আত্মহত্যা একটি বিধংসী প্রবণতা-যা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে অস্থির করে তুলে। সড়ক দুর্ঘটনার পর বাংলাদেশে মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহৎ কারণ হলো আত্মহত্যা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপে বলা হয় যে, দেশে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৩২ জন মানুষ আত্মহত্যার মাধ্যমে জীবন শেষ করে দিচ্ছেন। নারীদের তুলনায় পুরুষদের এবং শহরের তুলনায় গ্রামে আত্মহত্যার হার বেশি। এ সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে কেউ যেতে নাহি চায়, সেখানে কিছু মানুষ নিজের জীবন নিজেই শেষ করে দিচ্ছে, যা মোটেও কল্যাণকর নয়। আত্মহত্যা করার পেছনের কারণগুলো আমরা জানি না। তবে যৌতুক, পারিবারিক কলহ, প্রেমে ব্যর্থতা, হতাশা, বেকারত্ব, প্ররোচনা, মানসিক চাপ ও হতাশা ইত্যাদি কারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। ভয়াবহ বিষয় হলো- স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে, যা রীতিমতো উদ্বেগজনক। আত্মহত্যাকারীদের সিংহভাগের বয়স চল্লিশের নীচে। নারীর ক্ষেত্রে ১৫ থেকে ১৭ বছর এবং পুরুষের ক্ষেত্রে ১৮ থেকে ২৪ বছর। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যা রীতিমত উদ্বেগজনক।

সম্প্রতি রাজশাহীর পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের বামুনশিকড় গ্রামে ঋণের বোঝা আর ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মিনারুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি স্ত্রী ও দু সন্তানকে হত্যা করার পর নিজের জীবনকেও শেষ করে দিয়েছেন। কেন তিনি এ পথ বেছে নিলেন তা আমরা জানি না। কিন্তু তার চলে যাওয়া কত যে কষ্টের, কত যে বেদনাদায়ক তা ভুক্তভোগী পরিবার ব্যতিত অন্য কেউ অনুধান করতে পারবে না। কারণ যার যায়, সে বুঝে বিচ্ছেদের কী যন্ত্রণা! মিনারুল ইসলামের কষ্টের ভার আমরা কেউ নিতে পারিনি। ফলে তিনি অভিমান করে চলে গেলেন। চলে যাওয়ার আগে চিরকুটে কিছু কথা লিখে গেছেন যা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তার কিছু অংশ নিচে উল্লেখ করা হলো-

‘‘আমরা চারজন পৃথিবী থেকে বিদায় নেব, আর দেখা হবে না। খোদা হাফেজ। আমি মিনারুল। নিচে যেসব লেখা লিখব, সব আমার নিজের কথা। এ কারণে লিখে যাচ্ছি, কারণ আজ রাতে আমরা চারজন মারা যাব। এ মরার জন্য কারও কোনো দোষ নেই। কারণ লিখে না গেলে পুলিশ কাকে না কাকে ফাঁসিয়ে টাকা খাবে। আমি মিনারুল প্রথমে আমার বউকে মেরেছি। তারপর আমার মাহিনকে মেরেছি। তারপর আমার মিথিলাকে মেরেছি। তারপর আমি গলায় ফাঁস দিয়ে মরেছি। আমাদের চারজনের মরা মুখ যেন বাবার বড় ছেলে ও তার বউ-বাচ্চা না দেখে এবং বড় ছেলে যেন জানাযায় না যায়। আমাদের চারজনকে কাফন দিয়ে ঢাকতে আমার বাবা যেন টাকা না দেয়। এইটা আমার কসম। (ইতি মিনারুল)

চিরকুটে মিনারুল আরো লেখেন- ‘‘এ কারণে যে আমি যদি মরে যাই, তাহলে আমার ছেলেমেয়ে কার আশায় বেঁচে থাকবে? কষ্ট আর দুঃখ ছাড়া কিছুই পাবে না। ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে আমরা বেঁচে থাকার চেয়ে মরে গেলাম, সে ভালো। কারো কাছে কিছুই চাইতে হবে না। আমার জন্য কাউকে কারো কাছে ছোট হতে হবে না। আমার জন্য আমার বাবা অনেক লোকের কাছে ছোট হয়েছেন। আর হতে হবে না। চিরদিনের জন্য চলে গেলাম। আমি চাই সবাই ভালো থাকেন। ‘‘তোরা আমাকে আমার বাবার কাছে নিয়ে যা। আমি বাবাকে একটু ছুঁয়ে দেখি। কী অভিমানে বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেল’’ কথাগুলো বলছিলেন আর বিলাপ করছিলেন চট্টগ্রামে মাথায় গুলীবিদ্ধ অবস্থায় লাশ উদ্ধার হওয়া র‌্যাবের কর্মকর্তা পলাশ সাহার মা আরতী সাহা। ছেলের কপালে চুমু খেয়ে আহাজারি করছিলেন সন্তানহারা মা। চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ে র‌্যাব-৭ ক্যাম্পে নিজের কক্ষ থেকে পলাশ সাহার মাথায় গুলীবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। এ সময় পাশে একটি চিরকুটও পাওয়া যায়। র‌্যাবের ধারণা, নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে পলাশ আত্মহত্যা করেছেন। পলাশ সাহা ৩৭ তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশে যোগ দিয়েছিলেন। র‌্যাবে তিনি সহকারী পুলিশ সুপার পদে কর্মরত ছিলেন। তাঁর বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার তাড়াশি গ্রামে।

মানুষ বাঁচার জন্য ভাসমান খড়কুটোও আঁকড়ে ধরে। কিন্ত মিনারুল ও আগামী দিনের ভবিষ্যত কর্ণধার কিছু মেধাবী শিক্ষার্থী আত্মহত্যার মত জঘন্যতম পথ বেছে নিচ্ছে, যা মেনে নিতে হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। স্বাভাবিক মৃত্যু যেখানে আমরা মেনে নিতে পারি না, সেখানে আত্মহত্যার মৃত্যু মেনে নেয়া কত যে কষ্টের তা কেবল ভুক্তভোগী পরিবারই অনুধাবন করতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে’। অথচ এ সুন্দর ভুবন ছেড়ে চলে যেতে শিক্ষার্থীরা বড্ড তাড়াহুড়া করছে। বিশেষ করে এসএসসি, এইচএসসি এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর অকৃতকার্য বা আশানুরূপ ফল যে সব শিক্ষার্থীরা করতে পারেনি তাদের মধ্যে আত্মহত্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। ১০ জুলাই ২০২৫ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার পর ১২ জুলাই পর্যন্ত মোট ১৬ জনের আত্মহত্যার খবর পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হয়েছে। বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আচঁল এর ভাষ্যমতে ২০২৩ সালে সারাদেশে ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিল। এর মধ্যে স্কুল শিক্ষার্থী ২২৭ জন, কলেজ শিক্ষার্থী ১৪০ জন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ৯৮ জন। ২০২২ সালে আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থী ছিল ৫৩২ জন। ২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন সন্ধ্যা নাগাদই ৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিল। শিক্ষার্থীদের আত্মহনন শুধু পরিবার নয়, জাতির জন্যও এক বিরাট ক্ষতি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আর্থিক সহায়তায় জাতীয় জরিপ (২০২২-২৩) করেছে সেন্টার ফর ইনজুরি গ্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ, বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এর ভাষ্যমতে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ২০ হাজার ৫০৫ জন আত্মহত্যা করেন। প্রতিদিন গড়ে ৫৬ জন দেশের কোথাও না কোথাও আত্মহত্যা করছেন। প্রতি লাখে আত্মহত্যা করেছেন ১২ দশমিক ৪ জন।

আত্মহত্যা মহাপাপ। এটি কারও অজানা নয়। ইসলামে আত্মহত্যা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ। হাদিসে বলা হয়েছে- ‘‘আমার বান্দা নিজেকে হত্যা করার ব্যাপারে বড় তাড়াহুড়া করেছে। আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম’’-(বুখারি ও মুসলিম)। উঠতি বয়সী তরুণ তরুণীরা আবেগপ্রবণ হয়, অভিমানী হয়। আগাগোড়া না ভেবেই তারা ভুল পথে পা বাড়ায়। এক্ষেত্রে বাবা, মা ভাইবোন সবার সহনশীল হওয়া প্রয়োজন। তাদের দুঃখ বেদনা, চাওয়া পাওয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া দরকার, যেন তারা নিজেকে অবহেলিত মনে না করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা ক্রমশই বাড়ছে; যা রীতিমত উদ্বেগের কারণ। প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনা বেদনাদায়ক। আত্মহত্যা বাড়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে যেমন : সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, অনাচার, দুর্নীতি, সব কিছুর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার ব্যর্থতা, পারিবারিক সম্পর্কের শিথিলতা, শঠতা, কম বয়স, স্বল্প শিক্ষা, বিচ্ছিন্ন পরিবার, আর্থিক সমস্যা, পরীক্ষায় ভালো না করা, অভিমান, বাবা মায়ের বকুনী, প্রেমঘটিত কারণ, অতিরিক্ত পড়াশুনার চাপ, সহপাঠী বা বন্ধুবান্ধব দ্বারা অপমানিত হওয়া, পরিবারের-অশান্তি, মাদকে আসক্তি, পড়াশোনায় ভাল ফলাফল করতে না পারার জন্য গঞ্জনা- সর্বোপরি সামাজিক অস্থিরতা।

আত্মহত্যার দায় পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের। আত্মহত্যা ঠেকাতে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করা জরুরি। তরুণ-তরুণীদের দুঃখ, অভিমান, চাওয়া-পাওয়ার প্রতি বাবা-মা ও অভিভাবকদের সংবেদনশীল হতে হবে। স্কুল ও কলেজের পাঠ্যক্রমে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক পাঠ্য অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের মানসিক চিন্তাচেতনা নিবিড়ভাবে খেয়াল করা। কীটনাশক ও ঘুমের ওষুধের সহজলভ্যতা কমাতে হবে। প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঘুমের ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে হবে। সামাজিক অস্থিরতা, আর্থিক সমস্যা, হতাশা ও আসক্তির বিরুদ্ধে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। উন্নত দেশগুলো যেমন ব্যবস্থা নিয়ে আত্মহত্যার হার কমাতে সক্ষম হয়েছে, আমরাও চাইলে তা পারব। আত্মহত্যা কখনো সমাধান হতে পারে না। প্রতিটি আত্মহত্যা একটি পরিবারের স্বপ্নকে গুড়িয়ে দেয়, সমাজকে শোকে আচ্ছন্ন করে তুলছে। তাই আমাদের প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে-‘‘আত্মহত্যা নয়, জীবনকে ভালোবাসাই হলো মুক্তির পথ।

লেখক : প্রাবন্ধিক।