ড. বি এম শহীদুল ইসলাম

একটি নির্যাতিত-নিপীড়িত মুসলমানদের প্রাচীন ভূখণ্ড ফিলিস্তিনের পূণ্যভূমি। এ পবিত্র ভূখণ্ডে জন্ম গ্রহণ করেন অসংখ্য ধর্মীয় মনীষী ও ইসলামের বড় বড় পন্ডিতগণ। ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক স্থান ফিলিস্তিন। খলিফা ওমর (রা) এর যুগে জেরুজালেম বিজয় হয়। তারপর এখানে সাহাবিদের পদচারণা বাড়তে থাকে। অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ অঞ্চলটি জ্ঞানীদের উর্বর ভূমি হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে। ফিলিস্তিনে জন্ম নেয়া সেসব বিখ্যাত কয়েকজন মনীষীকে নিয়ে আজকের এ অবতারণা।

ইমাম ইবনে কুদামা: ইবনে কুদামা ফিলিস্তিনের একজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। তার পুরো নাম আবদুল্লাহ বিন আহমদ ইবনে কুদামা (রহ.)। তিনি হাম্বলি মাজহাবের অনুসারী। ৫৪১ হিজরিতে ফিলিস্তিনের নাবলুসের জামমাইন শহরে ইমাম ইবনে কুদামা জন্মগ্রহণ (১১৪৭ খ্রি.) করেন। তিনি ১৫ খণ্ড বিশিষ্ট ফিকহ বিষয়ক সর্ববৃহৎ গ্রন্থ ‘আল-মুগনি’ রচনা করেছেন। ১১৪৭ সালে ফ্রান্সের রাজা সপ্তম লুই ও জার্মানির রাজা তৃতীয় কনরাডের নেতৃত্বে দ্বিতীয় ক্রুসেড শুরু হয়। তখন তার বাবা আহমদ ইবনে কুদামা পরিবার নিয়ে দামেস্কে চলে যান। সেখানেই ইবনে কুদামা পড়াশোনা করেন। শায়খ আবদুল কাদের জিলানিসহ বাগদাদে অনেক মুহাদ্দিসের কাছে তিনি হাদিস ও ফিকহা শাস্ত্র পাঠ করেন। ইবনে কুদামা ও আবদুল গনি আল-মাকদিসি সম্পর্কের দিক দিয়ে খালাতো ভাই ছিলেন। তাদের মধ্যে বয়সের ব্যবধান ছিল ছয় মাস। হাম্বলি মাজহাবে উভয়ের গুরত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ৫৮৩ সালে সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.)-এর নেতৃত্বে ফিলিস্তিন উদ্ধার অভিযান শুরু হলে ইবনে কুদামা মুসলিম সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ২৭ রজব বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয় পর্যন্ত তাতে অংশ নেন। ৬২০ হিজরির ঈদুল ফিতরের দিন তিনি দামেস্ক শহরে ইন্তিকাল (১২২৩) করেন। ইসলামের খেদমতের তার অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

ইমাম আল-মাকদিসি: ইমাম আল-মাকদিসির পুরো নাম হচ্ছে- ইমাম আবদুল গনি আল-মাকদিসি ফিলিস্তিনের নাবলুসের জামমাইন শহরে ৫৪১ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মস্থান বায়তুল মুকাদ্দাসের নিকটবর্তী হওয়ায় তাকে ‘আল-মাকদিসি’ বলে সম্বোধন করা হয়। ইবনে কুদামা (রহ.)-এর ভাই শায়খ মুহাম্মদ বিন কুদামা ছিলেন তাদের পারিবারিক অভিভাবক। তাই অল্প বয়স থেকেই তার ইলম চর্চা শুরু হয়। তিনি দীর্ঘকাল যাবৎ দামেস্ক, সিরিয়া, ইস্কান্দারিয়া, বায়তুল মুকাদ্দাস, মিসর, বাগদাদ, হাররান, মসুল, ইস্পাহান, হামজানসহ অসংখ্য শহরে সফর করেছেন। শায়খ আবুল মাকারিম বিন হেলাল, সালমান বিন আলী আর-রাহবি ও আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ বিন হামজা আল-কুরাশি, আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-সহ অনেক বিখ্যাত আলেম ও মুহাদ্দিসের কাছ থেকে হাদিস ও ফিকহা সংক্রান্ত বিস্তৃত জ্ঞান বা ইলম অর্জন করেন। পরে তিনি তার পরিবারের সঙ্গে দামেস্কে চলে যান। সেখানকার কাসইউন পর্বতে প্রথম মাদরাসা নির্মাণ করেন; যা ‘আল-মাদরাসাতুল উমারিয়্যা’ নামে পরিচিত। তার পরিবারের সদস্যরা জীবনযাপনে অত্যন্ত সৎ ও বিদ্যানুরাগী হওয়ায় স্থানটি ‘সালেহিয়্যা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। উমদাতুল আহকাম, আল-কামাল ফি আসমাইর রিজাল, আল-মিসবাহসহ হাদিসসংক্রান্ত অনেক গ্রন্থ রয়েছে তার। আরবি ৬০০ হিজরিতে তিনি ইন্তিÍকাল করেন। মিসরের কারাফা নামক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। ইমাম মাকদিসি একজন বিখ্যাত ইসলামী মনীষী পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন।

ইমাম তাবারানি: প্রখ্যাত ইমাম ও মুহাদ্দিস সুলাইমান বিন আহমদ আত-তাবারানি (রহ.) ২৬০ হিজরিতে ফিলিস্তিনের প্রাচীন নগরী আক্কা-বর্তমানে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় একটি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ফিলিস্তিনের শামের তাবরিয়া এলাকার সাথে সম্পৃক্ত করে তাকে ‘তাবারানি’ বলা হয়। তাজরিয়া অঞ্চলের নিকটবর্তী তাঁর বাসস্থান হওয়ায় তাকে তাবারানি নামকরণ করা হয়েছে। তাঁর বাবা এমন একজন বিখ্যাত দ্বীনি ব্যক্তি ছিলেন যিনি তাকে ইলম চর্চার কথা বলতেন। তাই বাবার অনুপ্রেরণায় তিনি শৈশব থেকেই ইলম চর্চা শুরু করেন। আমৃত্যু তা অব্যাহত রাখেন। তিনি দীর্ঘ ১৬ বছর যাবৎ হারামাইন, ইয়েমেন, মাদায়েন, শাম, মিসর, বাগদাদ, কুফা, বসরা, ইস্পাহানসহ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে হাদিস বর্ণনাকারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাদের জীবনী সংকলন করেন। এ বিষয়ে তিনি শতাধিক খণ্ডের অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ কাজের জন্য পৃথিবীর নানা প্রান্তে তিনি ভ্রমণ করেছেন। ৩৬০ হিজরিতে ১০০ বছর বয়সে তিনি ইস্পাহান শহরে ইন্তিÍকাল করেন। আল-মুজামুস সগির, আল-মুজামুল আওসাত, আল-মুজামুল কাবিরসহ তার অনেক বিখ্যাত গ্রন্থ রয়েছে। তাফসীরে তাবারানি তারই লেখা গ্রন্থ।

ইমাম শাফেঈ: ইমাম মুহাম্মদ বিন ইদরিস আশ-শাফেঈ (রহ.) ১৫০ হিজরিতে ফিলিস্তিনের গাজা বা আসকালান অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। দু বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে মক্কায় যান এবং পবিত্র কুরআন হিফজ করেন। এরপর ১০ বছর বয়সে প্রসিদ্ধ হাদিসগ্রন্থ মুয়াত্তা মুখস্থ করেন। ২০ বছরের কম বয়সেই তিনি ফতোয়া দেয়ার অনুমোদন লাভ করেন। মদিনায় গিয়ে ইমাম মালেক বিন আনাস (রহ.)-এর কাছে হাদিস শিক্ষা লাভ করেন। বাগদাদে তিনি ইমাম মুহাম্মদ বিন আল-হাসান আশ-শাইবানি (রহ.)-এর কাছে হানাফি ফিকহ শিক্ষা করেন। ফিকহ, উসুলে ফিকহ, হাদিস ও তাফসির বিষয়ে তার গভীর দক্ষতা রয়েছে। তিনি প্রসিদ্ধ চারটি মাজহাবের অন্যতম শাফেঈ মাজহাবের ইমাম। ২০৪ হিজরিতে মিসরে তিনি ইন্তিÍকাল করেন। হাদিস সংগ্রহ ও সংকলনে তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। তাই তাকে “নাসুরুল হাদিস” বা হাদিসের সাহায্যকারী উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। তাঁর পিতামহ শাফেঈ কুরাইশ বংশের ছিলেন। সাহাবিদের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে শাফেঈ এবং মক্কায় প্রতিপালিত হওয়ায় মক্কী নামে পরিচিত।

রজা বিন হায়াওয়া: প্রখ্যাত তাবেঈ রজা বিন হায়াওয়া (রহ.) ছিলেন ফিলিস্তিন অঞ্চলের বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও উমাইয়া খেলাফতের মন্ত্রী। তিনি বিসয়ান- বর্তমানে ইসরায়েল অধিকৃত দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি জেলা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে বাবার সঙ্গে শাম বিজয়ী প্রখ্যাত সাহাবি মুয়াজ বিন জাবাল (রা.)-এর কাছে এলে তিনি তাকে কুরআন পড়াতে বলেন। তিনি উবাদা বিন সামেত, মুয়াজ বিন জাবাল, আবু দারদা, উম্মে দারদা (রা.)-সহ অনেক সাহাবির কাছে হাদিস ও ফিকহ শিক্ষা লাভ করেন। তাকে শাম ও ফিলিস্তিন অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ আলেমদের মধ্যে গণ্য করা হতো। তিনি শুধু ইবাদতে নিমগ্ন হয়ে ক্ষান্ত হননি, জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন কাজের সাথে জড়িত ছিলেন।

রাষ্ট্রপ্রধানদের সলা-পরামর্শ দিতেন, মানুষের মাঝে ঐক্যের বন্ধন তৈরি করতেন এবং আল্লাহর পথে জিহাদে অংশ গ্রহণ করতেন। ইসলামের জন্য তাঁর অবদান অপরিসীম। দ্বীন পালন, গভীর ইলম ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার গুণে তিনি তিন জন উমাইয়া খলিফার মন্ত্রী ও উপদেষ্টা ছিলেন। তারা হলেন- ওমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.), আবদুল মালেক বিন মারওয়ান (রহ.), সুলাইমান বিন আবদুল মালেক (রহ.)। মূলত তার পরামর্শে ওমর বিন আবদুল আজিজকে খলিফা নিযুক্ত করা হয়েছিল। তার তত্ত্বাবধানে খলিফা আবদুল মালেকের যুগে পবিত্র মসজিদুল আকসা প্রাঙ্গণে কুববাতুস সাখরা নির্মিত হয়। ১১২ হিজরিতে তিনি ইন্তিÍকাল করেন।

ফিলিস্তনে জন্ম নেয়া এসব বিখ্যাত পন্ডিত ও মনীষীগণ ইসলামের খেদমতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। তাই ইসলামের ইতিহাসে তারা চিরদিনের জন্য স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট।