারা মেধা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরির বাজারে পিছিয়ে থাকেন।
অনেক নিয়োগকর্তা এখনও মনে করেন, প্রতিবন্ধীরা ‘উৎপাদনশীল নয়’ যা একটি ভয়াবহ মানসিক প্রতিবন্ধকতা। পেশাগত প্রশিক্ষণ ও উদ্যোক্তা সহায়তার ক্ষেত্রেও তাদের জন্য কোনো বিশেষ পরিকল্পনা বা প্রণোদনা নেই। ফলে অধিকাংশ প্রতিবন্ধীই হয় বেকার, অথবা স্বল্প আয়ের অনিশ্চিত কাজের মধ্যে থাকতে বাধ্য হয়।
এ সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও নীতিনির্ধারণে অংশগ্রহণের ব্যাপক অভাব। প্রতিবন্ধীদের মধ্যে খুব কম মানুষ রাজনীতি বা নীতিনির্ধারণে সক্রিয়। ইউনিয়ন পরিষদ বা সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব প্রায় নেই। তাই নীতি বা বাজেট প্রণয়নের সময় তাদের মতামত বিবেচনা করা হয় না। ফলে তাদের সমস্যাগুলো সমাধানের পরিকল্পনাও অনেক সময় তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে।
জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন নীতির বাস্তবায়ন খুব দুর্বল। স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি সীমিত। অনেক প্রতিবন্ধী জানেই না যে তাদের কী কী অধিকার আছে। আইন লঙ্ঘনের বিচার প্রক্রিয়াও ধীর ও জটিল। সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো সমাজের মানসিকতা। প্রতিবন্ধীদের এখনো ‘অভিশাপ’ বা ‘বোঝা’ হিসেবে দেখা হয়। বিশেষ করে নারী প্রতিবন্ধীরা দ্বিগুণ বৈষম্যের শিকার হনÑ প্রতিবন্ধিতা ও নারী পরিচয়ের কারণে। অনেক বাবা-মা সামাজিক লজ্জায় সন্তানকে প্রতিবন্ধী হিসেবে নিবন্ধন করতে চান না। এর ফলে সরকারি তথ্যভা-ার অসম্পূর্ণ থাকে এবং নীতি প্রণয়ন হয় ভ্রান্ত ভিত্তির ওপর।
জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী অধিকার সনদে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে-প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও পরিবহনে সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু বাস্তবে রাজধানীর ৯০ শতাংশ ভবনই অপ্রবেশগম্য, গণপরিবহন প্রতিবন্ধীবান্ধব নয়, হাসপাতালগুলোতে নেই বিশেষ সেবা। রাষ্ট্র যদি আইন করে দায়িত্ব পালন করেছে বলে সন্তুষ্ট থাকে, তবে তা আত্মপ্রবঞ্চনা ছাড়া কিছু নয়। বাস্তব পদক্ষেপে ঘাটতি থাকলে সব আইনই হয়ে ওঠে কাগুজে বাঘ।
প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিশ্চিত করতে কয়েকটি জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তারমধ্যে প্রথম কাজ হলো প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণ। এরপর নির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ এবং তার স্বচ্ছ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রতিটি জেলায় বিশেষায়িত বিদ্যালয়, সরকারি চাকরিতে বিশেষ সুবিধার কার্যকর বাস্তবায়ন ও নিজ জেলায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। এছাড়াও পরিবহন ও অবকাঠামো, নারী প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষা, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আইন বাস্তবায়নে শক্তিশালী তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তবেই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এ মানুষগুলোর প্রতি সমাজের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা সম্ভব।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া