জাফর আহমাদ

মানুষ সামাজিক জীব। সে একা কখনো বাঁচতে পারে না। সমাজে টিকে থাকতে হলে তাকে সমাজের সহযোগিতা গ্রহণ করতে হয়। এ সহযোগিতার অংশ হিসাবে একজন অন্যজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ঋণ গ্রহণ ও ঋণ পরিশোধ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এ জন্য ইসলাম ঋণদান এবং ঋণ পরিশোধ করার ব্যাপারে একটি উৎকৃষ্ট ও ভারসাম্যপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। ইসলাম ঋণ গ্রহণ ও প্রদান করার যেমন অনুমতি দিয়েছে তেমনিভাবে যথাসময়ে সে ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে কঠোর নির্দেশও প্রদান করেছে।

ঋনের পরিচয় : ঋণ, কর্জ ও খড়ধহ বিভিন্ন ভাষার সমার্র্থবোধক শব্দ। খড়ধহ ইংরেজী, ঋণ বাংলা ও কারদ্ বা কর্জ আরবী ভাষার শব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু বর্তমান সমাজ অনেকটা বলপূর্বক শব্দগুলোর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ভাবার্থ সৃষ্টি করেছে। কর্জ প্রকৃত বা স্ব-ভাবার্থ নিয়ে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় অটুট আছে। কিন্তু একই অর্থবোধক ঋণ ও লোন শব্দের আসল রূপকে সুবিধাবাদী লোকেরা পরিবর্তন করে নিজেদের শোষণের হাতিয়ারের ভাবার্থে ব্যবহার করছে। অর্থাৎ লোন ও ঋণের সাথে অতিরিক্ত কিছু যোগ করে (যাকে সুদ বলা হয়) মানুষকে শোষণ করছে। তাই লোন ও ঋণ বলতে মানুষ এখন সুদী লেনদেনই বুঝে থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে খড়ধহ, ঋণ ও কর্জ শব্দগুলো সমপরিমাণ লেনদেনকেই বুঝায়। অতিরিক্ত কিছু দাবী করলে তাকে আর খড়ধহ, ঋণ ও কর্জ বলা যাবে না।

কাউকে ধার, কর্জ, ঋণ বা লোন দেয়ার পর তার ওপর অতিরিক্ত কিছু নেয়া যাবে না। অতিরিক্ত অর্থ তো দূরের কথা এমনকি এতে অনার্থিক সুবিধা তথা বাহবা, কৃতিত্ব বা সুনাম অর্জনের নিয়তও কেউ করতে পারবে না। কারণ সমপরিমাণ ফেরত দেয়ার শর্তে কাউকে নির্ধারিত সময়ের জন্য কোন কিছু ব্যবহার বা উপকার লাভের সুযোগ দেয়ার নামই যেহেতু ঋণ, লোন, কর্জ বা ধার, সেহেতু অতিরিক্ত কোন কিছুই আশা করা যাবে না। আজও আমাদের সমাজের মানুষ কর্জ বলতে বুঝে কারো আপদ বিপদে একমাত্র তার উপকারের নিমিত্তে কোন কিছু কর্জ দেয়া। আমাদের মা-বোনেরা সামান্য লবণ থেকে নিয়ে অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস প্রতিবেশীর কাছ থেকে কর্জ নেয় এবং যে বান্ডল বা যে পরিমাণ গ্রহণ করে, ঠিক সে পরিমাণই ফেরত দেয়। ঋণ বা কর্জ এগুলোর প্রচলনই হয়েছে প্রতিবেশী-প্রতিবেশীর মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ, প্রেম-প্রীতি ও ভালবাসার বন্ধনকে সূদৃঢ় করার জন্য।

ইসলামের বিধান হচ্ছে পৃথিবীর সকল সম্পদের একচ্ছত্র মালিক আল্লাহ্ তা’আলা। পৃথিবীর মানুষ এর ট্রাস্টি বা আমানতদার মাত্র। কাজেই আল্লাহ তা’আলার এ সম্পদ হতে মানুষ সমানভাবে উপকৃত হবে। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র নামক দু’টি প্রান্তিক মতবাদের মাঝে ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণ ও সুষম অর্থনীতির উপহার দিয়েছে। ইসলাম ব্যক্তি ও সমাজের স্বার্থকে এক সাথে দেখে। একদিকে ব্যক্তিকে তার সমৃদ্ধির উৎসাহ দেয়, অন্যদিকে ব্যক্তি সমাজের অংশ হিসাবে সমাজের অন্যান্যদের সুখ ও সমৃদ্ধি সাধনের দায়িত্ব অর্পন করেছে। আর এটিই ভ্রাতৃত্ববোধ। ভ্রাতৃত্ববোধের প্রতিফলন তখনি ঘটে যখন আপদে বিপদে একে অপরকে নিঃস্বার্থভাবে কর্জ, ঋণ বা লোন দেয়। কিন্তু মানুষের স্বভাব প্রকৃতি আজ এমনভাবে রুক্ষ ও দয়ামায়াহীন প্রাণীসদৃশ পরিণত হয়েছে যে, ভ্রাতৃত্ববোধ বলতে কোন কিছুরই পরোয়া করে না। এমনকি গৃহস্থালীর কাজে ব্যবহৃত ঘরের ছোট্ট নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসটি কিছুক্ষণের জন্য অন্যকে ধার দিতেও কৃপণতা করে। এদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “সুতরাং দুর্ভোগ সেই সালাত আদায়কারীর, যাহারা তাহাদের সালাত সম্বন্ধে উদাসীন, যাহারা লোক দেখানোর জন্য উহা করে এবং গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় ছোটখাটো সাহায্য দানে বিরত থাকে।” (সুরা আল মাউন) এ সুরার শেষের আয়াতের ব্যাখ্যায় বিভিন্ন হাদীস বিশারদ, রাবী ও মুফাচ্ছিরগণ যাকাত থেকে নিয়ে মানুষের গৃহস্থালীর কাজে লাগে এ ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন, হাড়ি-পাতিল, বালতি, দা-কুড়াল, দাঁড়িপাল্লা, লবণ, পানি, আগুন, দেয়াশলাই ইত্যাদি উল্লেখ করেছেন।

আমরা আমাদের সমাজে এ ধরনের হীন মনোবৃত্তির কিছু কিছু কৃপণ বলে পরিচিত ব্যক্তিদের দেখেছি তারা এ ধরনের ছোট্ট জিনিসও তার প্রতিবেশীকে সামান্য সময়ের জন্যও ধার দিতে চায় না।

ঋণের প্রয়োজনীয়তা : সমাজের অভাবগ্রস্ত জনগণের নানা কারণে সাময়িকভাবে ঋণ গ্রহণের প্রয়োজন হয়ে পড়ে এবং নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে তা ফিরিয়ে দেয়ার সামর্থ্য নাও হতে পারে। এ এক বাস্তব ব্যাপার এবং অত্যন্ত জটিল সমস্যা। কেননা সাময়িক ও হঠাৎ করে দেখা দেয়ার প্রয়োজন পূরণের জন্য যে টাকার দরকার হয়ে পড়ে, তার ব্যবস্থা না হলে বহু মানুষকেই কঠিন সমস্যার মধ্যে পড়ে যেতে হয়। বহু ব্যক্তি বা বহু পরিবারেরই এ কারণে অপূরণীয় ক্ষতির বা দু:সহ যন্ত্রণার মধ্যে পড়ে যাওয়া স্বাভাবিক। এটি সামাজিক সুস্থতা বা জনগণের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার পরিপন্থী এবং কুরআনী আদর্শের পরিপন্থী।

এ পরিস্থিতিতে সমাজকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বিনা সুদে কোনরূপ অতিরিক্ত পাওয়ার আশা ব্যতিরেকে ‘করযে হাসানা’ উত্তম ঋণ প্রদান করতে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “কোন লোক আল্লাহকে উত্তম ঋণ দিতে প্রস্তুত? তাহলে তিনি তাকে বহুগুণ বৃদ্ধিসহ ফিরিয়ে দেবেন। আসলে আল্লাহ তা’আলাই সংকীর্ণ করেন এবং প্রশস্ত করেন। তাঁরই দিকে তোমাদের সকলকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।” (সুরা বাকারা:২৪৫) আয়াতটিতে প্রথমত, আল্লাহ নিজেই ঋণ চেয়েছেন। কাদের জন্য? সমাজের যে সব লোকের সাময়িক ঋণের প্রয়োজন, তাদের জন্য। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, সমাজে এমন লোক অবশ্যই থাকবে, যাদের সাময়িক ঋণের প্রয়োজন হবে, এটি আল্লাহ দুনিয়ার নিয়ম। যাতে মানুষের মধ্যে এই কর্তব্যবোধ সৃষ্টি হয় যে, তারা সেখানে এমন এক সমাজ কায়েম করবে যেখানে মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হবে। আর এই ভ্রাতৃত্ব টানে একে অন্যের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য নিজেদের দায়িত্বজ্ঞান মনে করবে। কারণ এটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, ঠেকায় পড়া লোকগুলোর পক্ষ থেকে আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা নিজেই ঋণের প্রার্থী হয়েছেন এবং ঋণদাতা ঋণ দিয়ে বাড়তি যা পেতে চায়, তা তিনি নিজে দিয়ে দিবেন বলে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে কী ঋণপ্রার্র্থী তো এমনিই ঠেকায় পড়েছে, তার কাছে বাড়তি কিছু চাওয়া মানে বিপদগ্রস্তকে আরো বেশী করে বিপদের গর্তে ঠেলে দেয়া।

ঋণ পরিশোধের তাগিদ : ইসলাম ব্যক্তিকে মানুষের প্রয়োজনে ঋণ প্রদানে যেমন উৎসাহ প্রদান করেছে তেমনি ঋণগ্রহীতাকে সময় মতো ঋণ পরিশোধে বিশেষভাবে নির্দেশ প্রদান করেছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় আমানত তার হকদারদের হাতে ফেরত দেবার নির্দেশ দিচ্ছেন।(সুরা নিসা:৫৮) আবু হুরাইরা রা: হতে বর্ণিত। নবী (সা:) বলেছেন: যে ব্যক্তি মানুষের মাল (ধার) নেয় পরিশোধ করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’আলা তা আদায়ের ব্যবস্থা করে দেন। আর যে তা নেয় বিনষ্ট করার নিয়্যাতে আল্লাহ তা’আলা তাকে ধ্বংস করেন। (বুখারী: ২৩৮৭, কিতাবু ফি ইসতেকরাধি বাবু মান আকাজা আমওয়ালিন নাসি......, আ.প্র.২২১২, ইফা:২২২৯) আবু হুরায়রা রা: হতে বর্ণিত। জনৈক ব্যক্তি আল্লাহর রাসুল (সা:)-এর কাছে তার পাওনা আদায়ের কড়া তাগাদা দিল। সাহাবায়ে কিরাম তাকে শায়েস্তা করতে উদ্যত হলেন। তিনি বলেন, তাকে ছেড়ে দাও। কেননা, পাওনাদারদের কথা বলার অধিকার রয়েছে। তার জন্য একটি উট কিনে আন এবং তাকে তা দিয়ে দাও। তাঁরা বললেন, তার উটের চেয়ে বেশী বয়সের উট ছাড়া আমরা পাচ্ছি না। তিনি বললেন, সেটিই কিনে তাকে দিয়ে দাও। কারণ, তোমাদের উত্তম লোক সেই যে উত্তমরূপে ঋণ পরিশোধ করে।” (বুখারী : ২৩৯০,২৩০৫, কিতাবু ফি ইসতেকরাধি, বাবু ইসতিকরাধিল ইবিলি, আ.প্র:২২১৫, ইফা:২২৩২)

তবে অক্ষম, অপারগ ঋণ গ্রহীতাকে অবকাশ দেয়ার কথাও কুরআন ও হাদীসে নির্দেশ প্রদান করেছে। আল্লাহ বলেন, “তোমাদের ঋণগ্রহীতা অভাবী হলে সচ্ছলতা লাভ করা পর্যন্ত তাকে অবকাশ দাও। আর যদি সাদকা করে দাও, তাহলে এটা তোমাদের জন্য বেশী ভালো হবে, যদি তোমরা জানতে।” (সুরা বাকারা:২৮০)

লেখক : ব্যাংকার।