জুলাই অভ্যুত্থানের পর শুধু রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নয়, সাংস্কৃতিক বন্দোবস্ত নিয়েও কথা হচ্ছে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, জুলাই অভ্যুত্থানের সময় যারা একসাথে ছিলেন, তারা এখন আর সেভাবে নেই। বলা যেতে পারে, তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। পারস্পরিক দোষারোপের চিত্রও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর কারণ কী? যদি বলি জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সবার লক্ষ্য ছিল এক, অর্থাৎ ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের পতন; সে লক্ষ্য অর্জনের পর তো সবার যার যার নীড়ে ফিরে যাওয়াইটা স্বাভাবিক। এখন সবাই যার যার মতো ভাববে, আপন রাজনীতির বিজয় চাইবে। ফলে রাজনীতির মাঠে এখন যে তর্ক-বিতর্ক বা দ্বন্দ্ব, তা অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। তবে এখানে বলার মত বিষয় হলো, দ্বন্দ্বটা যেন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বাইরে চলে না যায়। কারণ সীমালংঘন প্রগতির বদলে দুর্গতিই ডেকে আনে, যা লক্ষ্য করা গেছে ফ্যাসিবাদী আমলে। তাই বর্তমান সময়ের রাজনীতিবিদদের অনেক কিছুই শেখার আছে ফ্যাসিবাদী আমল থেকে। সময়টা বসন্তকাল হলেও আগুনে হাত দিলে হাত কিন্তু পুড়বেই। কাউকে ক্ষমা করবে না আগুন, যেমন ক্ষমা করেনি হাসিনাকে। সুসময়েও আগুনের স্বভাবকে সমীহ করতে হবে, নৈতিক পতনকে ভয় করতে হবে। জবরদস্তির সংস্কৃতি পরিহার করতে হবে। রাজনৈতিক দল তো নিজ আদর্শের বিজয় চাইবে, সরকারও গঠন করতে চাইবে, কিন্তু কাজটা তো সহজ নয়। এ দৌড়ে অনেক প্রতিপক্ষ। এখন করণীয় কী? স্বাভাবিক ও সঙ্গত করণীয় হলোÑ ‘মানসম্পন্ন কাজ’ এবং ‘জনসমর্থন অর্জন’। এখানে শুধু ত্যাগ নয়, ধৈর্যও প্রয়োজন। যাদের ধৈর্য কম তারা অনৈতিক পথে এগুতে চাইবে। চাতুর্যের কারিগররা নানা সংক্ষিপ্ত পথ আবিষ্কার করবে, মন্দলোকদের জড়ো করবে এবং রাজনীতিকে ব্যবহার করবে শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে। জুলাই অভ্যুত্থান-এ রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকীতে এ বিষয়টি স্পষ্ট কন্ঠে উচ্চারণ করতে চাই।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকীতে সাংস্কৃতিক বন্দোবস্তের কথাও শোনা গেছে। বিষয়টি নিয়ে সেমিনারও হয়েছে। অনেক সময় মনে হয়, সাংস্কৃতিক বন্দোবস্তের বিষয়টা রাজনৈতিক বন্দোবস্তের চাইতেও কঠিন। কারণ সাংস্কৃতিক বন্দোবস্তের বিষয়টা জনপদের মানুষের ধর্ম-দর্শন, বোধ-বিশ^াস ও আশা-আকাক্সক্ষার সাথে জড়িত। অথচ কোনো দেশের মানুষের ধর্ম-দর্শন ও বোধ-বিশ^াস তো এক রকম নয়। তাহলে করণীয় কী হবে? একটার ওপর অন্যটা চাপিয়ে দিতে হবে, নাকি প্রত্যেকের জন্য জায়গার বন্দোবস্ত করে দিতে হবে? বিষয়টিকে জনৈক মনীষী এভাবে বলেছেন, ‘এখন জগৎজুড়িয়া সমস্যা এই নহে যে, কি করিয়া ভেদ ঘুচাইয়া মিলন হইবে; কিন্তু কী করিয়া ভেদ রক্ষা করিয়া মিলন হইবে, সেইটাই আসল কথা। এইখানে কোনো ফাঁকি চলে না, প্রত্যেকের জন্য প্রত্যেকের জায়গা ছাড়িয়া দিতে হয়।’ এখানে সবার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু সাংস্কৃতিক মিশ্রণের কথা বলা হয়নি। বলা হয়েছে ফেডারেশনের কথা। যার যার সংস্কৃতি সে পালন করবে, কোনো জবরদস্তি নেই। এখানে ‘ইনক্লুসিভ’ ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, আমাদের প্রিয় স্বদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান এবং উপজাতীয় জনগোষ্ঠীÑ নিজেদের সংস্কৃতি পালন করতে পারলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা আরোপ করা হয়েছে। সংস্কৃতি তো মানুষের ধর্ম-দর্শনের রূপময় প্রকাশ। মুসলমানদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হতে পারে না। ইসলাম যেহেতু শুধু উপাসনার ধর্ম নয় বরং পূর্ণাঙ্গ একটি জীবন ব্যবস্থা; ফলে ইসলামের সাংস্কৃতিক রূপ বেশ ব্যাপক। এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মুসলমানদের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, বিয়ে-শাদি, পোশাক-আসাক, বিনোদনের ক্ষেত্রে, নামাজ-রোজা, দান-সাদকা সবখানে। এ বিষয়গুলো খুবই স্বাভাবিক এবং মৌলিক। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলা, মুসলমানরা যখন তাঁদের ধর্ম-দর্শনের আলোকে জীবনযাপন করতে চায়, তখন তাঁদের সাম্প্রদায়িক কিংবা মৌলবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অথচ অন্যরা তাঁদের ধর্মের আলোকে জীবনযাপন করলে সেভাবে চিহ্নিত করা হয় না। সেভাবে চিহ্নিত করা উচিতও নয়। তাহলে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ক্ষেত্রে এ বৈষম্য কেন? আশা করি জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে মুসলমানরা মন্দ প্রপাগা-ার আগ্রাসন থেকে রেহাই পাবে।

এ আগ্রাসনটা হঠাৎ করে শুরু হয়নি। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জমিনের খোঁজ খবর নিলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এর পেছনে রয়েছে ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও বেঙ্গল রেনেসাঁর প্রভাব। বেঙ্গল রেনেসাঁ ‘বাংলার নবজাগরণ’ হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেছে। এ বাংলা অবশ্য আমাদের ‘খামার বাংলা’ নয়, কোলকাতাকেন্দ্রিক ‘টাওয়ার বাংলা’। এর মূলে রয়েছে ‘সেকুলারিজম’ তথা ইহলৌকিকবাদিতা। এ মতবাদে ধর্ম তথা পরকাল বিশ^াসের স্থান নেই। অথচ পরকালে বিশ^াস ছাড়া মুসলিম হওয়া যায় না। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জমিনে সেকুলারিজমের বীজ বপিত হয়েছে অনেক আগে। ১৯২৬ সালে ঢাকা শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। এ সংগঠনের মুখপত্র ছিল ‘শিখা’ পত্রিকা। ফলে এদের আর এক পরিচয় ছিল ‘শিখা গোষ্ঠী’। এ গোষ্ঠীর কর্ণধার ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ ও আবুল হুসেন। নামে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ হলেও তাঁদের লক্ষ্য ছিল সেকুলারিজমের প্রতিষ্ঠা। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রদের তাঁরা এ মন্ত্রেই দীক্ষিত করার প্রয়াস চালিয়েছেন। মুসলিম সাহিত্য সমাজ তথা ‘শিখা’ গোষ্ঠীর কর্ণধাররা ইসলাম ধর্মকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে উপস্থাপন করেছেন। গবেষণাগ্রন্থে তার ফিরিস্তি পাওয়া যায়। যেমন-১. ইসলাম ধর্মকে যুগোপযোগী করা, ২. ধর্মের আনুষ্ঠানিক অংশ বাদ দেয়া, ৩. শরিয়তের পরিবর্তন, ৪. ধর্মনেতাদের আদেশ অগ্রাহ্য করা, ৫. ইসলামের চেয়ে মানবধর্মই শ্রেষ্ঠ, ৬. গুণে-মানে রাসূল (সা.)কে অতিক্রম করার মত ঔদ্ধত্যপূর্ণ ঘোষণা। এভাবে ইসলাম ধর্মকে অবজ্ঞা করে তাঁরা সেকুলারিজমের প্রপাগা-া চালিয়ে গেছেন। এর প্রভাব আমরা এখনো লক্ষ্য করছি।

প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ‘ধর্ম’ ও ‘ধর্মযাজক’ এক বিষয় নয়। ইউরোপীয় রেনেসাঁর নেতাদের রাগ ছিল ধর্মযাজকদের ওপর। রাজার অন্যায়কর্মকে সমর্থন করে যাজকরা অপরাধ করেছিলেন। বাইবেল তো তাদের সে অপরাধ করতে বলেনি। তাহলে ব্যক্তির অপরাধের শাস্তি কেন ধর্মকে দেয়া হবে। রেনেসাঁর নেতারা সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। এর ফলাফল কেমন হলো? পাশ্চাত্যে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চর্চা বেড়েছে। পারসোয়েড অব ম্যাটেরিয়ালিজমের কারণে মানুষ অর্থের গোলামে পরিণত হয়েছে। ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সেকুলার তথা ইহলৌকিকবাদী হওয়ার কারণে মহান ¯্রষ্টার কাছে জবাবদিহিতার চেতনা লোপ পেয়েছে, যেটি নৈতিকতা ধসের বড় কারণ। পাশ্চাত্যে প্রোডাক্টিভিটি তথা উৎপাদনশীলতা বাড়লেও ক্ষয় দেখা দিয়েছে পারস্পরিক আস্থা ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে। ফলে বাড়ছে মারণাস্ত্র প্রতিযোগিতা ও যুদ্ধবিগ্রহ। বাড়ছে বৈষম্য ও বর্ণবাদ। এমন সভ্যতা দিয়ে মানুষ কী করবে? এ সভ্যতায় পেশি তথা মারণাস্ত্র বড় হয়ে উঠেছে। ফলে মানুষ নিজ ধর্ম-দর্শন তথা সংস্কৃতি নিয়ে বিকশিত হওয়ার অধিকার হারাচ্ছে। সেকুলারিজমের মোড়কে সাংস্কৃতিক বন্দোবস্ত ইনক্লুসিভ না হয়ে এক্সক্লুসিভ হয়ে উঠছে। আমাদের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অবস্থান এর বিপরীতে। আমরা সবার স্বকীয়তায় বিশ^াসী।