আর্শিনা ফেরদৌস

গণতন্ত্র ও গণঅভ্যুত্থান পরস্পর বিরোধী; বিপরীতধর্মী। উভয়ের মধ্যে সহাবস্থান কোন ভাবেই সম্ভব নয়। যেখানে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিচ্যুতি দেখা দেয়; সেখানে গণঅভ্যুত্থান অবশ্যাম্ভাবী হয়ে পড়ে। কারণ, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কখনো অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী; স্বৈরাচারি ও ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠী বা শক্তির পতন হয়নি। এ ক্ষেত্রেই গণবিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যার প্রমাণ হয়েছে আমাদের দেশে জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে।

আমরা মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে গণতন্ত্র সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ আলোচনার চেষ্টা করবো। একথা অনস্বীকার্য যে, আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় শাসনপদ্ধতি হচ্ছে গণতন্ত্র। যদিও গণতন্ত্রের কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে। তারপরও গণতন্ত্রকেই অধিকতর গ্রহণযোগ্য শাসন পদ্ধতি বলে মনে করা হয়। মূলত, গণতন্ত্র হলো এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে ক্ষমতা থাকে জনগণের হাতে। সহজভাবে বলতে গেলে, গণতন্ত্রে নেতারা নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। আরেকটু বিস্তারিতভাবে বললে, গণতন্ত্র শুধু নির্বাচনই নয়, এতে নাগরিকদের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের নিশ্চয়তাও থাকে।

প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে জনগণ সরাসরি আইন তৈরি করেন। আর প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে জনগণ ভোট দিয়ে প্রতিনিধি বেছে নেন, যারা তাদের হয়ে শাসন পরিচালনা করে। গণতন্ত্রে সাধারণত থাকে সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠন করার অধিকার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, ধর্ম ও বাকস্বাধীনতা, নাগরিকত্ব, শাসিতদের সম্মতি, ভোটের অধিকার, জীবন ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা এবং সংখ্যালঘু সহ সকল শ্রেণির মানুষের অধিকার।

গণতন্ত্রের ধারণা সময়ের সঙ্গে অনেক বদলে গেছে। আজকাল গণতন্ত্রের প্রধান রূপ হলো প্রতিনিধিত্বমূলক, যেখানে নাগরিকরা ভোট দিয়ে প্রতিনিধি নির্বাচন করে, যেমন সংসদীয় বা রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থায়।

খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে গ্রিসের নগর-রাষ্ট্রে, বিশেষ করে এথেন্সে, ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি এসেছিল, যার অর্থ ‘জনগণের শাসন’, অভিজাততন্ত্রের বিপরীতে। প্রাচীন ও আধুনিক ইতিহাসে গণতান্ত্রিক নাগরিকত্ব প্রথমে শুধু অভিজাতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, পরে ১৯শ ও ২০শ শতকের ভোটাধিকার আন্দোলনের মাধ্যমে সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের জন্য প্রসারিত হয়।

গণতন্ত্র এমন শাসনব্যবস্থার বিপরীত, যেখানে ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকে না, যেমন স্বৈরাচারী ব্যবস্থা। ইতিহাসে গণতন্ত্র ছিল বিরল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু ১৯শ শতক থেকে গণতন্ত্রের বিভিন্ন তরঙ্গে এটি বেশি প্রচলিত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে গণতন্ত্র বেশ জনপ্রিয়। কারণ, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এটিকে অন্য ব্যবস্থার চেয়ে বেশি পছন্দ করে। এমনকি স্বৈরাচারী দেশগুলোও নিজেদের গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে। তবে, ভি-ডেম এবং ইকোনমিস্টের গণতন্ত্র সূচক অনুযায়ী, ২০২২ সাল পর্যন্ত বিশ্বের অর্ধেকেরও কম মানুষ গণতন্ত্রে বাস করে।

গণতন্ত্র মানে এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে জনগণই ক্ষমতার মালিক। সাধারণভাবে বললে, গণতন্ত্রে জনগণ ভোট দিয়ে তাদের নেতা বেছে নেয়। কিন্তু এর সঠিক সংজ্ঞা নিয়ে সকলেই একমত নন। দার্শনিক কার্ল পপার বলেছেন, ‘গণতন্ত্র মানে জনগণের শাসন, আর জনগণের শাসন করার অধিকার আছে। ইংরেজিতে গণতন্ত্রকে বর্ণনা করতে ২,২৩৪টির মতো বিশেষণ ব্যবহার হয়েছে!

গণতন্ত্রে সকল নাগরিক আইনের কাছে সমান। আর তাদের আইন তৈরির প্রক্রিয়ায় সমান সুযোগ থাকে। যেমন, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে প্রত্যেকের ভোটের মূল্য একই। নাগরিকদের অধিকার, যেমন বাকস্বাধীনতা, সাধারণত সংবিধানে লেখা থাকে। আবার, কখনো গণতন্ত্র মানে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রও হতে পারে, যেখানে মানুষ সরাসরি বিষয়ের ওপর ভোট দেয়। জাতিসংঘের সংজ্ঞায় বলা হয়, গণতন্ত্র এমন এক পরিবেশ দেয় যেখানে মানবাধিকার ও স্বাধীনতার প্রতি সম্মান থাকে, আর মানুষ তাদের ইচ্ছা অবাধে প্রকাশ করতে পারে। মূলত গণতন্ত্রের জন্য তিনটি জিনিস দরকার: জনগণের হাতে ক্ষমতা, রাজনৈতিক সমতা, আর এমন সামাজিক রীতি যা এ দু’টোকে মানে। আইনের সামনে সমতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা আর আইনের শাসন গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি বলে মনে করা হয়। কিছু দেশে, যেমন যুক্তরাজ্যে সংসদের ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি, তবে বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকে। ভারতে সংসদের ক্ষমতা সংবিধানের অধীন, যেখানে বিচারিক পর্যালোচনা আছে। গণতন্ত্র শব্দটা সাধারণত রাষ্ট্রের জন্য ব্যবহৃত হলেও, এর নীতি ক্লাব, সংগঠন বা কোম্পানির মতো জায়গাতেও ব্যবহার করা যায়।

গণতন্ত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনেক উপায় থাকতে পারে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতই সবচেয়ে বেশি চলে। কিন্তু সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা না হলে, তারা ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের জুলুমের’ শিকার হতে পারে। তাই নির্বাচন ও আলোচনা ন্যায্য হতে হবে। কিছু দেশে বাকস্বাধীনতা, রাজনৈতিক প্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে ভোটাররা নিজেদের ইচ্ছা ও বিশ্বাস অনুযায়ী ভোট দিতে পারে। গণতন্ত্রের আরেকটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো, সব ভোটার সমাজের জীবনে অবাধে অংশ নিতে পারে। সামাজিক চুক্তি ও সবার সম্মিলিত ইচ্ছার ওপর জোর দিয়ে, গণতন্ত্রকে এক ধরনের সমষ্টিগত শাসনও বলা যায়, কারণ এখানে সব যোগ্য নাগরিকের আইন তৈরিতে সমান অধিকার থাকে।

প্রজাতন্ত্র প্রায়ই গণতন্ত্রের সঙ্গে মিলে যায়। কারণ, দু’টোতেই জনগণের সম্মতিতে শাসন চলে। তবে প্রজাতন্ত্র মানেই গণতন্ত্র নয়। কারণ, প্রজাতন্ত্রে জনগণ কীভাবে শাসন করবে তা বলা থাকে না। আগে ‘প্রজাতন্ত্র’ বলতে গণতন্ত্র আর অভিজাততন্ত্র দুটোই বোঝানো হতো। এখন প্রজাতন্ত্র মানে এমন শাসন যেখানে রাজা নেই। তাই গণতন্ত্র হতে পারে প্রজাতন্ত্র বা সাংবিধানিক রাজতন্ত্র, যেমন যুক্তরাজ্য।

যে দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিচ্যুতি ঘটে, শাসকগোষ্ঠী যখন তাদের ইচ্ছামাফিক শাসনকার্য পরিচালনা করেন এবং নিজেদের অবৈধ ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত বা চিরস্থায়ী করার জন্য জনগণের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালান বা বেআইনী কার্যক্রম পরিচালনা করেন তখনই সে শাসকগোষ্ঠীকে স্বৈরতান্ত্রিক বা ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠী হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়। ফ্যাসিবাদ শব্দটি ইতালীয় শব্দ ‘ভধংপরংসড়’ থেকে উদ্ভূত, যা ‘ভধংপরড়’ শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ ‘লাঠির বান্ডিল’, যা প্রাচীন রোমান প্রতীক ‘ভধংপবং’ থেকে উদ্ভূত। এ প্রতীকটি একাধিক লাঠির বান্ডিলের সাথে একটি কুড়ালকে ঘিরে রাখা হতো, যা শক্তি এবং ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ফ্যাসিবাদের মূল আদর্শ ছিল একদলীয় শাসনব্যবস্থা, যেখানে জাতীয়তাবাদ ও কর্তৃত্ববাদ ছিল প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রাচীন রোমান ফ্যাসেসের মতোই এটি শক্তি ও শৃঙ্খলার উপর জোর দেয়।

ফ্যাসিবাদের প্রথম উদ্ভব ঘটে ইতালিতে। ১৯১৫ সালে বেনিটো মুসোলিনি ইতালিতে ফ্যাসেস অফ রেভোলিউশনারি অ্যাকশন প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে ১৯১৯ সালে মুসোলিনি মিলানে ইতালীয় ফ্যাসিস অফ কমব্যাট গঠন করেন। দু’বছরের মধ্যেই এটি জাতীয় ফ্যাসিস্ট পার্টিতে রূপান্তরিত হয়। শাসনব্যবস্থাটি একটি কর্তৃত্ববাদী এবং জাতীয়তাবাদী ডানপন্থী ব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত। এটি মানুষের স্বাধীনতাকে সীমিত করে, যেখানে একক শাসক বা দলই সব ক্ষমতা ধরে রাখে।

ফ্যাসেস প্রতীক ঐক্যের মাধ্যমে শক্তির ধারণা প্রকাশ করে। একটি একক লাঠি সহজেই ভেঙে যায়, কিন্তু লাঠির বান্ডিল ভাঙা অনেক কঠিন। প্রতীকটি বিভিন্ন ফ্যাসিবাদী আন্দোলনে ব্যবহৃত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ স্পেনের ফ্যালাঞ্জ প্রতীক ছিল একটি জোয়ালের মাধ্যমে সংযুক্ত পাঁচটি তীর। ফ্যাসিবাদী নেতারা, যেমন আডলফ হিটলার এবং বেনিটো মুসোলিনি, এ প্রতীককে ব্যবহার করে তাদের শক্তি ও শাসনের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন।

ফ্যাসিবাদ প্রথমে ইতালিতে শুরু হলেও, এটি জার্মানি, স্পেন এবং অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। জার্মানিতে হিটলারের অধীনে নাৎসি শাসন এবং স্পেনে ফ্রাংকোর শাসন ফ্যাসিবাদী আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছিল। ফ্যাসিবাদের এ ধরণগুলি বিশ্বে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণ হয়। এটি বিশ্বযুদ্ধ এবং গণহত্যার মতো ঘটনা ঘটায়, যা মানুষের জীবনে চিরস্থায়ী দাগ রেখে গেছে।

ফ্যাসিবাদ কেবল একটি রাজনৈতিক আদর্শ নয়; এটি একটি দুঃখজনক ইতিহাস, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে কর্তৃত্ববাদ এবং স্বাধীনতা হরণের মধ্যে কী ক্ষতি লুকিয়ে থাকে। শক্তি এবং ঐক্যের ভুল ব্যাখ্যা মানবজাতির জন্য ধ্বংস ডেকে আনে। নিকট অতীতে আমাদের দেশেও তা আমরা লক্ষ্য করেছি। কিন্তু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এদের পতন হয়নি বরং গণবিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমেই এদেরকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করতে হয়েছে।

মূলত, গণঅভ্যুত্থান (Mass Uprising) হল একটি রাষ্ট্র বা শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের বৃহৎ পরিসরের আন্দোলন বা প্রতিরোধ। সাধারণত এটি রাষ্ট্রের নিপীড়ন, দুর্নীতি, বৈষম্য, দখলদারিত্ব অথবা অবৈধ ক্ষমতার বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়। গণঅভ্যুত্থানে জনগণের অংশগ্রহণ স্বতঃস্ফূর্ত, ব্যাপক এবং সিদ্ধান্তমূলক হয়। অনেক সময় এ অভ্যুত্থান সরকার পতন কিংবা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আমূল পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়। আমাদের দেশের ইতিহাসে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। যা দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আর গত বছরের ৫ আগস্টের বিপ্লব ছিলো আমাদের দেশের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন : পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অস্বীকার করলে তীব্র গণপ্রতিবাদ গড়ে ওঠে। ঢাকাসহ সারা বাংলায় ছাত্র ও সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণে ব্যাপক আন্দোলন সংগঠিত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতা পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শহীদ সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার প্রমূখ। এ আন্দোলন বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার সূচনা করে এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি রচনা করেছিলো। অনেক ইতিহাসবিদ একে বাংলাদেশের প্রথম গণঅভ্যুত্থান হিসেবে বিবেচনা করেন

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান : পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের দমননীতির বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি বিক্ষোভে বহু শহীদ; আইয়ুব খানের পতনের পথ সুগম হয়। ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হন। ফলে স্বাধীনতার আন্দোলনের পূর্বভূমি প্রস্তুত হয়।

১৯৭৫ সালের সেনা অভ্যুত্থান : শেখ মুজিব কর্তৃক বাকশাল গঠন, একদলীয় শাসন ও গণমাধ্যম বন্ধের ফলে জনমনে চরম অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে সেনা সদস্যদের হাতে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। খন্দকার মোশতাক আহমেদ ক্ষমতা দখল করেন। এটি রাজনৈতিক অস্থিরতার সূচনা করে। বস্তুত, এটিও ছিলো একটি গণঅভ্যুত্থান।

৭ নভেম্বর ১৯৭৫: সিপাহি-জনতার বিপ্লব : ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সাধারণ সৈনিক ও জনতা মিলিতভাবে ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব’ ঘটায়। কারাবন্দি মেজর জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে রাষ্ট্রক্ষমতা পুনর্গঠন হয়। এ আন্দোলন সামরিক শৃঙ্খলা ভেঙে গণসম্পৃক্ত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন এবং তার নেতৃত্বে ভেঙেপড়া রাষ্ট্রকাঠামো পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। অনেক বিশ্লেষক এটিকে স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান মনে করেন।

১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান : হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র ঐক্য জোট, রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ জনগণ রাস্তায় নামে পুলিশের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা নূর হোসেনসহ অনেকে শহীদ হন। গণআন্দোলনের চাপে এরশাদ পদত্যাগ করেন এবং সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৯১ সালে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হন এবং তার নেতৃত্বে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান : শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী সরকারের দীর্ঘদিনের ভোট ডাকাতি, গুম-খুন, দমন-পীড়ন, ভারতের আধিপত্য এবং দুর্নীতি ও গণহত্যার বিরুদ্ধে ছাত্র ও সাধারণ জনগণের ঐতিহাসিক গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। এ আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলো নতুন প্রজন্মের ছাত্র-তরুণরা। এ সফল গণঅভ্যুত্থানে দু’ সহস্রাধিক মানুষ শাহাদাত বরণ করেন। হাজার হাজার মানুষ আহত হোন। অনেকে হাত, পা ও চোখ হারিয়ে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েন। ফলে গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচারি ও ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস প্রধান উপদেষ্টা হন। দেশকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে ফিরিয়ে আনার জন্য আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে নতুন নির্বাচনের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।

মূলত, গণতন্ত্র ও গণঅভ্যুত্থান পরস্পর বিরোধী। কোন দেশে যখন গণতন্ত্রের কক্ষচ্যুতি ঘটে, তখনই গণঅভ্যুত্থান জরুরি হয়ে পড়েছে। যেমনটি আমাদের দেশে হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। ফ্যাসিবাদ সাময়িকভাবে পরাক্রমী হয়ে উঠলেও তা কখনো স্থায়ী হয় না। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণঅভ্যুথানই তার প্রকৃত প্রমাণ।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।