আর্শিনা ফেরদৌস

বই মানবজীবনের গতিপথ পরিবর্তন করে দিতে পারে; যদি পাঠক পাঠঅভ্যাসের মাধ্যমে তা যথাযথভাবে হৃদয়োঙ্গম করতে পারেন। যদিও বই মানুষকে জ্ঞান দিতে পারে; কিন্তু নৈতিকতা বদলায় আত্মজ্ঞান আর চর্চায়। অনেকে বলেন একটা বই পড়ে জীবনের মোড় ঘুরে গেছে, পাঠক বদলে ফেলেছেন নিজেকে। কিন্তু সে কথার সাথে যদি ব্যক্তির আচরণ না মেলে, যদি সে বদল কেবল মুখের বুলি বা কথার কথা হয়ে থাকে; তাহলে তা তো আত্মপ্রবঞ্চনা। বই বদলিয়ে দেয়, সত্যিই বদলিয়ে দেয়; যদি পাঠক সত্যিই তা গ্রহণে প্রস্তুত থাকেন। কিন্তু যখন জ্ঞানের আলোকে ব্যবহার করা হয় আবরণের মতো, তখন সেটি আর বদল নয়, বরং হয়ে ওঠে নতুন এক ছদ্মবেশ। হৃদয় না বদলালে বইয়ের পাতায় চিহ্ন থাকে; জীবনে নয়। জ্ঞান তখনই কাজে লাগে, যখন তা অন্তরে প্রবাহিত হয়, বাহ্যিক অভিনয়ে নয়। তাই জ্ঞান ও আচরণের মধ্যে সুসমন্বয় খুবই জরুরি। তাহলেই বই পড়া ব্যক্তির জন্য ইতিবাচক ও স্বার্থক হয়ে উঠতে পারে।

বস্তুত বই বদলে দেয় মন; যদি মন তা গ্রহণে প্রস্তুত থাকে। কিন্তু ভণ্ডামি আর প্রবৃত্তির দাসত্ব থাকলে কোনো লেখা, কোনো পাণ্ডিত্যই চরিত্র গঠনে সহায়ক হয় না। একথা সত্য যে, বই বদলিয়ে দিয়েছে অনেককে, যারা মর্মবাণীকে হৃদয়ে জায়গা করে দিয়েছেন। কিন্তু যারা বইকে ব্যবহার করেছে মুখোশ হিসেবে, তারা কেবল ছদ্মবেশে থেকেছেন; বদলান নি। এটিকে এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা বলা চলে।

বই জ্ঞানের আলো জ¦ালাতে সহায়ক হয়। চেতনা স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন করে দেয় মেধা ও মননের উৎকর্ষে। এভাবেই বই বদলে দেয় পাঠকদের জীবন, বোধ ও বিশ্বাসকে। শিশুরা বই পড়ে প্রশ্ন করে, এটা যে কত মধুর যারা প্রশ্ন শুনেছে তারাই বুঝবেন। বই তাদের জন্য কখনো কখনো হয়ে ওঠে অবিচ্ছেদ্য অবলম্বন। এভাবেই অভ্যাস গড়ে ওঠে পড়ার। বয়সীরা পরিণত হন। তাই বই হোক সঙ্গী; দূর হোক অশুভ প্রতিযোগিতা। শুরু হোক সুন্দর ও সুকুমারবৃত্তির চর্চা।

মনস্তত্ত্ব, বাস্তবতা ও রূপান্তরের বিশ্লেষণ করলে উপলব্ধি করা যায়, বই মানুষকে শুধু জ্ঞান দেয় না, বদলেও দেয়। একজন শিক্ষক, ছাত্র, শিশু কিংবা সাধারণ মানুষের মনোজগত ও দৈনন্দিন চিন্তাধারায় বই পড়ার গভীর প্রভাব পড়ে। কখনো একটি বাক্য, কখনো একটি চরিত্র, কখনো বা একটি কল্পনা মনের গভীরে গিয়ে ধাক্কা দেয়, প্রশ্ন তোলে, জবাব খোঁজে। এ খোঁজার মধ্য দিয়েই শুরু হয় পরিবর্তন। তাই বইকে জ্ঞানের আঁকড় বলা হয়।

বই এবং মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন : মানবমস্তিষ্ক খুবই অত্যাশ্চর্য। এটি কেবল তথ্য সংগ্রহ করে না বরং প্রতিনিয়ত ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ এবং আবেগের প্রতিক্রিয়াও তৈরি করে। বই পড়া এ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। যখন আমরা গল্প পড়ি, তখন আমাদের মস্তিষ্কের সে অংশ সক্রিয় হয়, যেটি বাস্তবজীবনের অনুভব এবং সহানুভূতির সঙ্গে যুক্ত। ফলে পাঠক চরিত্রের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে, তার অনুভব নিজের মনে গেঁথে নেয়। স্নায়ুবিজ্ঞান বলছে, বই পড়ে মানুষ শুধু তথ্য শিখে না, বরং তার অনুভব, মূল্যবোধ ও আত্মবিশ্বাসেও পরিবর্তন আনে। George R. R. Martin-Gi fvlvq 'A reader lives a thousand lives before he dies. The man who never reads lives only one. .

শিক্ষক, ছাত্র ও শিশুর জীবনে বইয়ের প্রভাব : একজন শিক্ষক বইয়ের মাধ্যমে চিন্তা প্রসারিত করেন। তিনি শুধু পাঠদানের জন্যই বই পড়েন না, বরং নিজেকে চিনতে, উপলব্ধি করতে ও বিকশিত করতে বইকে বেছে নেন। একদিকে তিনি নিজের আত্মোপলব্ধির পথ খুঁজে পান, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের জন্য নির্মাণ করেন মানবিক এবং জ্ঞাননির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি। আর এর মাধ্যমে তিনি শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটান।

একজন শিক্ষার্থীর জীবনে বই পথপ্রদর্শকের মতো। শুধু পাঠ্যবই নয় উপন্যাস, আত্মজীবনী, বিজ্ঞান, কল্পকাহিনী, কবিতা সবই একেকটি জানালা, যেখান থেকে সে দুনিয়াকে নতুন চোখে দেখে। পাঠকের মনে জাগ্রত হয় প্রবল অনুসন্ধিৎসা। একটি বই হয়তো তার স্বপ্নের উৎস হতে পারে, তার ক্যারিয়ার নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারে।

বই শিশুদের কল্পনার ডানা মেলে দেয়; তাদেরকে স্বপ্নের রাজ্যে বিচরণ করতে শেখায়। শিশুমন কল্পনায় বেশি বাঁচে। আর বই সে কল্পনায় অর্থ ও নৈতিকতা যোগ করে। গল্পের নায়ক, দুঃসাহসিক অভিযাত্রা বা বন্ধুত্বের সম্পর্ক শিশুদের মনে এক ধরণের নৈতিক ভিত্তি তৈরি করে, যা ভবিষ্যতের আচরণে প্রতিফলিত হয়। তাই ব্যক্তির আত্মগঠনে বই খুবই সহায়ক।

বই শুধু পাঠককেই নয়, লেখককেও বদলে দেয়। অধ্যবসায়ি লেখক হৃদ্ধ ব্যক্তিতে পরিণত হোন। লেখার মধ্য দিয়ে একজন লেখক নিজের ভেতরের দ্বন্দ্ব, দর্শন ও উপলব্ধিকে প্রকাশ করেন। লেখকের ভাবনার জগৎ সময়ের সঙ্গে বদলায়, আর তার প্রতিফলন ঘটে লেখায়।

অনেক মনীষী যেমন স্বামী বিবেকানন্দ, লিও টলস্টয়, জঁ-পল সার্ত্র তাঁদের জীবনেও বই গভীর দর্শনের জন্ম দিয়েছে এবং নিজের অবস্থান থেকে নতুন দিকে যাত্রা করেছেন। টলস্টয় নিজেই বলেছেন: ‘ All great literature is one of two stories: a man goes on a journey or a stranger comes to town. ’ অর্থাৎ, প্রতিটি বড় গল্প হয় এক অন্তরযাত্রা, নয়তো বাইরের নতুন উপলব্ধির ফল।

যখন আমরা বই পড়ি, তখন কেবল বাইরের জগত নয়, আমাদের অভ্যন্তরীণ বাস্তবতাও বদলায়। সবকিছুতে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসে একে বলা যায় ‘সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ’। যেমন, একটি যুদ্ধবিষয়ক উপন্যাস একজন পাঠককে সহানুভূতির চোখে উদ্বাস্তু সমস্যাকে দেখতে শেখায়, যেখানে আগে সে কেবল পরিসংখ্যান জানত। কল্পনা, স্বপ্ন ও বাস্তবতা-এ তিনটি স্তরই বইয়ের ভেতর ঘূর্ণায়মান। একটা ভালো বই পাঠককে একই সাথে বাস্তব জগতের অসঙ্গতি বুঝতে, স্বপ্ন দেখতে এবং সমাধানের কল্পনা করতে শেখায়। এ তিন স্তর মিলে তার চিন্তা ও সিদ্ধান্ত বদলে দেয়।

একটি বই পড়েই কি নিজেকে বদলানো যায়? হ্যাঁ, যায়। কিন্তু তা নির্ভর করে বইটির প্রভাব, পাঠকের গ্রহণক্ষমতা ও সে সময়ের মানসিক প্রস্তুতির ওপর। অনেকেই একটি বই পড়েই তাদের জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে ফেলেছেন। এমন নজীর নেহায়েত কম নয়। একজন অল্পশিক্ষিত বা ‘ ছোট মনের’ মানুষ যিনি হয়তো নিজেকে সীমিত বিশ্বাসে আবদ্ধ রেখেছিলেন, বা কুসংস্কারে গড়ে উঠেছেন তিনিও বদলে যেতে পারেন যদি তার মনে সাড়া জাগায় এমন কোনো চরিত্র বা ঘটনা তিনি বইয়ে খুঁজে পান। এ পরিবর্তন ঘটে অনুভবের মাধ্যমে, না যে সে জটিল তত্ত্ব বুঝে বরং সে নিজের জীবনের সঙ্গে মিল খুঁজে পায়, এবং ধীরে ধীরে তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়।

একটি বই যদি কাউকে কাঁদায় বা আনন্দ দেয়, সে তখন অনুভব করে ‘আমার মতো অন্য কেউও তো এ যন্ত্রণা পেয়েছে।’ এ সহানুভূতি থেকেই নতুন ভাবনার জন্ম হয়। হয়তো সে নিজেকে ‘ঠিক’ ভেবেছিল সবসময়, কিন্তু একটি বই পড়ে সে নিজেই প্রশ্ন করে ‘আমি যা ভাবতাম, তা কি সত্যিই ঠিক?’ বস্তুত, বই মানুষের আত্মোপলব্ধিতে সহায়ক হয়।

কোনো আত্মজীবনী বা ছোটগল্প হয়তো তাকে শেখায় ‘আমিও পারি!’ এ সামান্য বিশ্বাসই বদলের বীজ বপন করে। এক সময় তা ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে পরিবর্তনের নিয়ামক শক্তি। বস্তুত বই শুধু জ্ঞানের উৎস নয়, এটি এক ধরণের আলো যা পাঠকের ভেতরের অন্ধকার দূর করে। কখনো একজন মানুষ পুরো জীবনেও বদলায় না, আবার কেউ হয়তো মাত্র একটি বই পড়ে নিজের জীবনের দিক পরিবর্তন করে। Virginia Woolf -এর ভাষায়, ‘ Books are the mirrors of the soul ’ অর্থাৎ বই হচ্ছে আত্মার আয়না। তাই শিক্ষক হোক, ছাত্র হোক কিংবা সাধারণ মানুষ যিনি বই পড়ে, তিনি বদলায়, গভীরে গিয়ে বদলায়। বদলায় চিন্তায়, বদলায় কাজে, বদলায় জীবনে; সর্বোপরি বোধ, বিশ্বাস ও সৃজনশীলতায়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কবি।