পবিত্র কুরআনের সুরা আল ইমরানের ২৬ ও ২৭নং আয়াতের তরজমা দিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করতে চাই। আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, “বলো (হে মোহাম্মদ সা.) হে আল্লাহ, বিশ্ব জাহানের মালিক, তুমি যাকে চাও রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করো, যার নিকট থেকে ইচ্ছা রাষ্ট্র ক্ষমতা (রাজত্ব) ছিনিয়ে নাও। যাকে ইচ্ছা মর্যাদা ও ইজ্জত দান করো, যাকে ইচ্ছা বেইজ্জত ও লাঞ্ছিত করো। কল্যাণ তোমার হাতেই নিহিত; নিঃসন্দেহে তুমি সব কিছুর উপর শক্তিশালী। তুমি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করাও, দিনকে রাতের মধ্যে। জীবনহীন থেকে জীবন্তের আবির্ভাব ঘটাও এবং জীবন্তের থেকে জীবনহীনের। আর যাকে চাও তাকে তুমি বেহিসাব রিজিক দান করো।”
মহান আল্লাহর এ সার্বভৌম ক্ষমতার নিদর্শন বার বার দুনিয়াবাসী দেখেছে। প্রবল প্রতাপশালী জানেন স্বৈরাচারী শাসকদের তিনি ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনা এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তারই গঠিত ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। প্রতিবেশী ভারতের আশ্রয়ে থাকা বাংলাদেশের সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তাকে গ্রেফতারের লক্ষ্যে ট্রাইব্যুনাল ইন্টারপোলের সহায়তা কামনা করে পত্রও দিয়েছেন।
এদিকে জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে প্রদত্ত ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে আপীল মামলায় সুপ্রীম কোর্টের আপীলিয়েট বিভাগের বাতিল আদেশ ও মাননীয় আদালতের পর্যবেক্ষণ বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে অভূতপূর্ব চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। জনাব আজাহারুল ইসলাম বেকসুর খালাস পেয়েছেন। তার প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে তার পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা আজকের এ স্তম্ভে প্রদান করা থেকে বিরত থাকলাম। তবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের ন্যায়ভ্রষ্ট রায়ের বিরুদ্ধে আপীল আদালত কর্তৃক নিবন্ধন ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে প্রদত্ত নির্দেশনাকে আমরা অভিনন্দন জানাই। সাথে সাথে পাঠকদের সুবিধার্থে নিবন্ধন বাতিলের আদ্যপান্ত আলোচনা করাও জরুরি বলে আমি মনে করি।
বলাবাহুল্য, রাজনৈতিক দল হিসাবে হাইকোর্ট বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন। ২০১৩ সালের পয়লা আগস্ট বিচারপতি এম. মোয়াজ্জম হোসেন, বিচারপতি এম. এনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি কাজী রেজাউল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে এই রায় দেন। একজন বিচারপতি এতে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। রায়ে আদালত বলেছেন নির্বাচন কমিশন জামায়াতকে যে নিবন্ধন দিয়েছে তা অবৈধ এবং আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত। রায়ের পর নির্বাচন কমিশনের কৌঁসুলি মহসীন রশীদ সাংবাদিকদের বলেছেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে আদালত রুল মঞ্জুর করেছেন। নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণার কারণগুলো পরে জানা যাবে। তিনি বলেন, এ রায়ের সঙ্গে সঙ্গে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়ে গেছে। ফলে ইসি’র নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হিসেবে দলীয় প্রতীক নিয়ে জামায়াত আর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। জামায়াত অবশ্য সংবিধানের ১০৩ ধারা অনুযায়ী আপীল করার বিষয়ে আদালত থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে আপীল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপীল আবেদন পেশ করেছে। এ রায় প্রকাশের পর পরই আইন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন যে, এ রায়টি জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রাথমিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। বিশ্লেষকদের অনেকেই বলেছেন যে, শুরু থেকে ক্ষমতাসীন সরকার জামায়াতের ওপর যে নির্যাতন চালিয়ে আসছেন দলটির নিবন্ধন বাতিলের ঘটনা তারই ধারাবাহিকতা মাত্র। সরকারের ধারণা জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করতে পারলে অন্যান্য বিরোধী দলগুলোও দুর্বল হয়ে পড়বে এবং পুনরায় ক্ষমতায় আসা তাদের জন্য সহজতর হবে। একটি প্রতিবেশী দেশও তাদের স্বার্থ উদ্ধারের পথে জামায়াতকে প্রধান প্রতিবন্ধক বলে মনে করে এবং তাদের পরামর্শেই জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে তথাকথিত মানবতা বিরোধী অপরাধের মিথ্যা অভিযোগে বিচার করে তাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে। আওয়ামী ঘরানার দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছিল। তারা গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি করে জামায়াত বিরোধী তৎপরতা পরিচালনার অগ্রগামী ভূমিকাও পালন করছে। কয়েক বছর আগে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সংক্রান্ত তাদের দাবি পূরণের আশ্বাস দিতে গিয়ে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন যে, এ ব্যাপারে আইনী প্রক্রিয়ায়ই তারা অগ্রসর হবেন এবং ২০০৯ সালে মাইজভাণ্ডার ভিত্তিক তরিকত ফেডারেশন, জাকের পার্টিসহ আওয়ামী ঘেঁষা ২৫টি সংগঠন জামায়াতের নিবন্ধনের বিরুদ্ধে যে রীট মামলা করেছে সে মামলাটি জিন্দা করা হবে। তার কথামত মামলাটি জিন্দা হয়েছে এবং তার রায় জামায়াতের বিরুদ্ধে গেছে। এখানে আইনমন্ত্রীর জয় হয়েছে বলে মনে হয়। আদালতের স্বাধীনতা ও ভূমিকা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন। তারা বলছেন যে, একটি রাজনৈতিক ইস্যু রাজনৈতিকভাবে মীমাংসা না করে আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে সরকার নিজেদের স্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টা চালাচ্ছেন।
অবশ্য জামায়াতের ওপর সরকারের রুদ্ররোষ আজকে প্রথম নয়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবার পর সরকার ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে জামায়াতের রাজনীতিকেও নিষিদ্ধ করেছিল। এর আগে পাকিস্তান আমলে তৎকালীন জামায়াত দু’বার নিষিদ্ধ হয়েছিল। প্রথমবার হয়েছিল ১৯৫৮ সালে। জেনারেল আইয়ূব খান সামরিক শাসন জারির পর অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে জামায়াতও নিষিদ্ধ হয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী হামলায় অধিবেশন পরিচালনারত ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী নিহত হবার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তখন সামরিক শাসন জারী হয়েছিল। দ্বিতীয়বার জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল আইয়ুবের দুঃশাসন ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতের সক্রিয় ভূমিকার কারণে ১৯৬৪ সালে। এই সময় সরকার ১৯০৮ সালের ফৌজদারী আইনের ১৬ ধারা অনুযায়ী জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু এ আদেশের বিরুদ্ধে জামায়াত সুপ্রীম কোর্টে আপীল করেছিল। সুপ্রীম কোর্ট এই আদেশকে খারিজ করে দেন এবং অভিমত প্রকাশ করেন যে, ফৌজদারী আইনের ১৬ নং ধারাটি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এবং নাগরিকদের Freedom of Association এর মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী (17 DLR (SC) 209)।
পরিতাপের বিষয় হচ্ছে যে, পাকিস্তান আমলে Freedom of Association এর যে মৌলিক অধিকার আদালত সংরক্ষণ করেছে বাংলাদেশ আমলে এসে আমাদের উচ্চ আদালত এই মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করলেন। কেন করলেন তা বুঝা মুশকিল। তবে একটা কথা বলে রাখি, রায় প্রকাশিত হবার পর ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোট বলেছিল যে এ রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে জামায়াত একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন তখন তাদের অনলাইন জরীপের একটি ফল প্রকাশ করেছে। এতে ১৪ দলের এ মন্তব্যের ওপর পাঠকদের মতামত চাওয়া হয়েছিল। ফলাফল অনুযায়ী পাঠকদের শতকরা ১৫.৩০ ভাগ ১৪ দলের সাথে একমত প্রকাশ করেছে। আবার ৮৩.৭২ শতাংশ বলেছেন যে তারা জামায়াতকে সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করেন না। ০.৯৮ শতাংশ কোন মতামত দেননি। জরীপের ফলাফল তাৎপর্যপূর্ণ। এখন আমি জামায়াতের গঠনতন্ত্র সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। এ গঠনতন্ত্রের কতিপয় ধারাকে নির্বাচন কমিশন ও সরকার বাংলাদেশ সংবিধানের পরিপন্থী আখ্যায়িত করেছে। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের সাথে জামায়াতের পত্র যোগাযোগ চলছিল। কয়েক দফা জামায়াত কমিশনের চাহিদানুযায়ী তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধনও করেছে। এই পর্যায়ে আদালতের রায়কে অনেকে অনভিপ্রেত বলে মনে করেছেন।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সর্বশেষ নির্বাচন কমিশন সচিবালয় গত ৪ নবেম্বর (২০১২) বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে একটি পত্র দিয়েছিল। এ পত্রে সংগঠনটির গঠনতন্ত্রের বেশ কয়েকটি ধারা এবং উপধারা সংশোধনকরত ৫ ডিসেম্বরের মধ্যেই কমিশনে দাখিল করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। জামায়াতের গঠনতন্ত্রের যে সমস্ত ধারা, উপধারায় বর্ণিত বিষয়সমূহকে নির্বাচন কমিশন আপত্তিকর বলে উল্লেখ করেছে তার মধ্যে রয়েছে (১) আল্লাহ্্ ছাড়া অপর কাউকে বাদশাহ্্, রাজাধিরাজ ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বলে মেনে না নেয়া, (২) ইসলামী মূল্যবোধের উজ্জীবন ও জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বকে সর্বপ্রকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক হুমকি এবং বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা চালানো, (৩) দায়িত্বশীল নাগরিক ও চরিত্রবান ও যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে শোষণহীন ইনসাফভিত্তিক সমাজ গঠন (৪) সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের আদর্শ সমুন্নত রাখা, (৫) ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলা এবং বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা (৬) সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামী সুবিচারপূর্ণ শাসন কায়েম ও সমাজ থেকে জুলুম, শোষণ, দুর্নীতি ও অবিচারের অবসান ঘটানো এবং সমাজের সর্বস্তরে সৎ ও খোদাভীরু নেতৃত্ব কায়েমের চেষ্টা করা এবং উপার্জনে অবৈধ পন্থা রোধ করা প্রভৃতি। নির্বাচন কমিশনের পত্রে উপরোক্ত বিষয়গুলোর ওপর আপত্তি উত্থাপনের ধরন দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। কেননা এ বিষয়গুলো ইসলামী অনুশাসনেরই অংশ। কেউ কেউ বলছেন যে, আমরা নিশ্চয়ই ফেরাউন-নমরুদের দেশে বাস করছি না। যেখানে ইসলামের দাওয়াত দেয়া হারাম ছিল। সরকার জামায়াত নেতৃত্বকে ধ্বংস করার জন্য তখন সংগঠনটির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে হয় হুলিয়া জারি করে রেখেছিলেন না হয় কারাগারে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন। তাদের কেন্দ্রীয়, মহানগরী এবং জেলাপর্যায়ের বহু অফিস খুলতে দেয়া হয়নি। পুলিশ অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এই অবস্থায় জামায়াতের তরফ থেকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে পত্রটির একটি জবাবও দেয়া হয়েছে। তার আগে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা জরুরি বলে আমি মনে করি।
নির্বাচন কমিশন তার সর্বশেষ পত্রে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের ধারা ২ এর ৫ উপধারা, ধারা ৩, ধারা ৫-এর উপধারা ৩, ধারা ৬-এর উপধারা ৪, ধারা ৭-এর উপধারা ১ থেকে ৪, ধারা ১১-এর উপধারা ২, ধারা ১৮-এর উপধারা ৪(চ) এবং গঠনতন্ত্রের ৬৪ পৃষ্ঠায় বিধৃত বিশেষ নোটের দফা (৩) বাদ দিয়ে গঠনতন্ত্র সংশোধনকরত সংশোধিত গঠনতন্ত্রের মুদ্রিত তিন কপি (প্রতি পৃষ্ঠা সত্যায়িত করে) ঐ বছরের ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে দলটিকে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করতে বলেছিল, জামায়াত তা করেছে।
বলাবাহুল্য, এর আগে ২০১০ সালের ২৪ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন এক পত্রযোগে জামায়াতকে জানিয়েছিল যে, ক) দলটির গঠনতন্ত্রের ২ ধারার ৫ উপধারার আংশিক বিধান বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব ও আইনসভার কর্তৃত্বকে অস্বীকারের সমতুল্য প্রতীয়মান হতে পারে। (খ) গঠনতন্ত্রের ভূমিকায় বর্ণিত ইসলামী সমাজ গঠন ও ধারা ৩ এ বর্ণিত ইসলামী জীবনবিধান কায়েমের বিষয়টি বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনার গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সাথে সংগতিপূর্ণ নয় (গ) গঠনতন্ত্রের ধারা ৫ উপধারা ৩ এ বর্ণিত ইসলামের সুবিচারপূর্ণ শাসন কায়েম এবং ধারা ৬ ও উপধারা ৪ এ বর্ণিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় ইসলামের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠার বিধান বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। (ঘ) গঠনতন্ত্রের ধারা ৭ উপধারা ১-৪ এ বর্ণিত বিধান এবং ধারা ১১ উপধারা ২ এ বর্ণিত অমুসলিম নাগরিকদের বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সদস্য হওয়ার বিষয়টি বা অমুসলিম সদস্যের দলে সদস্যভুক্তির জন্য প্রস্তুতকৃত শপথনামা বাস্তবসম্মত নয়। গঠনতন্ত্রের এ দুটি বিধান দলের মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সাথে সাংঘর্ষিক ও স্ববিরোধী। (ঙ) গঠনতন্ত্রের ধারা ১৮ উপধারা ৪ (চ) এ বর্ণিত আমীরের মনোনয়ন প্রদানের ক্ষমতা ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আইনের ৯০ ই(ও) (ন) (র) বিধানের পরিপন্থী। (চ) গঠনতন্ত্রের ৬৪ পৃষ্ঠায় বিশেষ নোটের দফা ৩ এ বর্ণিত বিষয়টি একটি ধারা আকারে দলের গঠনতন্ত্রে সন্নিবেশ করা প্রয়েজন। জামায়াত কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী গঠনতন্ত্র সংশোধন করেছে। তবে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে আপোষ করেনি। কেননা আপোষ করলে মুসলমানদের ঈমান থাকে না। উপরোক্ত অবস্থার প্রেক্ষিতে মূল আলোচনা ও বিশ্লেষণের আগে আমি জামায়াতের গঠনতন্ত্রের যে ধারা ও উপ-ধারাগুলোর ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংবিধানের দোহাই দিয়ে আপত্তি উত্থাপন করে দলটির গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্য সময় বেঁধে দিয়েছে সে ধারা ও উপ-ধারাগুলোর প্রকৃত অবস্থা পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে চাই। নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের ২নং ধারার ৫নং ধারাটি আপত্তিকর বলে অভিহিত করেছে। এ ধারাটি হচ্ছে জামায়াতের মৌলিক আক্বিদা সংক্রান্ত। এতে জামায়াত “ইসলামের মৌলিক আক্বিদা...লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ-এ কালেমাকে জামায়াতের আকিদা হিসাবে গ্রহণ করেছে যার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ ব্যতীত কোনও ইলাহ নেই, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। জামায়াত-এর একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছে এবং বলেছে যে, “এ আক্বিদার ‘প্রথমাংশ অর্থাৎ আল্লাহর একমাত্র ইলাহ হওয়া এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারুর ইলাহ না হওয়ার অর্থ এই যে, আকাশ মণ্ডল এবং পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু আছে সেইসব কিছুর সৃষ্টিকর্তা, প্রতিপালক, মা’বুদ এবং প্রাকৃতিক ও বিধিগত সার্বভৌম সত্তা হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ। এই সবের কোন একদিক দিয়েও কেউ তার শরীক নেই।” এর পর বলা হয়েছে যে, “এই মৌলিক সত্য কথাটি জানিয়া ও মানিয়া লইলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অনিবার্যরূপে গ্রহণ করিতে হয়।” এই অনিবার্য বিষয়গুলোর ৫ম বিষয়টির (৫ উপ-ধারা) ওপর নির্বাচন কমিশন আপত্তি উত্থাপন করেছে। এই উপ-ধারায় বলা হয়েছে, “আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহাকেও বাদশাহ, রাজাধিরাজ ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মানিয়া লইবে না, কাহাকেও নিজস্বভাবে আদেশ ও নিষেধ করিবার অধিকারী মনে করিবে না, কাহাকেও স্বয়ংসম্পূর্ণ বিধানদাতা ও আইন প্রণেতা মানিয়া লইবে না এবং আল্লাহর আনুগত্য ও তার দেয়া আইন পালনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয় এমন সকল আনুগত্য মানিয়া লইতে অস্বীকার করিবে। কেননা স্বীয় সমগ্র রাজ্যের নিরঙ্কুশ মালিকানা ও সৃষ্টিলোকের সার্বভৌমত্বের অধিকার আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহারো নাই।
জামায়াতের গঠনতন্ত্রের ৩নং ধারায় তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বর্ণনা করা হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বে সার্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানব জাতির কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (স:) প্রদর্শিত দ্বীন (ইসলামী জীবন বিধান) কায়েমের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন সাফল্য অর্জন করাই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
উপরোক্ত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হাসিলের জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কার্যক্রম নিম্নরূপ হইবে :
(১) ইসলামী মূল্যবোধের উজ্জীবন ও জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বকে সর্বপ্রকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক হুমকি এবং বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা চালানো।
ব্যাখ্যা : এখানে সার্বভৌমত্ব শব্দটি ভৌগোলিক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। ইসলামে আইনগত সার্বভৌমত্বের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ।
(২) দায়িত্বশীল নাগরিক এবং চরিত্রবান ও যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে শোষণহীন, ইনসাফভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করে জনগণের সামগ্রিক কল্যাণ সাধন।
৩) সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের আদর্শ সমুন্নত রাখা এবং ধর্ম-বর্ণ ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান এবং সর্বশ্রেণীর মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, সম্পদের সুষম বণ্টন, জাতীয় আয় ও উৎপাদন বৃদ্ধি এবং মানুষের জীবনমান উন্নতকরণের মাধ্যমে শোষণ, দুর্নীতি, সন্ত্রাসমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো।
(৪) ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে বিশ্ব মুসলিম ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলা এবং বিশ্বের সকল রাষ্ট্রর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন। জামায়াতের গঠনতন্ত্রের ৫ নং ধারাটি দাওয়াত সংক্রান্ত। এর আপত্তিকর উপ-ধারা ৩ এ যা বলা হয়েছে তা হচ্ছে : “সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামের সুবিচারপূর্ণ শাসন কায়েম করে সমাজ থেকে সকল প্রকার জুলুম, শোষণ, দুর্নীতি ও অবিচারের অবসান ঘটানোর আহ্বান।”
সংগঠনটির গণতন্ত্রের ৬ নং ধারা হচ্ছে তার স্থায়ী কর্মসূচি সংক্রান্ত। এর অধীনে ৪টি উপ-ধারা আছে। আপত্তিকৃত চতুর্থ উপ-ধারায় বলা হয়েছে। “ইসলামের পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠাকল্পে গোটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় বর্ণিত সংশোধন আনয়নের উদ্দেশ্যে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকার পরিবর্তন এবং সমাজের সর্বস্তরে সৎ ও খোদাভীরু নেতৃত্ব কায়েমের চেষ্টা করা।”
৭নং ধারায় জামায়াতের সদস্য বা রুকন হওয়ার শর্তাবলি বর্ণনা করা হয়েছে। এসব শর্তাবলির মধ্যে আটটি উপধারা সংযোজিত আছে এবং এর প্রথম চারটি উপধারা সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন তার আপত্তি জানিয়ে বলেছে যে, এই উপধারাগুলো পালন করা বাস্তবসম্মত নয়। এই ধারা ও সংশ্লিষ্ট উপধারাগুলো নিম্নরূপ:
‘বাংলাদেশের যে কোন সুস্থ বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন ও প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারী এই জামায়াতের সদস্য (রুকন) হইতে পারিবেন যদি তিনি-
১। ইসলামের মৌলিক আক্বীদা, উহার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণসহ বুঝিয়া লওয়ার পর এই সাক্ষ্য দেন যে, ইহাই তাহার জীবনের আক্বীদা :
২। জামায়াতের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য উহার ব্যাখ্যাসহকারে বুঝিয়া লওয়ার পর স্বীকার করেন যে, ইহাই তাহার জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য:
৩। এই গঠনতন্ত্র পাঠ করিবার পর এই ওয়াদা করেন যে, তিনি ইহার অনুসরণে জামায়াতের নিয়ম-শৃঙ্খলা মানিয়া চলিবেন:
৪। শরীয়াতের নির্ধারিত ফরয ও ওয়াজিবসমূহ আদায় করিবেন এবং কবীরা গুনাহ হইতে বিরত থাকিবেন।
একইভাবে ১১নং ধারার দুই উপধারা সম্পর্কেও কমিশন থেকে আপত্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। এই উপধারায় বাংলাদেশের যে কোন অমুসলিম নাগরিকের জামায়াতের সদস্য হবার শর্তাবলি বর্ণিত আছে এবং এতে বলা হয়েছে যে, যারা এই শর্তগুলো পালন করবেন তারা জামায়াতের সদস্য হতে পারবেন। শর্তগুলো হচ্ছে :
ক) জামায়াতের নিয়ম-শৃঙ্খলা বা সিদ্ধান্তসমূহ নিষ্ঠার সহিত মানিয়া চলিবেন।
খ) জামায়াতের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিবেন।
গ) বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য একনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করিবেন।
ঘ) উপার্জনে অবৈধপন্থা অবলম্বন করিবেন না।’ এই শর্তগুলো কিভাবে অবাস্তব তা দেশবাসীর কাছে বোধগম্য নয়।
এছাড়াও গঠনতন্ত্রের ১৮ নং ধারার ৪ নং উপধারায় ‘চ’ অনুচ্ছেদের ব্যাপারেও আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে। এই ধারাটি হচ্ছে জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সংক্রান্ত এবং আপত্তিকৃত ‘চ’ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে,
‘আমীরে জামায়াত কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সহিত পরামর্শ করিয়া প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্যকে কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য মনোনীত করিতে পারিবেন যাহাদের মোট সংখ্যা কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার নির্বাচিত সদস্যগণের ১৫%-এর অধিক হইবে না।’
এখন নির্বাচন কমিশনের এই আপত্তিগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে আমি কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।
আমার প্রথম কথা হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধান আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল এবং এই দলিলটি অপরিবর্তনশীল দলিল নয়। এ যাবত এই দলিলটির ১৬ বার সংশোধন হয়েছে এবং ভবিষ্যতে যে হবে না সে সম্পর্কে গ্যারান্টি দিয়ে কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারেন না। সংবিধান মানুষের তৈরি একটি দলিল এবং মানুষের চাহিদা অনুযায়ী তার পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়। তবে এ কথা সত্য যে বিদ্যমান দলিলের আলোকে আমাদের রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ এবং ব্যক্তি ও সংস্থাসমূহের তৎপরতা নিয়ন্ত্রিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
বাংলাদেশের বর্তমানে যে সংবিধান বলবৎ রয়েছে সেই সংবিধানটির মূল প্রস্তাবনাই শুরু হয়েছে বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম’ অর্থাৎ দয়াময় পরম দয়ালু আল্লাহর নামে। এর অর্থ যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে-রাষ্ট্র আল্লাহর অনুগতই থাকবে এবং আল্লাহর নাম নিয়েই এই সংবিধানটি শুরু করা হয়েছে। এই সংবিধানের ২ (ক) ধারায় এই বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়েছে। এই ধারায় পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র ধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাবে। এই সংবিধানের ৪১ ধারায় ধর্মীয় স্বাধীনতার গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ক) প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে। এবং খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের উপরোক্ত বিধানগুলো সামনে রেখে যদি নিরপেক্ষভাবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রের তথাকথিত আপত্তিকৃত ধারা-উপধারাগুলো বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে আমাদের জাতীয় সংবিধানের সাথে এর সংঘাত-সংঘর্ষের কোন বিষয়ই নজরে পড়ে না। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র ধর্ম যদি ইসলাম হয় তাহলে রাষ্ট্রকে অবশ্যই আল্লাহর অনুগত থাকতে হয়। এই অবস্থায় জামায়াতের গঠনতন্ত্রের ২ ধারার ৫ উপধারা, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব ও আইন সভার কর্তৃত্বকে অস্বীকার করার সমতুল্য প্রতীয়মান হবার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে অপ্রাসঙ্গিক। নির্বাচন কমিশনের এ ব্যাখ্যা বাস্তবসম্মত হতে পারে বলে আমার মনে হয় না। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৫ থেকে ৭৯ পর্যন্ত ধারাগুলো পার্লামেন্ট বা আইনসভা সংক্রান্ত এই ধারাগুলোর কোথাও বাংলাদেশের জাতীয় সংসদকে একমাত্র সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলে গণ্য করা হয়নি। ৬৫ নং অনুচ্ছেদের (১) উপ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘জাতীয় সংসদ নামে বাংলাদেশে একটি সংসদ থাকবে এবং এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা সংসদের উপর ন্যস্ত থাকিবে: তবে শর্ত থাকে যে, সংসদের আইন দ্বারা যে কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন বা আইনগত কার্যকারিতাসম্পন্ন অন্যান্য চুক্তিপত্র প্রণয়নের ক্ষমতার্পণ হইতে এই দফার কোন কিছুই সংসদকে নিবৃত্ত করিবে না।’
নির্বাচন কমিশনের পত্রে সংসদের সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্বকে অস্বীকারের যে কথাটি বলা হয়েছে জামায়াতের গঠনতন্ত্রের ২(৫) ধারাটির ব্যাপারে তা প্রযোজ্য হতে পারে না। জামায়াত গঠনতন্ত্রের ২(৫) ধারাটি আমি আগেই উল্লেখ করেছি। এতে জামায়াতের মৌলিক আক্বীদা উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, জামায়াত ও তার সদস্যরা আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহাকেও বাদশা, রাজাধিরাজ ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মানিয়া লইবে না। কাহাকেও নিজস্বভাবে আদেশ ও নিষেধ করিবার অধিকারী মনে করিবে না... ইত্যাদি ইত্যাদি। এখানে সার্বভৌমত্বের বিষয়টি এসেছে। পবিত্র কুরআনে একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকেই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, রাজাধিরাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সূরা নাসে আল্লাহকে বলা হয়েছে ‘রাব্বিন নাস’ তথা মানুষের রব। যার অর্থ হচ্ছে সমগ্র মানবজাতির প্রতিপালক, মালিক ও প্রভু। এই সূরায় তাকে ‘মালিকীন নাস’ও বলা হয়েছে। এর অর্থ মানুষের বাদশাহ, সমগ্র মানব জাতির শাসক ও পরিচালক। তিনি ‘ইলাহিন নাস’ও। অর্থাৎ তিনি মানুষের ইলাহ বা মাবুদ, ইবাদত পাবার একমাত্র মালিক। একইভাবে সূরা আলে-ইমরানের ২৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে হে নবী। বলুন, রাজত্বের মালিক হে আল্লাহ, তুমি যাকে চাও তাকে রাজত্ব দান কর। আর যার কাছ থেকে ইচ্ছা হয় রাজত্ব কেড়ে নাও এবং যাকে চাও, সম্মান দান কর। যাকে চাও অপমানিত কর। সকল প্রকার মঙ্গল ও কল্যাণ তোমার এখতিয়ারে, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশক্তিমান। (কুলিল্লাহ হুম্মা মালেকুল মুলকে তু’তিল মুলকা মান তাসাউ ওয়াতানজিউল মুলকা মিম্মানতাসাউ ওয়া তুইজ্জো মানতাসাউ, ওয়া তুজেল্লো মান তাসাউ বি ইয়াদিকাল খায়ের। ইন্নাকা আলা কুল্লে সাইয়িন ক্বাদির)।
কুরআনের উপরোক্ত আয়াতসমূহের আলোকে ঈমানদার মুসলমানদের জন্য আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন শক্তিকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক বলে গণ্য করার কোন উপায় নেই। এখন বাংলাদেশের সংবিধানে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের যে প্রশ্নটি নির্বাচন কমিশন তুলেছেন তা কি আসলে কার্যকর আছে? বাংলাদেশে বিচার বিভাগের ক্ষমতা বেশি না পার্লামেন্টের, এ নিয়ে বিতর্ক এখনও চলছে। আদালতের রায়ের ভিত্তিতে সংসদ যখন সংবিধান সংশোধন করে তখন সংসদ বা পার্লামেন্ট তার সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ফেলে। এ সরকারের আমলেই এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে এবং এই নিয়ে হাইকোর্টের একজন বিচারপতির মন্তব্য এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে উত্তেজনাকর আলোচনা ও স্পিকারের রুলিং উচ্চ আদালত কর্তৃক বেআইনি ঘোষণা করার পরও সংসদকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলার সুযোগ সম্ভবত আর থাকে না। এ অবস্থায় শতকরা নব্বই ভাগ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশের একটি রাজনৈতিক দল তার গঠনতন্ত্রে আল্লাহকে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক ও রাজাধিরাজ ঘোষণা করার মধ্যে এর কথা কোন ত্রুটি থাকতে পারে না। বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এর কথা আমি আগেই বলেছি। নাস্তিক কমিউনিস্টদের সমালোচনা এবং ইসলাম বিরোধিতা এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের জন্য জামায়াত বিরোধী প্রেরণার উৎস হওয়া বাঞ্ছিত নয়। এক্ষেত্রে জাতীয় সংবিধানে নির্বাচন কমিশনকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সে বিষয়টি স্মরণ করার জন্য আমি তাদের অনুরোধ করব। এখানে সংবিধানের ১১৯নং অনুচ্ছেদে কমিশনের দায়িত্ব সম্পর্কে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, ‘(১) রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রণয়নের পর তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং নির্বাচন কমিশন সংবিধান ও আইনানুযায়ী-ক) রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন; খ) সংসদে সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন; গ) সংসদের প্রতিটি আসনে নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ করিবেন এবং ঘ) রাষ্ট্রপতির পদের এবং সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুত করিবেন।
এখানে সংবিধানের কোথাও কোন রাজনৈতিক দলকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেয়া হয়নি এবং দুনিয়ার কোথাও কোনও দেশেই নির্বাচন কমিশনের কথামত কোন রাজনৈতিক দল উঠবস করে না। নির্বাচন কমিশন জনগণের নির্বাচিত কোন সংস্থাও নয়। পক্ষান্তরে রাজনৈতিক দলগুলো হচ্ছে জনগণের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত তাদেরই আদর্শে অনুপ্রাণিত জনকল্যাণের জন্য নিবেদিত জনগণেরই একটি প্রতিষ্ঠান।
এখানে আরেকটি কথা বলা দরকার। এক একটি রাজনৈতিক দলের একেক রকম উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি থাকতে পারে। জামায়াতে ইসলামীরও আছে। জামায়াত তার গঠনতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য আমাদের জাতীয় সংবিধানে স্বীকৃত গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণের কথা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল তাদের গঠনতন্ত্রে মার্কস, এঞ্জেলস-এর আদর্শ অনুযায়ী সমাজ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে। এদেশের ৯০ ভাগ লোক মুসলমান এবং তারা নাস্তিক নয়। তারা কমিউনিস্টদের ন্যায় আল্লাহকে ‘মানুষের চরম দুশমন’ বলেও মনে করে না। কিন্তু তথাপিও গণমানুষের ধর্মে বিশ্বাস, আদর্শ ও চিন্তা-চেতনা বিরোধী কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিত উপরোক্ত দলগুলোর গঠনতন্ত্রকে নির্বাচন কমিশন আপত্তিকর মনে করেনি। বরং এ ধরনের গঠনতন্ত্র পেশ করার জন্য কমিশনের তরফ থেকে তাদেরকে ধন্যবাদ দেয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে তার গঠনতন্ত্রের জন্যে হয়রানি করা হচ্ছে এবং ইসলাম বিদ্বেষী বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট ও মন্তব্যকে ভিত্তি করে নানা প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এর কারণ বোধগম্য নয়।
আবার যদি ধরে নেয়া হয় যে, জামায়াতের গঠনতন্ত্রে এমন কিছু আছে যা জাতীয় সংবিধানের সাথে মিলে না। সে ক্ষেত্রেও তা আপত্তির বিষয় হতে পারে না। কেননা জামায়াতের সংবিধানটি গভীরভাবে অনুধাবন করলে এটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে সমাজ কাঠামো এবং নেতৃত্বের পরিবর্তন চায়। এ চাওয়াটা স্বাভাবিক এবং এটা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। তারা যদি দেশের মানুষকে তাদের আদর্শের ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করতে পারে এবং মানুষ তা মেনে নেয় তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তারা সংবিধান সংশোধন করেই তাদের আদর্শ বাস্তবায়ন করবে, বন্দুকের নলের মুখে অথবা অগণতান্ত্রিক কোনও পন্থায় নয়। ইসলামের অনুশাসনভিত্তিক একটি দল হিসেবে ইসলামী রাষ্ট্র চাওয়া এবং সে জন্য রাজনীতি করা অবৈধ নয়। স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (সা.) এটা করেছেন। তিনি যা করেছেন মুসলমানদের জন্য তা সুন্নাহ এবং এটা স্বাভাবিক। এর আরেকটি দিকও আছে। জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে সংবিধানের ৪১নং অনুচ্ছেদ কতিপয় অধিকারও প্রদান করেছে এবং যেটা হচ্ছে ধর্মীয় স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতার কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার তারা ভোগ করেন। একটি রাজনৈতিক দল যদি ইসলামকে তার ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে এবং তার অনুশাসন অনুশীলন ও প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করে তাহলে রাষ্ট্র বা নির্বাচন কমিশন তাকে বাধা দিতে পারে না। এই অবস্থায় জামায়াতের গঠনতন্ত্র সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের আপত্তিসমূহের বিচার বিশ্লেষণ বাঞ্ছনীয় বলে আমি মনে করি এবং আমি এটাও মনে করি যে, জাগতিক জগতে জনগণের সার্বভৌমত্ব আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীন। সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো যা বলছে এবং করছে তা ধর্মীয় স্বাধীনতারই অংশ। এদের বাধা দিয়ে সরকার সংঘাত-সংঘর্ষের সৃষ্টি করছেন এবং নির্বাচন কমিশনকে তার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন বলে অনেকে মনে করছেন। এখন আদালতকেও সামনে এনেছেন। এর আশু সুরাহা না হলে সংকট বাড়বে বৈ কমবে না। এক্ষেত্রে ইসলামী দলগুলোর কোনটিরই বৈধতা আর থাকবে না এবং এর ফলে যে সংকট সৃষ্টি হবে তা হবে ভয়াবহ।
হাসিনা দলবল নিয়ে পালিয়ে যাবার প্রেক্ষাপটে নতুন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত জামায়াতের নিবন্ধন ফিরিয়ে দিয়ে ইনসাফ ও আদলকে সুপ্রতিষ্ঠিত ও সংহত করায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি।