॥ জালাল উদ্দিন ওমর ॥
ছাত্র-জনতার তীব্র গণআন্দোলনে শেখ হাসিনা গত ৫ আগষ্ট পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে গেছেন এবং তিনি এখন ভারতেই আছেন। এর মাধ্যমে শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের দোর্দ- প্রভাবের শাসনের অবসান হয়। গত ৮ আগষ্ট নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। তারা এখন দেশ সংস্কার এবং একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য কাজ করছেন। ক্ষমতা থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোয় পর এদেশ এবং ভারতের কিছু ব্যক্তি ও মিডিয়া এদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের মিথ্যা প্রচার প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে তারা বাংলাদেশে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের প্রতি অনুরোধ, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর কোন নির্যাতন হয়ে থাকলে, তার তথ্য প্রমাণ দিন। কিন্তু অহেতুক মিথ্যা প্রচারণা করবেন না।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতন পরবর্তী কয়েক দিন এদেশে কোন সরকার ছিল না। পুলিশ বাহিনী ছিল নিষ্ক্রিয়। ছাত্রছাত্রীরাই আইন-শৃংখলার দায়িত্ব পালন করেছে। এ সময়ে সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন, বাড়ি ঘর এবং মন্দিরে যাতে কোন ধরনের হামলা না হয়, সেজন্য দল মত ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষ তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, এলডিপি, লেবার পার্টি, গণতান্ত্রিক মঞ্চসহ সকল দলের নেতারা সংখ্যালঘুদের ওপর কোন ধরনের নির্যাতন না করতে এবং জানমাল ও ধর্মীয় উপাসনালয় রক্ষায় তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এসব দলের নেতারা বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের সাথে দেখা করেছে, মিটিং করেছে এবং সবসময় তাদের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। এসব দলের নেতা কর্মীরা সারাদেশে হিন্দুদের মন্দির এবং ঘরবাড়ি পাহারা দিয়েছে। মাদরাসার ছাত্র এবং আলেম ওলামারাও হিন্দুদের মন্দির এবং ঘরবাড়ি পাহারা দিয়েছে। এসবের ছবি মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। এসব কারণে বাংলাদেশের কোথাও হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন মন্দিরে হামলা এবং ভাংচুর হয়নি। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর এবং তাদের বসত-বাড়িতে ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে কোন হামলা হয়নি। যদি হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন মন্দির, বসত-বাড়িতে হামলা এবং কোন লোকজন নির্যাতিত হয়ে থাকে, তাহলে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ দিন এবং এসবের শ্বেতপত্র প্রকাশ করুন। কিন্তু তা না করে কোন ধরনের তথ্য প্রমাণ ছাড়া সংখ্যালঘু নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ করবেন না। এতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয়, অশান্তি ও বিশৃংখলা সৃষ্টি হয় এবং নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা বিঘিœত হয়।
হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর কোন হামলার ঘটনা ঘটে থাকলে তা কোনভাবেই ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে হয়নি। সেটা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক কারণেই হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের কিছু নেতার বাড়ি ঘরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। ক্ষমতাকালীন সময়ে এসব নেতাদের নানা অপকর্মের কারণে নির্যাতিত জনগণ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করতে গিয়ে এসব হামলা করেছে। এখন হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তি যদি আওয়ামী লীগের নেতা হয়ে বিভিন্ন অপকর্ম করে থাকে এবং এজন্য নির্যাতিত জনগণ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করতে গিয়ে এসব নেতাদের বসত-বাড়িতে হামলা করে থাকে, তাহলে সেটা নিশ্চয় ধর্মীয় কারণে হয়নি। এটি সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক কারণেই হয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের আওয়ামী লীগের নেতা ও তাদের বাড়িঘর যেই কারণে হামলার শিকার হয়েছে, একই কারণে হিন্দু সম্প্রদায়ের আওয়ামী লীগ নেতা ও তাদের বাড়িঘর হামলার শিকার হয়েছে। এখানে পুরো ব্যাপারটিই রাজনৈতিক এবং এখানে সাম্প্রায়িকতা ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের কোন ব্যাপার নেই। সারাদেশে মোট ৩০ টার মত এরকম ঘটনা ঘটেছে, যার পুরোটাই রাজনৈতিক। তারপরও আমরা এসব হামলার নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাই। আমরা সবধরনের সহিংসতা ও সন্ত্রাসের বিরোধী এবং সবসময়েই শান্তি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী। অমুসলিমদের জানমালের নিরাপত্তা এবং ধর্ম পালনের অধিকার নিশ্চিত করাটা মুসলমানদের ধর্মীয় দায়িত্বও বটে। ইসলাম কখনো সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে না, তা সমর্থনও করে না। ইসলাম হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং সার্বজনীন মানবাধিকারের গ্যারান্টি। সুতরাং মুসলমানের কাছে অমুসলিমরা স¤পূর্ণ নিরাপদ।
আবহমান কাল থেকেই এদেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ মিলে মিশে এক সাথে বসবাস করছে। বাংলাদেশ একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করছে। এরা সুখে দুঃখে একে অপরের অংশীদার। মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা সবই এদেশে নিরাপদ। অথচ ভারত সবসময় বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ তুলে, যা কখনোই প্রমাণিত হয়নি। ভারতের এক শ্রেণীর মিডিয়া, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদ সব সময় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ তুলে এর পক্ষে সাফাই গায় এবং প্রচার প্রপাগান্ডা চালায়। বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও এদেশে প্রায় ১৫ শতাংশ হিন্দু বসবাস করে। এদেশে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান এবং চাকমা, মারমা, গারো, মুরংসহ বিভিন্ন উপজাতি এক সাথে মিলে মিশে শান্তিতে বসবাস করে। এখানে এক দেশ এক জাতি, আমরা সবাই বাংলাদেশী। অথচ ভারত সকল বাংলাদেশীদের স্বার্থে কথা না বলে, সব সময় শুধুমাত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের স্বার্থে কথা বলে। ভারতের এই আচরণ ভারতকে সার্বজনীন না করে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করেছে। ভারত নিজেকে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি করেছে। ভারতের এসব আচরণ এদেশের সাধারণ মানুষ মেনে নেয়নি। হিন্দুদের বিরাট একটি অংশও আজ ভারতের এই নীতি সমর্থন করে না। এই বাস্তবতা ভারতকে বুঝতে হবে। ভারতের প্রতি অনুরোধ, এদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ বাদ দিন এবং কোন অভিযোগ থাকলে তথ্য প্রমাণ দিন। আসুন আমরা মিথ্যা প্রচারণা বন্ধ করি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখি। এর মাধ্যমে গড়ি সাম্য, শান্তি এবং সম্প্রীতির এক বাংলাদেশ।
লেখক : প্রকৌশলী।