জাফর আহমাদ

আল্লাহ তা’আলা বলেন,“ সে সফলকাম হয়েছে, যে পবিত্রতা অবলম্বন করেছে এবং নিজের রবের নাম স্মরণ করেছে তারপর সালাত পড়েছে।”(সুরা আ’লা:১৪-১৫) এটিই আত্মশুদ্ধির কুরআনী পদ্ধতি। পদ্ধতি গুলো হলো, এক, পবিত্রতা অবলম্বন করা দুই, নিজের রবের নাম স্মরণ করা তিন, নিয়মিত সালাত পড়া। এ পন্থায় যারা আত্মশুদ্ধি করে মূলত তারাই সফলকাম হয়। এ পন্থা বাদ দিয়ে যারা নিজেদের মস্তিস্কপ্রসূত চিন্তা চেতনা দিয়ে আত্মশুদ্ধি করে তারা মূলত ভণ্ড ও তারাই বিফল। আমাদের দেশের আত্মশুদ্ধি ভারতীয় ঋষিবাদ দ্বারা প্রভাবিত, এটি ইসলামী আত্মশুদ্ধি নয়। আত্মশুদ্ধি হতে হবে আল কুরআনের নির্দেশনা ও রাসুলুল্লাহ (সা:) এর প্রদর্শিত পথে। নিজে নিজে কিছু অজীফা বানিয়ে নিলে আত্মশুদ্ধি হয়ে যায় না। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“আসলে ঈমানদারদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন নবী পাঠিয়ে আল্লাহ মু’মিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। সে তাঁর আয়াত তাদেরকে শোনায়, তাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ করে এবং তাদেরকে কিতাব ও জ্ঞান শিক্ষা দেয়। অথচ এ লোকেরাই সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত ছিল।” (সুরা আলে ইমরান : ১৬৪) ঠিক একই কথা বলা হয়েছে সুরা বাকারার ১২৯ নং আয়াতে। দু’টো আয়াতে লক্ষনীয় ব্যাপার হলো, প্রথমত: আত্মশুদ্ধি হতে হবে রাসুল (সা:) এর সুন্নাহ মোতাবেক, দি¦তীয়ত: আল্লাহর আয়াত তথা কুরআন অনুযায়ী। কুরআন না শিখে বা না জেনে আত্মশুদ্ধি করলে সেটি আত্মশুদ্ধি না হয়ে বরং বিশেষ ধরনের ব্যায়াম হবে। আত্মশুদ্ধির কুরআনী পন্থা নিচে পেশ করা হলো, যা সুরা আ’লা এর ১৪ নং আয়াতে বিবৃত হয়েছে।

এক, পবিত্রতা অবলম্বন করা : পবিত্রতা অর্থ কুফর ও শিরক ত্যাগ করে ঈমান আনা, অসৎ আচার-আচরণ ত্যাগ করে সদাচার অবলম্বন করা এবং অসৎ কাজ ত্যাগ করে সৎ কাজ করা। এটি শারীরিক বা বস্তুগত পবিত্রতা নয় যা আমরা অজু গোসল করে পবিত্রতা অর্জন করে থাকি বরং এ পবিত্রতা হচ্ছে চিন্তা ও কর্মের পবিত্রতা।যেমন আাল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে ঈমানদারগণ! মুশরিকরা তো অপরিবত্র, কাজেই এ বছরের পর তারা যেন আর মসজিদের হারামের কাছে না আসে।” (সুরা তাওবা : ২৮) এখানে অপবিত্র মানে এ নয় যে, তারা নিজেরা শরীরিক বা বস্তুগত অপবিত্র বরং এর মানে হচ্ছে, তাদের আকীদা-বিশ্বাস, নৈতিক, চরিত্র, কাজকর্ম এবং তাদের জাহেলী চালচলনও সমাজ ব্যবস্থা অপবিত্র। নাজাস শব্দটি শারীরিক নাপাকির অর্থে ব্যবহৃত হয়নি বরং বিশ্বাসের অপবিত্রতা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।

ইসলামে নাপাক বলতে সাধারণত শারীরিক ময়লা-আবর্জনা বা কোনো বস্তু যা শরীর বা কাপড়ে লাগলে পবিত্রতা নষ্ট করে, তাকে বোঝায়। অন্যদিকে, কাফের বা মুশরিকদের ‘নাজাস’ বলা হয়েছে তাদের আকীদা-বিশ্বাসের কারণে। তারা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করে না। তাই আল কুরআন তাদেরকে নাজাস বা অপবিত্র বলা হয়েছে। তাই আত্মশুদ্ধির জন্য মুসলমানদের প্রথমত বিশ্বাসগত ও কার্যত পবিত্র হতে হবে। বিশ্বাস বা কাজের কোথাও শিরক ও কুফুরীর ছিটে ফুটো থাকতে পারবেনা। খুলুসিয়াতের সাথে দীনকে তথা জীবন ব্যবস্থাকে আল্লাহর জন্য সুনির্দিষ্ট করতে হবে। জীবনের কিছু অংশ আল্লাহর হুকুম মত পালন করা হলে আর কিছু অংশ মানুষের মস্তিস্ক প্রসূত হুকুম মত পালন করা হলে পবিত্রতার আশা করা বৃথা। আল্লাহ তা’আলা বলেন :-”তবে তোমরা কি কিতাবের একটি অংশ বিশ্বাস কর এবং অন্য অংশ অবিশ্বাস কর? জেনে রাখ, তোমাদের মধ্যে যাদেরই এ রূপ আচরণ হবে, তাদের এতদ্ব্যতীত আর কি শাস্তি হতে পারে যে, তারা পার্থিব জীবনে অপমানিত এবং লাঞ্ছিত হতে থাকবে এবং পরকালে তাদেরকে কঠোরতম শাস্তির দিকে নিক্ষেপ করা হবে। তোমরা যা কিছু করছো,তা আল্লাহ মোটেই অজ্ঞাত নন।”(সুরা বাকারা-৮৫)

দুই, স্মরণ করা : স্মরণ করা বলতে আল্লাহকে মনে মনে স্মরণ করা এবং মুখে তা উচ্চারণ করা। উভয়টিই যিকরুল্লাহ বা আল্লাহকে স্মরণ করার অন্তর্ভুক্ত বুঝায়। তবে এ স্মরণ কর্মক্ষেত্রে বিচরণ করেই করতে হবে। নির্জন জায়গায় নয় বরং দুনিয়ার কর্মক্ষেত্রে শয়তান ও তার সহচরদের সাথে লড়ে আল্লাহ যিকরকে সমুন্নত করাই হলো প্রকৃত যিকর। সংসারের শত ঘাত-প্রতিঘাতকে মোকাবেলা না করে জঙ্গলের নির্জন স্থানে গিয়ে আল্লাহর যিকর খুবই সহজ। মনে রাখতে হবে, পরীক্ষার মাধ্যমে মানুষের সফলতা ও বিফলতা যাচাই করা হয়। এ জন্য তাকে পরীক্ষার হলে বসে শত শত চক্ষুর সামনে পরীক্ষা দিতে হয়। কোন পরীক্ষার্থী যদি কোন নির্জন কক্ষ দাবি করে, তাহলে সেটি পরীক্ষা হবে না। জীবনের পদে পদে সংসারের ঘাত-প্রতিঘাতে আল্লাহর স্মরণই হলো প্রকৃত যিকর। সুতরাং যিকরের উপযুক্ত স্থান হলো সমাজ সংসারে ও জীবনের প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে।

মু’মিনের জীবন হবে যিক্র নির্ভর। অর্থাৎ যখন যে কাজ করবে সে সময় অবশ্যই আল্লাহকে স্মরণ করবে। বিসমিল্লাহ্ বলে কাজ শুরু করবে এবং কাজের পরতে পরতে আল্লাহর স্মরণ থাকবে। জীবনের প্রতিটি কাজ করতে হবে আল্লাহর নির্দেশিত এবং রাসুলুল্লাহ (সা:)-এর প্রদর্শিত পন্থায়। যখনই কোন কাজ করবে তখনই আল্লাহর নির্দেশ ও তাঁর রাসুলের প্রদর্শন মোতাবেক হচ্ছে কি না তার চিন্তা করার নামই যিক্র। আমাদের ধারণা আল্লাহর যিক্র বলতে শুধুমাত্র নির্ধারিত কিছু কালিমা নির্ধারিত সময়ে ও সালাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এ ধারণা ভুল। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তারপর যখন সালাত শেষ হয়ে যায় তখন ভু-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো এবং অধিকমাত্রায় আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো। আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে।” (সুরা জুম’আ : ১০)

তোমরা রিযিক তালাশের জন্য জমিনে ছড়িয়ে পড়ো কিন্তু নিজেদের কাজ-কর্ম ও ব্যবসায়-বাণিজ্যে ব্যস্ত হয়েও আল্লাহকে ভুলে যেও না। বরং সর্ববস্থায় তাঁকে স্মরণে রাখো এবং তাঁকেই স্মরণ করতে থাকো। আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ করার অর্থ হচ্ছে, জীবনের সকল কাজকর্মে সমস্ত ব্যাপারেই সবসময় যেন মানুষের মুখে আল্লাহর নাম এসে যায়। মানুষের মনে আল্লাহর চিন্তা পুরোপুরি ও সর্বব্যাপী আসন গেঁড়ে না বসা পর্যন্ত এ ধরণের অবস্থা তার মধ্যে সৃষ্টি হয় না। মানুষের চেতনার জগৎ অতিক্রম করে যখন অচেতন মনের গভীরদেশেও এ চিন্তা বিস্তৃত হয়ে যায় তখনই তার অবস্থা এমন হয় যে, সে কোন কথা বললে বা কোন কাজ করলে তার মধ্যে আল্লাহর নাম অবশ্যই এসে যাবে। আহার করলে বিসমিল্লাহ্ বলে শুরু করবে। আহার শেষ হলে আলহামদুলিল্লাহ বলবে। আল্লাহকে স্মরণ করে ঘুমাবে এবং ঘুম ভাঙ্গবে আল্লাহর নাম নিতে নিতে। কথাবার্তায় তার মুখে বিসমিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, ইনশা’আল্লাহ, মাশা’আল্লাহ, সুবহানা’আল্লাহ, যাযাকাল্লাহ, হাইয়্যাকাল্লাহ, আল্লাহ হাফিজ এবং এ ধরণের অন্যান্য বাক্য বার বার উচ্চারিত হতে থাকবে। প্রত্যেক ব্যাপারে বার বার আল্লাহর সাহায্য চাইবে। প্রত্যেক নিয়ামত লাভ করার পর আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। বিপদ আসার পর তাঁর রহমতের প্রত্যাশী হবে। প্রত্যেক সংকটে তার দিকে মুখ ফিরাবে। কোন খারাপ কাজের সুযোগ এলে তাঁকে ভয় করবে। কোন ভুল বা অপরাধ হয়ে গেলে তাঁর কাছে মাফ চাইবে। যে কোন প্রয়োজন ও অভাবেব মুহূর্তে তাঁর কাছে প্রার্থনা করবে। মোট কথা উঠতে বসতে এবং দুনিয়ার সমস্ত কাজকর্মে আল্লাহর স্মরণ হয়ে থাকবে তার কণ্ঠলগ্ন। এটি ইসলামী জীবনের প্রাণ।

তিন নিয়মিত সালাত আদায় করা : সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের যুগে সালাত ছিল। সালাত ইসলামে শ্রেষ্ট ইবাদাত। সালাত ছাড়া আত্মার পরিশুদ্ধি হয় না। কারণ দুস্কৃতিমুক্ত ও নৈতিক চরিত্র ছাড়া আত্মার পরিশুদ্ধি হয় না। সালাত মানুষকে দুস্কৃতি থেকে মুক্ত করে। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“নিশ্চিতভাবেই সালাত অশ্লীল ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে।” (সুরা আনকাবুত : ৪৫) সালাত সৎ ও পবিত্র-পরিচ্ছন্ন মানুষ গঠন করে। সুতরাং সালাত ছাড়া আত্মার পরিশুদ্ধি কখনো সম্ভব নয়। কারণ মু’মিন নিয়মিত সালাত পড়ে প্রমাণ করে যে, আল্লাহকে সে ইলাহ হিসাবে মেনে নিয়েছে কার্যত তাঁর আনুগত্য করতেও সে প্রস্তুত এবং তাঁকে সর্বক্ষণ স্মরণ করার জন্য সে ব্যবস্থা অবলম্বন করেছে। ইসলাম অর্থ আত্মসমর্পণ আর আত্মসমর্পণের পুরো দৃশ্যটি পরিলক্ষিত হয় সালাতে। সালাতের সাজদায় বান্দা তার নাক,কপাল ও মাথা বা তার সারা শরীর আল্লাহর সামনে লুটিয়ে দিয়ে প্রমাণ করে যে, কার্যত সে আল্লাহর গোলাম। পরিপূর্ণ এই দৃশ্যটি সালাত ছাড়া অন্য কোন ইবাদাতে দৃশ্যমান হয় না বিধায় সালাত শ্রেষ্ঠ ইবাদাত।

এ তিনটি কাজের মাধ্যমে আত্মারশুদ্ধি লাভ হয় এবং সে দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা লাভ করে। এখানে সফলতা বলতে পার্থিব সমৃদ্ধি বুঝানো হয়নি বরং আসল ও সত্যিকার সফলতার কথা বুঝানো হয়েছে। এর সাথে পার্থিব সমৃদ্ধি অর্জিত হোক বা না হোক তাতে কিছু যায় আসে না। কোন কোন অজ্ঞ লোক সফলকাম বলতে দীর্ঘজীবন বা বৈষয়িক সমৃদ্ধি অথবা পার্থিব উন্নতি অর্থ গ্রহণ করেন। কিন্তু তার জানা উচিত কোন ব্যক্তি বা জাতি একদিকে সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং ফাসেকী, অশ্লীল কার্যকলাপ, জুলুম ও সীমালংঘন করতে থাকে এবং অন্যদিকে তার ওপর অনুগ্রহ বর্ষিত হতে থাকে তখন বুঝতে হবে, বুদ্ধি ও কুরআন উভয় দৃষ্টিতে আল্লাহ তাকে কঠিনতর পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন এবং তার ওপর আল্লাহর করুণা নয় বরং তাঁর ক্রোধ চেপে বসেছে। সুরা আ’লার ১৫ নং আয়াত থেকে সফলতার কারণ জানা যায়। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “এবং নিজের রবের নাম স্মরণ করেছে তারপর সালাত পড়েছে।”

আত্মার পরিশুদ্ধি মানুষের জীবন সুন্দর ও ফুলে ফলে সুশোভিত হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন,“আর যে ব্যক্তিই পবিত্রতা অবলম্বন করে সে নিজেরই ভালোর জন্য করে এবং ফিরে আসতে হবে সবাইকে আল্লাহরই দিকে।”(সুরা ফাতির:১৮) আল্লাহ তা’আলা বলেন,“ তাকে বলো, তোমার কি পবিত্রতা অবলম্বন করার আগ্রহ আছে এবং তোমার রবের দিকে আমি তোমাকে পথ দেখাবো, তাহলে তোমার মধ্যে (তাঁর) ভয় জাগবে? ”(সুরা নাযিয়াত:১৮-১৯) আল্লাহ তা’আলা বলেন,“ আল্লাহ যাকে চান নিজের আলোর দিকে পথনির্দেশ করেন।(সুরা নূর:৩৫) “চির হরিৎ উদ্যান, যার পাদদেশে প্রবাহিত হবে নদী, সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। এ হচ্ছে পুরস্কার সে ব্যক্তির যে পবিত্রতা অবলম্বন করে।” (সুরা তাহা : ৭৬)

লেখক : ব্যাংকার।