শতদল বড়ুয়া

মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হলো “যৌবন”। এ যৌবনের অপরিহার্য একটা অংশ হচ্ছে যুবসমাজ। যে কোনো দেশ কিংবা জাতির যুবশক্তি হচ্ছে সে জাতি বা দেশের কর্মশক্তির মূল উৎস। জাতির উন্নয়নকল্পে যুবসমাজকে সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগাতে হবে। দায়সারা গোছের পরিকল্পনা জাতির সর্বনাশের মূল কারণ। উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, যুবসমাজের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের এ দেশ তৃতীয়বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর অন্যতম। এ দেশের বৃহৎ অংশের জনগোষ্ঠী গ্রামে বাস করে। তাই গ্রামকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা যুৎসই নয়। গ্রামের মানুষের মাথাপিছু আয় অনেক কম। যার কারণে তারা অতিকষ্টে জীবন অতিবাহিত করে। অধিকাংশ গ্রামবাসী সহজসরল জীবনযাপন করে বিধায় তারা তেমন কোনো ঝুটঝামেলায় জড়াতে চায় না।

প্রায় ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এ ভূখণ্ডে জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত সমস্যা ও সম্পদের সীমাবদ্ধতা যতোখানি সমস্যার সৃষ্টি করেছে তার চেয়েও অধিক সমস্যা জিইয়ে রেখেছে বেকারত্ব, জনসংখ্যা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি, সম্পদের অপ্রতুলতা এবং একমাত্র কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা দেশকে ক্রমাগত পিছিয়ে দিচ্ছে। কোনো অবস্থাতে অর্থনীতিকে চাঙা করা যাচ্ছে না। রুগ্ন অর্থনীতিকে সুস্থ করতে হলে সুষ্ঠু পরিকল্পনা মোতাবেক দেশের যুবসমাজকে কাজে লাগাতে হবে। গ্রামের দৈন্যতা ঘুচাতে এ ধরনের প্রয়োজনীয়তা বহুকাল আগে থেকে অনুভূত হচ্ছে। গ্রামের উন্নয়নে সরকার নানা শ্লোগান প্রবর্তন করছে। কেউ বলছে, গ্রাম বাঁচলে দেশ বাঁচবে, কেউ বলছে, গ্রামের উন্নয়ন ছাড়া জাতীয় সমৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। আবার কেউ বলছে, গ্রাম পর্যায়ে সবুজ বিপ্লব করে দেশকে উন্নত করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। এ শ্লোগানের যে একেবারে প্রতিফলন ঘটছে এমন নয়, শতভাগ পারফেক্ট সফলতায় পৌঁছা হলো সকলের লক্ষ্য।

দেশ যেহেতু এখনো কৃষি নির্ভর এবং দেশের শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি লোক গ্রামে বাস করে এ কারণেই গ্রামের উন্নয়ন মানে দেশের উন্নয়ন। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো কয়েক যুগ ধরে শ্লোগানের মর্মবাণী কোনো সরকার তেমন প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। গ্রাম উন্নয়নের স্থায়ী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ একান্ত অপরিহার্য বিষয়। রাজনৈতিক সুবিধার প্রয়োজনে গ্রাম উন্নয়নের ধারা বক্তৃতা বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। ফলে গ্রামের উন্নয়নের ক্ষেত্রে সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া যে তিমিরে ছিলো সে তিমিরেই রয়ে গেছে।

এ দেশে খাদ্য সংকটের পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে শত চেষ্টা করেও কোনো সুফল আসছে না। নানা সমস্যায় জর্জরিত আমাদের এ দেশের ৬৮ হাজার গ্রাম। মৌলিক অধিকার রক্ষায় আমরা কতটুকু সচেতন? গ্রামীণ মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার বঞ্চিত। এর কারণ হিসেবে বলা যায় জনসংখ্যার ব্যাপক স্ফীতি, বেকার সমস্যা এবং শিক্ষার অভাব। সঠিক কর্মপন্থা উদ্ভাবন করতে না পারাও একটা অন্তরায়। এসব নানাবিধ সমস্যা গ্রাম পর্যায়ে জগদ্দল পাথরের মতো আঁকড়ে ধরেছে। হরেকরকম সমস্যা থেকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে হলে দেশের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশে অর্থাৎ দেশের যুবসমাজকে গ্রাম উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে। গ্রামীণ কাজেরও অনেক রকমভেদ রয়েছে। কাজের ক্ষেত্র বুঝে যুবকদের যোগ্যতা অনুসারে কাজে নিয়োজিত করা গেলে গ্রাম তথা দেশের উন্নয়ন সম্ভব।

আমাদের দেশ যেহেতু কৃষি প্রধান দেশ সেহেতু কৃষকের সুযোগ-সুবিধার কথাও আমাদের ভাবতে হবে। গ্রামের যুবকদের সংগঠিত করে সমবায় সমিতি গঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ভূমিকা এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। প্রশাসন যদি এ ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে গ্রামীণ বেকার যুবকদের তালিকাভুক্ত করে মাছচাষ, হাঁস-মুরগির খামার, কৃষি খামার, বিভিন্ন রকমের কুটিরশিল্প স্থাপন ইত্যাদি কার্যক্রম হাতে নেয় তাহলে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বেকার যুবকদেরও কর্মের একটা পরিবেশ সৃষ্টি হবে। গ্রামে অনেক শিক্ষিত বেকার যুবক রয়েছে। এদের মাধ্যমে গণশিক্ষা প্রবর্তন, নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা, পরিবার পরিকল্পনাতে যুবকদের অন্তর্ভুক্তসহ নানাবিধ কার্যক্রমে যুবসমাজকে নিয়োজিত করা গেলে এর সুফল দেশবাসী ভোগ করবে। এ সমস্ত কাজে দরকার ফান্ড। ফান্ডের ব্যাপারে বিত্তশালীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বিত্তশালীদেরও উচিত উপযুক্ত স্থানে অর্থ দিয়ে দেশের দারিদ্র্যতা দূরীকরণে এগিয়ে আসা।

আমাদের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ লেখাপড়া জানে না। এদের অক্ষর জ্ঞান দেওয়ার জন্যে প্রয়োজন নৈশ বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ে যারা পাঠদান করবে তাদের আর্থিক দিকও বিবেচনায় রেখে দেশে বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যবস্থা নিলে ক্রমান্বয়ে দেশের মানুষ শিক্ষিত হয়ে উঠবে। কারণ শিক্ষার বিকল্প ছাড়া সমাজের মধ্যে আত্মসচেতনতা সৃষ্টি করা যায় না। আর আত্মসচেতনতা ছাড়া জাতির উন্নতি আশা করা বাতুলতা মাত্র।

সরকারি পর্যায়ে পরিবার কল্যাণ সহকারী এবং সংগঠকদের পাশাপাশি যুবসমাজকে নিয়োজিত করে কার্যক্রম পরিচালনা করলে ইতিবাচক ফল লাভে আমরা সক্ষম হবো। আমাদের দেশের কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা বছরের বেশ উল্লেখযোগ্য সময় অতিবাহিত হয় বিভিন্ন ছুটিতে। এ ছুটিকালীন সময়টুকু যদি ছাত্র ছাত্রীরা গ্রামে গিয়ে গ্রাম উন্নয়নের কাজে বোনাস সময়টুকু ব্যয় করে তাহলে সমাজ তথা দেশের লাভ। অভিভাবকরা এ বিষয়ে ভাবলে এবং তাদের ছেলেমেয়েদের গ্রাম উন্নয়ন কাজে উৎসাহিত করলে ছাত্র ছাত্রীরাও অনুপ্রেরণা পাবে।

উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে গ্রাম আর শহরের মধ্যে মাথাপিছু আয় আমাদের দেশের মতো এতো অসম নয়। তার একমাত্র কারণ হলো সেসব দেশের গ্রামগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি ও উন্নয়নের নানা রকম আয়োজনে কর্মমুখর পরিবেশ। আমাদের দেশের গ্রাম ও শহরের মধ্যে বিস্তর ফারাক। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তারা আর গ্রামে যেতে চায় না। শিক্ষিত যুবসমাজ গ্রামকে উন্নয়ন বঞ্চিত আখ্যা দিয়ে গ্রামমুখী হতে নারাজ, এধরনের ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণিত করতে হলে সরকারকেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নানা শ্লোগানে কার্যক্রম সীমাবদ্ধ না রেখে প্রকৃত উন্নয়ন কীভাবে করা যায় সেই চিন্তা ভাবনা করার সময় এসে গেছে। গ্রাম অঞ্চলে চলছে কৃষকদের দুর্যোগকাল। সারের দাম বৃদ্ধিসহ উৎপাদন ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা পরিমিত চাষবাস করতে পারছে না। এখনই তাদের পাশে দাঁড়াতে না পারলে এর প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে। বর্তমান সরকারের নানা উদ্যোগ কৃষকদের জন্যে আপাতদৃষ্টিতে শুভ মনে হলেও সরকারের যা আয়োজন তা কৃষকদের প্রয়োজনে খুবই নগণ্য। কৃষকদের সাহায্য সহযোগিতা বন্টনে যাতে পেশীশক্তির প্রভাব না লাগে সেই দিকেও দায়িত্বপ্রাপ্তদের নজর রাখতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।