DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

কলাম

বাংলার সানি নবাব শমসের গাজির উপাখ্যান

শমসের গাজী ছিলেন অষ্টাদশ শতকের পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারকল্পে ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী একজন রাষ্ট্রনায়ক।

Printed Edition
Untitled-1

সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : শমসের গাজী ছিলেন অষ্টাদশ শতকের পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারকল্পে ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী একজন রাষ্ট্রনায়ক। তিনি একাধারে ত্রিপুরার রওশনাবাদ পরগনার শাসক, ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী এবং কৃষক বিদ্রোহের নায়ক ছিলেন। ‘ভাটির বাঘ’, ‘বাংলার বীর’, ‘বাংলার সানি নবাব’ ইত্যাদি ছিলো তার উপাধি। মগ-পর্তুগীজ জলদস্যুদের বিরুদ্ধে তিনি গড়ে তোলেন এক যোদ্ধা বাহিনী। তার প্রচেষ্টায় বাংলার উপকূলীয় জনপদ থেকে বিতাড়িত হয় হার্মাদরা। নবাব সিরাজুদ্দৌলার পর তিনিই ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে প্রথম শহীদ হন। তবে তাঁর মৃত্যু রহস্য আজো উদ্ঘাটিত হয়নি।এমনকি তাঁর সমাধিও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

জন্ম ও বংশ : শমসের গাজীর জন্মসাল নিয়ে রয়েছে মতভেদ। কারো মতে ১৭০৫ কিংবা ১৭০৬ সালে, আবার কারো মতে ১৭১২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। এই বীর তৎকালীন নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত রওশনাবাদ পরগনায় (বর্তমান ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানার ঘোপাল ইউনিয়নের নিজকুঞ্জরা গ্রামে) জন্মগ্রহণ করেন। উনার পিতার নাম- পীর মুহাম্মদ মতান্তরে পেয়ার মুহাম্মদ খান। মাতা-কৈয়্যারা বিবি। শমসের গাজীর পূর্বপুরুষরা ছিলেন পাঠান বা আফগান।

শমসের গাজীর উত্থান : তালুকদার জগন্নাথ সেনের মৃত্যুর পর যুবক শমসের গাজী শুভপুরের খাজনা আদায় শুরু করেন। এর মধ্যেই জমিদার নাসির মোহাম্মদ চৌধুরী শমসের গাজীকে পানুয়াঘাট কেল্লার অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। ত্রিশ বছরের টগবগে এ যুবক মগ, পর্তুগিজ ও দস্যুদের সাফল্যের সাথে এলাকা থেকে বিতাড়িত করেন। এ সাফল্যে তার আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হয়। সে সময় তিনি চোর ডাকাত, জলদস্যু, মগ, হার্মাদদের রুখতে এক শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তোলেন। গাজীর এ বাহিনীর সেনাপতি ছিল তার জ্ঞাতি ভাই ছাদু পালোয়ান।

এভাবে শুরু হয় তার উত্থান। পর্যায়ক্রমে দক্ষিণ কুমিল্লা ও উত্তর নোয়াখালী জুড়ে বিস্তৃত চাকলা রওশনাবাদের অধিপতি হয়েছিলেন শমসের গাজী। ক্রমে তিনি সমগ্র কুমিল্লা জেলা দখল করেন। তিনি নিজামপুর পরগনা জয় করে মেঘনা, মুহুরী ও মনুগঙ্গার মধ্যবর্তী অঞ্চলের মুকুটহীন রাজা হন। প্রয়াত জমিদার নাসির মোহাম্মদের উত্তরসূরীরা শমসের গাজির বিরুদ্ধে ত্রিপুরার রাজা কৃষ্ণমানিক্যের নিকট অভিযোগ করলে রাজা শমসের গাজীকে দমনের জন্য উজির জয়দেবের নেতৃত্বে একটি অভিযান পরিচালনা করেন। রাজার সৈন্যরা শমসের গাজীর নিকট পরাজিত হয়। এরপর সেনাপতি লুচি দর্পনারায়ণের নেতৃত্বে পৃথক আরেকটি অভিযান পরিচালনা করেন ত্রিপুরার রাজা। ১৭৪০ সালের দিকে ত্রিপুরার মহারাজের সেনাপতি শমসের গাজীর এলাকায় প্রবেশ করলে সেনাপতি ছাদু পালোয়ানের প্রতিরোধে তারা ধরাশায়ী এবং বন্দী হয়। ত্রিপুরার মহারাজ তার সেনাপতির মুক্তির শর্তে গাজীকে দক্ষিণশিকের রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দেন।

ইংরেজদের আগ্রাসন : শমসের গাজী যখন তার রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি করতে থাকেন ঠিক সে সময়ে বাংলার পশ্চিমে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ উদ্দৌলা পরাজিত ও নিহত হন এবং সমগ্র বাংলা ইংরেজদের করতলগত হওয়ার সকল আয়োজন সম্পন্ন হয়। ইংরেজ রাজত্বের প্রারম্ভে জমিদার-তালুকদারের জোর-জুলুম ও লুণ্ঠনে প্রজাগণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো। এর প্রতিকার নিয়ে ভাবতে থাকেন শমসের গাজী।

ত্রিপুরা জয় : একবার পাহাড়ি ঢলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হলে তিনি কৃষকের এক বছরের খাজনা মওকুফ করে দেন এবং পরবর্তী তিন বছর মহারাজের রাজকোষে খাজনা দেয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন। এতে ত্রিপুরা মহারাজ কৃষ্ণমাণিক্য ক্ষিপ্ত হয়ে প্রায় ৭ হাজার কুকী বাহিনীর সৈন্য পাঠায় গাজীকে উচ্ছেদ করার জন্য। এটা ১৭৫০ সালের দিকের ঘটনা। শমসের গাজীর অসাধারণ সমর-কৌশল ও শৌর্যবীর্যের দরুন কৃষ্ণমাণিক্যের বাহিনী পরাজিত হয় এবং তিনি পাল্টা ত্রিপুরা আক্রমণ করেন। গাজী ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুর দখল করেন। রাজা আগরতলায় পলায়ন করেন এবং বাংলার নওয়াব মীরকাসিমের শরণাপন্ন হন। সে সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যের বিরাট অংশ শমসের গাজীর করতলে এসে যায়। দক্ষিণ শিক (ছাগলনাইয়া), ফেনী, খ-ল, জগৎপুর, সীতাকুন্ড-চট্টগ্রাম, তিষ্ণা-চৌদ্দগ্রাম, খাঞ্জানগর, বাগাসাইর, পার্টিকরা, নূরনগর, গঙ্গাম-ল, সরাইল-কুমিল্লা, বিসালগড়-সিলেট, কুমিল্লা, জাহাননগর, মেহেরকুল, বলদাখাল, কসবা, অষ্টজঙ্গল, চাকলা-রওশনাবাদ, ভুলুয়া (নোয়াখালী) নিজামপুর পরগণাসহ বিশাল অঞ্চল অল্প সময়ে তার শাসনাধীন হয়েছিল। এ সময় বাংলার নবাব আলিবর্দী খান শমসের গাজীকে ‘সানি নবাব’ বা দ্বিতীয় নবাব উপাধি দেন।

ফেনীর শুভপুর বাজার থেকে দুই কিলোমিটার পশ্চিমে চম্পকনগরেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন রাজপ্রাসাদ, দরবার হল, অস্ত্রাগারসহ তার বিশাল আবাসস্থল। শমসের গাজীর রাজত্বকালে ত্রিপুরার রাজধানী উদয়পুরেই ছিলো। তবে তিনি বেশিরভাগ সময় রঘুনন্দন পাহাড়ের পাদদেশে ফেনী নদীবেষ্টিত জগন্নাথ-সোনাপুরস্থ চম্পকনগরে তার প্রধান কেল্লা ও রাজপ্রাসাদে থাকতেন। এখানে তার বাসস্থানের স্মৃতিচিহ্ন এখনো বিলীন হয়ে যায়নি।

প্রজা হিতৈষী : শমসের গাজীর সাফল্যের চাবিকাঠি ছিল তার কৃষক-প্রজাগণ। তিনি দরিদ্র কৃষকের কর মওকুফ করে দিতেন। তাঁর অর্থনৈতিক সুব্যবস্থার জন্য জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পায়। তিনি বহু হিন্দু-মুসলমানকে লাখেরাজ ভূমি দিয়েছিলেন। তিনি রাজধানী জগন্নাথ সোনাপুর ও রাজধানীর বাইরে বহু দিঘি খনন ও বিদ্যালয় নির্মাণ করেছিলেন। প্রজাদের পানীয় জলের সমস্যা সমাধানে ছাগলনাইয়ায় তার মায়ের নামে খনন করা বিখ্যাত কৈয়ারা দিঘি যা আজো কালের সাক্ষী হিসেবে বিদ্যমান। তাছাড়া একখুইল্লা দিঘি, বুড়া সামন্তের দিঘি, তার মেয়ের নামে তনু বিবির দিঘি, বল্লভপুরের আলীয়া গাজীর দিঘি, পূর্ব ছাগলনাইয়ার দেয়ান আব্দুর রাজ্জাকের দিঘিসহ অসংখ্য দিঘি খনন করেছিলেন।

ইংরেজদের সাথে সংঘাত ও অন্তর্ধান : ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর মুর্শিদাবাদের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়। বাংলার এমন দুর্যোগ মুহূর্তে স্থানীয় কুচক্রী মহল, ঢাকার নবাবের প্রতিনিধি, ইংরেজ বেনিয়া ও পরাজিত, বিতাড়িত ত্রিপুরার মহারাজ একত্রিত হয় শমসের গাজীর বিরুদ্ধে। শমসের গাজীর দেশপ্রেম ও সাহসিকতা ইংরেজ এবং এ দেশীয় দালাল কুচক্রীদের ভীত করে তুলেছিল। নবাবের নামে মূলত ইংরেজরাই ষড়যন্ত্র করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী এবং যুবরাজ কৃষ্ণমাণিক্যের নেতৃত্বে পাহাড়ী উপজাতীয় যৌথবাহিনী শমসের গাজীর কেল্লা ও উদয়পুরে আক্রমণ চালিয়ে গাজীকে পরাজিত ও আটক করে। তাদের এতটাই আক্রোশ ছিল যে, ত্রিপুরার মহারাজ হাতিসহ হাজার হাজার সৈন্য পাঠিয়ে চম্পকনগরস্থ শমসের গাজীর প্রাসাদ ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে।

চম্পকনগর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বন্দী হলেও আবার পালিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। এটা ১৭৬০ সালের দিকের ঘটনা। এরপর শমসের গাজীর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে সকলেই একমত যে শমসের গাজী স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেননি। তবে ঠিক কীভাবে শমসের গাজীর মৃত্যু হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতের বিরোধ দেখা যায়। অমীমাংসিত থেকে যায় তার মৃত্যুর রহস্য। ইতিহাসে কথিত আছে যে, নবাব সিরাজুদ্দোলার পর তিনিই ঔপনিবেশিক শক্তির হাতে নিহত প্রথম শাসক।

স্মৃতি ও কীর্তির নিদর্শন : সিলেট বিভাগে রয়েছে শমসের নগর। মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে ২০ কি:মি: পূর্বে শ্রীমঙ্গল থেকে ২১ কি:মি: উত্তর-পূর্বে কুলাউড়া থেকে ২৭ কি:মি: দক্ষিণে ও ভারতের উত্তর ত্রিপুরার জেলা কৈলাসহর থেকে মাত্র ১৩ কি: মি: পশ্চিমে এর অবস্থান। কথিত আছে প্রায় তিন শতাধিক বছর আগে এই অঞ্চলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ত্রিপুরা জয়ী পাঠান বীর শমসের গাজীর নামে শমসেরনগরের নামকরণ করা হয়।

ছাগলনাইয়ার চম্পকনগরে ভারতের সীমান্ত এলাকাটি শমসের গাজীর স্মৃতি বিজড়িত স্থান। এখানে রয়েছে শমসের গাজীর সুড়ঙ্গ, শমসের গাজীর দিঘি এবং আরও অনেক কিছু। তবে তার প্রাসাদসহ অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ ভারতের ত্রিপুরার মধ্যে ভাগ হয়ে রয়ে গেছে।

‘শমসের গাজী চর্চা কেন্দ্র’ কী ও কেন? : অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝিতে পলাশী যুদ্ধের সমসাময়িক সময়ে সিলেট, কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ ত্রিপুরার বিশাল অংশ শাসন করেন বীর শমসের গাজী। এই বীরের জন্ম ফেনী জেলার ছাগলনাইয়ায়। অজানা কারণে ব্রিটিশ বিরোধী এই বীরপুরুষকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। উপমহাদেশীয় চরিত্র, ইতিহাসের বিস্মৃত এই মহানায়কের জীবন ও কর্মকে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে সম্প্রতি ফেনীতে আত্মপ্রকাশ হয়েছে ‘শমসের গাজী চর্চা কেন্দ্র।

চর্চা কেন্দ্রের দাবীসমূহ হচ্ছে :

া শমসের গাজীর জীবন ও কর্মকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চর্চার জন্য বাংলা একাডেমি ও কুমিল্লা বার্ড এর আদলে ফেনীতে সরকারীভাবে ‘শমসের গাজী একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনকে আশু প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।

া উপমহাদেশীয় বীর, বাংলার সানি নবাব, ভাটির বাঘ শমসের গাজীর জীবনী ও কর্ম পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে

া ইতিহাস চর্চার অংশ হিসেবে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে শমসের গাজী চেয়ার এবং তাঁর নামে বৃত্তি চালু করতে হবে।

া অন্যান্য জাতীয় বীরগণের ন্যায় শমসের গাজীর নামে ফেনীসহ সারাদেশে নির্মিত এবং নির্মিতব্য বিভিন্ন স্থাপনা, সড়ক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালসমূহে হলের নামকরণ করতে হবে। বিশেষ করে ফেনীর মহিপালে শমসের গাজী স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের জোর দাবি করছি।

া ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম ও সিলেটে শমসের গাজীর স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহকে সরকারী উদ্যোগে যথাযথ সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নিতে হবে।

া শমসের গাজীর জীবনী নিয়ে চলচ্চিত্র, নাটক, উপন্যাস, ইতিহাস গ্রন্থ তৈরিতে সরকারী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

া ২০২৫ সালকে ‘শমসের গাজী বর্ষ’ ঘোষণা করে ফেনী জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বছরব্যাপী কর্মসূচি দিতে হবে।